নিরাপত্তাকর্মী থেকে শতকোটি টাকার জমির মালিক পারভেজ
প্রকাশ: ২০ জানুয়ারি, ২০২৩, ৭:৪০ পূর্বাহ্ণ |
অনলাইন সংস্করণ
বরিশাল খবর ডেস্ক :
প্রকৃত নাম পারভেজ আহম্মেদ জাহান। বয়স ৬৬। পেশায় একজন নিরাপত্তাকর্মী। নিজেকে খানবাহাদুর ইফতেখার আহম্মেদ খান পরিচয়ে গুলশানে ৪৪০ কোটি টাকা মূল্যের ৪৪ শতাংশের একটি জমির মালিক দাবি করেন। প্রকৃত মালিক যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী উল্লেখ করে সেই বাড়ির জাল দলিল তৈরি করে আমমোক্তারনামার মাধ্যমে মালিক বনে যান ইফতেখার। এরপর সেই জমি বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে বিক্রির নামে কোটি কোটি টাকা প্রতারণা করেন পারভেজ জাহান। প্রতারণার অর্থ থেকে ৪০ লাখ টাকায় তিনি করোনার সময় বিভিন্ন মানুষকে আর্থিক সহায়তাও করেছেন। এক পর্যায়ে নিজেও প্রতারিত হয়ে তেজগাঁও থানায় মামলা করতে আসেন। পরবর্তীতে মামলার তদন্ত করতে গিয়ে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসে। মামলার বাদী থেকে হয়ে যান প্রধান আসামি।
গত বছরের মাঝামাঝিতে রাজধানীর তেজগাঁও থানায় তার বিরুদ্ধে অভিনব এই প্রতারণার দায়ে মামলা হলে মামলার তদন্ত করতে গিয়ে এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য পান তদন্তকারী কর্মকর্তা। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পারভেজ একজন উচ্চমানের প্রতারক এবং ঠকবাজ। এর আগে তার বাবার সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগে পুরান ঢাকার বাসা থেকে বের করে দেয়া হয়।
এরপর মামলার এজাহারে উল্লিখিত আসামি পারভেজ আহম্মেদ জাহান নিজের নাম-ঠিকানার স্থানে ইফতেখার আহম্মেদ খান পরিচয়ে দীর্ঘদিন ধরে আত্মগোপনে থেকে এই প্রতারণা চালিয়ে যান। সূত্র জানায়, আসামি ও মামলার বাদী ইফতেখার আহম্মেদ খান নকল পরিচয়ে পূর্ব তেজতুরী বাজার ঠিকানা ১৮১তে বিগত প্রায় ১৩ থেকে ১৪ বছর আগে ভাড়া থাকার পাশাপাশি নিরাপত্তাকর্মীর কাজ নেন। এ সময় বাড়ির মালিকের ছেলে হোসাইন মাওলা চৌধুরীর কাছে আশ্রয় চায়। তখন হোসাইন মাওলা তাকে বাড়ির নিচ তলার সিকিউরিটি গার্ডের (নিরাপত্তাকর্মী) কাজ দিয়ে একটি ছোট কক্ষে থাকতে দেন। এবং বাড়ির বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল পরিশোধে কেয়ারটেকারের কাজও করাতেন। প্রকৃত এনআইডি মতে ০৫/১১/১৯৫৫ইং জন্মতারিখ পরিবর্তন করে প্রতারক পারভেজ তার কর্মস্থলের ঠিকানায় নিজের জন্মস্থান হিসেবে দেখিয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন থেকে ভুয়া জন্মনিবন্ধন তৈরি করেন। জন্মনিবন্ধনের সূত্র ধরে গত-৩০/১১/১৪ইং তারিখে এনআইডি তৈরি করেন। যার এনআইডি নম্বর-৩৭১৩৮৯৩৭৯৪।
পরে এই আইডি ব্যবহার করে গুলশান-২ এর প্লট নম্বর- এন.ডব্লিউ (জে) ০৫, রোড নম্বর-৫১, এর ৪৪ (চুয়াল্লিশ) শতাংশ জমি নিজের বলে দাবি করেন। যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ৪শ’ ৪০ কোটি টাকা। প্রতারক পারভেজ প্রকৃত মালিক ইনতেখার আহম্মেদ খানকে নিজের আপন ভাই বলে পরিচয় দেন। রাজউকে এক ব্যক্তিকে নকল ইনতেখার আহম্মেদ খান পরিচয়ে নিজের ছবি স্ট্যাম্প করেন। প্রকৃত জমির মালিকের নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, ভোটার আইডি কার্ড, জমির দলিল, বাবা-মায়ের নাম ইত্যাদির মাধ্যমে নিজেকে প্রকৃত মালিক দাবি করেন। এ ঘটনায় জমির মূল মালিক আদালতে মামলা করলে তাদেরকে বিভিন্ন সময়ে র্যাব-পুলিশসহ বিভিন্ন মাধ্যমে হয়রানি করেন। প্রতারক পারভেজ আদালতে নিজের জমি দাবি করে মামলা করলে উচ্চ আদালত তার নামে রায় দেয়। এ সময় তিনি তার নানার সঙ্গে বৃটেনের রানী, লর্ড ক্লাইভসহ অনেকের ছবি এডিট করে সবাইকে প্রদর্শন করতেন। এবং তিনি দাবি করেন যে, উক্ত প্লটটি রাজধানীর ওয়ারীর ৭ ওয়ারী স্ট্রিটে বসবাসরত তার নানী বিলকিস বেগম, স্বামী-মৃত খানবাহাদুর নুরুল হকের। নানী বিলকিস বেগমের একমাত্র সন্তান এবং প্রতারক পারভেজের মা তাহমিনা বেগম।
বাবা মৃত ডা. মমতাজুল হক খান। ঠিকানা-৭ ওয়ারী স্ট্রিট, ওয়ারী-ঢাকা। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বাদী পারভেজের মামলার অনুসন্ধান করার সময় জানা যায় তিনি গুলশানের প্লট নম্বর এন.ডব্লিউ (জে) ০৫ এর মূল মালিক বিলকিছ বেগমের মেয়ে তাহমিনা বেগমের সন্তান ইনতেখার আহম্মেদ এর আপন ভাই। এই পরিচয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্রে তার নিজের নাম জমির মূল মালিক তাহমিনা বেগমের সন্তান ইনতেখার আহম্মেদের আপন ভাই খানবাহাদুর ইফতেখার আহম্মেদ খান বলে উল্লেখ করে। তার প্রকৃত নাম পারভেজ আহম্মেদ জাহান। বাবা মৃত শাহজাহান, মা কাশ্মীরি বেগম। ছোট ভাই দিদার আহম্মেদ জাহান। এবং আরিফ পারভেজ ফুয়াদ ও আফরিন পারভেজ নামে দুই সন্তান রয়েছে। ১২৪ আগা সাদেক, বংশাল রোডে দ্বিতীয় তলাবিশিষ্ট একটি ভবনে পরিবারের সদস্যরা থাকেন। তিনি প্রকৃত পরিচয় গোপন করে ইফতেখার আহম্মেদ, বাবা মৃত ডা. মমতাজুল হক খান, মা মৃত তাহমিনা বেগম। ঠিকানা বাসা নম্বর-১৮১, পূর্ব তেজতুরী বাজার, তেজগাঁও ব্যবহার করে আসছিলেন। তদন্ত সূত্র জানায়, পারভেজ জানায়, গুলশানের প্লটটি তার নানী বিলকিস বেগম মা তাহমিনা বেগমকে দান করেন।
তাহমিনা বেগমের কাছ থেকে তার কথিত ভাই এবং জমির প্রকৃত মালিক ইনতেখাব আহম্মেদ খান গুলশানের প্লটটি প্রতারক পারভেজকে দানসূত্রে আমমোক্তার নামার মাধ্যমে বুঝিয়ে দেন। ইনতেখাব আহম্মেদ আমেরিকা থেকে গুলশানের প্লটের পাওয়ার অফ অ্যার্টনি দিলে তিনি পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি মূলে রাজউকসহ ভূমি অফিসের সকল স্থানে তার ছদ্মনাম ইফতেখার আহম্মেদ ব্যবহার করে। তার দাবির স্বপক্ষে নিজের ছবিসহ কিছু ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে দাখিল করে। এসব ভুয়া কাগজ ব্যবহার করে সে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে প্লটটি বিক্রির জন্য প্রাথমিকভাবে জমি বায়না করে। পরবর্তীতে গাঢাকা দেয়। পারভেজ ওরফে ইফতেখার আহম্মেদ পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি মূলে এই সম্পত্তি নিজের দাবি করে রাজউকের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জালিয়াতির মাধ্যমে তৈরি করা কাগজপত্র, আসল কাগজ বলে দেখায়। পরবর্তীতে জমি আত্মসাতের পাঁয়তারা করে। এ ঘটনায় ২০২১ সালের ১০ই আগস্ট তেজগাঁও থানায় প্রতারক পারভেজ একটি মামলা করেন। মামলা নম্বর-৩০। ধারা- ৪২০/৪০৬/৩৪ পেনাল কোড।
এ মামলায় তিনি গুলশানের প্লটটির মালিক নিজে উল্লেখ করে এজাহারটি দায়ের করেন। এর আগে জমির মালিকানা দাবি করে জমিটি বিক্রির জন্য বায়না বাবদ সৈয়দ গোলাম হাসান কবির নামে এক ভুক্তভোগীর কাছ থেকে ৩০ লাখ টাকা আত্মসাৎসহ ১০ জন ব্যক্তির কাছ থেকে ২৫ থেকে ৩০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে জানা যায়। প্রতারণার কৌশল হিসেবে জমি ক্রয়ে আগ্রহী ব্যক্তিদের কাছ থেকে প্রাথমিকভাবে ৫০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত অগ্রিম জমির বায়না হিসেবে নিতেন। এরপর বায়নার মেয়াদ শেষ হলে জমি তাদেরকে বুঝিয়ে না দিয়ে নানা টালবাহানা করতেন। প্রতারণার টাকায় করোনাকালীন সময়ে প্রতারক পারভেজ প্রায় ৪০ লাখ টাকা খরচ করে সাধারণ মানুষকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানায়। আসামি পারভেজ একটি জাল জালিয়াতি চক্রের মূল হোতা। অজ্ঞাতনামা ১০ থেকে ১৫ জন সহযোগীর সহযোগিতায় ২০১৪ সালের ৬ই জুলাই থেকে ২০২২ সালের ৭ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের জোন-৫ এর কার্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্রসহ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার কাগজপত্র জালিয়াতির মাধ্যমে এসব কাগজপত্রকে আসল বলে দাবি করে প্রতারণা করে আসছিল।
এ ঘটনায় পুলিশ পরিদর্শক (নিরস্ত্র) মো. শাহ আলম পারভেজসহ অজ্ঞাতনামা ১০ থেকে ১৫ জনের বিরুদ্ধে গত বছরের ৭ই ফেব্রুয়ারি বাদী হয়ে তেজগাঁও থানায় একটি মামলা করেন। এর আগে নিজ নাম-পরিচয় গোপন রেখে ইফতেখার আহম্মেদ খান পরিচয়ে তেজগাঁও থানার প্রতারক পারভেজ একটি মামলা করেন। মামলা নম্বর-৩০ (৮) ২০২১। এই প্রতারণার ঘটনায় হাজী মো. ছানাউল্লাহ খান, মো. আব্দুল মান্নান সরকার, আসামির ছোট ভাই দিদার আহম্মেদ জাহান, ছোট বোন সামসা জাহান, মাহমুদা জাহান তার বিরুদ্ধে স্বাক্ষী দিয়েছেন। বলেছেন, তাদের ভাই প্রতারক। চাঞ্চল্যকর প্রতারণার এই মামলাটির তদন্ত রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে পুরসৃ্কত করা হয় বলে জানায় সূত্র। ডিএমপি’র তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) অপূর্ব হাসান বলেন, প্রতারক পারভেজ এতটাই ধূর্ত যে, তিনি গুলশানের ৪৪ শতাংশ জমি আত্মসাতের জন্য রাজউকে নিজের ছবি স্ট্যাম্প করেছেন। এ ছাড়া সকল কাগজপত্র এমনভাবে তৈরি করেছেন যে, জমির প্রকৃত মালিক আদালতে বিচার চেয়ে এখন রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। পারভেজের স্থায়ী কোনো ঠিকানা নেই। প্রতারণা মামলার পরে কারাগার থেকে জামিনে বেরিয়ে প্রতি মাসে একবার করে থানায় হাজিরা দেয়ার কথা থাকলেও তিনি নিয়মিত হাজিরা দেন না। এখন পর্যন্ত প্রায় ১০ জন ভুক্তভোগীর কাছ থেকে ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে জানিয়েছেন এই কর্মকর্তা।