শহরে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। জলবায়ুর পরিবর্তনে এই সংখ্যা বাড়ছে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। নদীভাঙনে দেশে প্রতি বছর বিলীন হচ্ছে ৩ হাজার ২০০ হেক্টরের বেশি জমি। এর সঙ্গে প্রতি বছর বাস্তচ্যুত হচ্ছে ২৫ হাজার মানুষ। তারা জমি, ভিটেমাটি হারিয়ে অসহায় জীবনযাপন করছে বিভিন্ন শহরে। তাদেরই একজন সুফিয়া বেগম। বয়স আনুমানিক ৪৫ বছর। থাকেন আগারগাঁও ফুটপাতের ঝুপড়ি ঘরে। ঢাকা শহরে এসেছেন পাঁচ বছর আগে। সংসারে দুই মেয়ে, এক ছেলে ও স্বামীসহ তার সংসার। বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিলেন, ভালো থাকার আশায়, সংসারের একটি খাবার মুখ কমানোর জন্য। কিন্তু মেয়ের জামাই কি এক ঝামেলায় জড়িয়ে বর্তমানে জেলে। মেয়ে আবার ফিরে এসেছে সুফিয়া বেগমের সংসারে, সঙ্গে তার দুই বছরের কন্যা সন্তানও। সুফিয়া বেগম বলেন, একসময় গেরস্ত ঘর ছিল, জমি ছিল, গরু ছিল—সব নদীভাঙনে তলায় গেছে…।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নদীভাঙন তীব্র হচ্ছে। অকালবৃষ্টি ও বন্যা, নদীর দিক পরিবর্তন এবং সুরক্ষা বাঁধ না থাকায় ক্ষয়ক্ষতি বাড়ছে। বাস্তুহারা মানুষ কোথায় ঠাঁই পাবে, তাদের ভবিষ্যৎ কী দাঁড়াবে—তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই। নদীতে বিলীন হওয়া স্থানে আবার চর জাগলেও শক্তিশালী ব্যক্তিবর্গের দখল ও আইনি জটিলতায় সে জমি ফিরে পান না প্রকৃত মালিকরা। সিকস্তি-পয়স্তি আইন অনুযায়ী, ৩০ বছরের মধ্যে নদীতে ভেঙে যাওয়া জমি জেগে উঠলে সে জমি প্রকৃত মালিক ফেরত পাবে। কিন্তু জমি ফিরে পেতে গেলে মামলা-হামলা, দখল-পালটা দখল এবং রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। গত কয়েক দশকের ব্যবধানে দেশে নদীভাঙন কিছুটা কমে আসছে। ১৯৯০ সালের দিকে দেশে নদীভাঙনে বিলীন হয় প্রায় ১০ হাজার হেক্টর, যা এখন ২-৩ হাজার হেক্টরে নেমে এসেছে। গত চার-পাঁচ বছর ধরেই এই ভাঙন কমছে। মূলত যমুনা নদীর পাড় ঘিরে বাঁধ তৈরির কারণে এই সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে। ২০২১ সালে দেশের প্রায় ৩ হাজার হেক্টর জমি নদীতে বিলীন হয়।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের ‘ন্যাশনাল অ্যাডাপ্টেশন প্ল্যান অব বাংলাদেশ (২০২৩-২০৫০)’ প্রতিবেদনের তথ্য মতে, দেশে ১৯৭৩ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রধান দুই নদী পদ্মা-যমুনার ভাঙনে বিলীন হয়েছে ১ লাখ ৫৭ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমি। এর মধ্যে যমুনায় বিলীন হয়েছে ৯৩ হাজার ৯৬৫ হেক্টর, আর পদ্মায় ৬৩ হাজার ৫৫৮ হেক্টর। গড়ে প্রতি বছর ৩ হাজার ২০০ হেক্টরের বেশি জমি বিলীন হচ্ছে। নদীভাঙনে বিলীন হচ্ছে কৃষিজমি, বসতবাড়ি, রাস্তা, বাঁধ ও অবকাঠামো।
নদীভাঙনে
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) দুর্যোগবিষয়ক পরিসংখ্যান (বিডিআরএস) বলছে, ‘২০২১ : ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ন্যাচারাল ডিজাস্টার পারসপেকটিভ’ শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে নদী ও উপকূলের ভাঙনে ক্ষতির শিকার হওয়া পরিবারের সংখ্যা বাড়ছে। এ ছাড়া নদী ও উপকূলের ভাঙনে ২০১৪ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৬ বছরে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২৬ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার এমপি বলেন, দেশের সকলকে সম্মিলিতভাবে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কাজ করতে হবে। আর এ জন্য নিজ নিজ জায়গা থেকে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বেড়ে গেছে সাইক্লোন, ঘূর্ণিঝড়, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খরা, তাপদাহ, কুয়াশা, শিলাবৃষ্টি ইত্যাদি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন—বাপার যুগ্ম সম্পাদক মিহির বিশ্বাস বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, সিলেটসহ দেশের সব ছোট-বড় শহরেই এই বাস্তচ্যুত দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। গ্রামের চেয়ে নগরে জনসংখ্যার ঘনত্ব ও চাপ বেড়েছে এবং নগরে সম্পদের ব্যবহার, আবাসন, স্বাস্থ্য খাত, খাদ্য নিরাপত্তা ও সীমাবদ্ধ কর্মক্ষেত্রের ওপরও চাপ তৈরি হচ্ছে।