সাব্বির আলম বাবু : সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে করোনার আগ্রাসনের মাঝেও মুসলমানদের পবিত্র রমজান উপলক্ষে সর্বত্রই এখন মুড়ির বাজার সরগরম। সরকার ঘোষিত লকডাউন, কোয়ারেন্টাইন, কোন কিছুই মুড়ির বাজারে ধ্বস নামাতে পারেনি। কারন ইসলামের প্রধান পাঁচটি স্তম্ভের একটি হচ্ছে রোজা বা রমজান। এই সময় সারাদিন মহান সৃষ্টিকর্তার ভয়ে ও তাঁর নৈকট্য লাভের আশায় মুসলমানরা একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত পানাহার থেকে বিরত থাকে। তারপর সন্ধ্যাকালীন সময়ে বাঙ্গালীর সামনে ইফতারের সাজানো পসরায় অন্যান্য খাবারের মাঝে অবশ্যই মুড়ি থাকা চাই। বুট, মুড়ি, পেয়াজু, সরবত না হলে যেন ইফতার জমেই না। তাই রমজান মাস আসলে বছরের অন্যান্য মাস থেকে এই সময়ে মুড়ি তৈরীর মালিকের বাড়ী ও কারখানায় মুড়ি তৈরীর ধুম পড়ে যায়। ইতিমধ্যে বিভিন্ন বাজারের ব্যবসায়ীরা মুড়ির মিল মালিকদের কাছ থেকে মুড়ি কিনে দোকানে নানারকমের মুড়ির পসরা সাজিয়ে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করছেন। ভিন্ন ভিন্ন দামের মুড়ি আগে থেকেই কেজি মেপে রেখেছেন দোকানীরা যাতে ক্রেতাদের নিকট দ্রুত মুড়ি বিক্রি করা যায়।
সরেজমিনে গিয়ে দেখাখা যায়, প্রত্যন্ত অঞ্চলের মুড়ি তৈরীর কারিগররা রমজান মাসের বেশ কিছুদিন আগে থেকেই ব্যবসায়ীদের কাছে চাহিদা মতো মুড়ির যোগান দিচ্ছে। সাধারনত হিন্দু পরিবারের সদস্যরাই বেশী এ পেশায় জড়িত। মুড়ি তৈরীর কারিগর শম্পা রানী দাস জানান, সাধারনত মোতা, গিওচ, স্বর্না, আউস, ইরি ইত্যাদি ধান থেকে মুড়ি তৈরী হয়। মুড়ি তৈরীর গ্রামে নারী-পুরুষেরা যার যার কাজ আলাদা ভাবে করে মুড়ি উৎপাদন করে। যেমন- পুরুষরা হাট থেকে ধান কেনা, ভাঙ্গানো ও বাজারজাত করনে এবং নারীরা সেই ধান সেদ্ধ করা, শুকানো, চাল থেকে মুড়ি বানানোর কাজে ব্যস্ত থাকে। মুড়ি কারিগর কাজল দাস জানান, হাতে ভাজা মুড়ি তৈরীতে তারা কোন কেমিক্যাল বা ইউরিয়া সার ব্যবহার করেন না। কিন্তু ভালো মানের মুড়ি তৈরীতে ধান ছাড়াও জ্বালানী খরচ বেশী পড়ে। সে তুলনায় বাজারে মুড়ির দাম বৃদ্ধি না পাওয়ায় তারা ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না। রোদ আর আগুনের তাপে পুড়ে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের পর যে উপার্জন হয় তা দিয়ে কোনমতে চলে তাদের জীবন যাপন। মুড়ি কারিগর বিপ্লব দাস জানান, প্রতি একমন ধান হতে ২২/২৩ কেজি মুড়ি তৈরী হয়। সব খরচ বাদ দিয়ে একমন ধানের মুড়ি বিক্রি করে তাদের হাতে থাকে ১০০/১৫০ টাকা। কারন হিসাবে জানা যায়, নিজস্ব পুঁজি না থাকায় মুড়ি কারিগরদের অনেকে এনজিও বা দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋন নিয়ে এই ব্যবসা চালাচ্ছে। এই ঋনের চড়া সুদের টাকা পরিশোধ করতে গিয়ে তাদের অবস্থার পরিবর্তন আসছে না। অপরদিকে বাজারে ইদানিং মেশিনে তৈরী কেমিক্যাল মিশ্রিত মুড়ির আধিপত্য বেড়েছে। যার ফলে দেশী হাতে ভাজা মুড়ির প্রসার কমে গেছে। মেশিনে ভাজা এলসি মুড়ি আকারে বড়, দেখতে সাদা সুন্দর ও ঝরঝরে হওয়ায় এবং তুলনামুলক সস্তায় পাওয়া যায় বিধায় সাধারন ক্রেতারা এগুলো কিনতে বেশী আগ্রহী হয়। অন্যদিকে দেশী হাতে ভাজা মুড়ি দেখতে লালচে, মোটা ও একটু ময়লাটে দেখায় বিধায় এবং দামে বেশী হওয়ায় ক্রেতা হারাচ্ছে। বাজারে যেখানে মেশিনে তৈরী এলসি মুড়ির দাম কেজি প্রতি ৫০/৬০ টাকা সেখানে দেশী হাতে ভাজা মুড়ির দাম ৯০/১০০ টাকা। কিন্তু স্বাদে, গুনে, মানে হাতে ভাজা মুড়িই সবচেয়ে ভালো। এভাবে চলতে থাকলে এক সময় প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী এই মুড়ি তৈরীর শিল্পটি অচিড়েই কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে এবং তার স্থান দখল করবে মেশিনে তৈরী এলসি মুড়ি। বিশেষজ্ঞদের মতে, সার ও কেমিক্যাল মিশ্রিত এই বিষাক্ত এলসি মুড়ি খেয়ে অনেকেই জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। কিডনি, লিভার সহ শরীরের গুরুত্বপূর্ন অঙ্গ এমন কি ক্যান্সারের মতো ভয়াবহ রোগের শিকার হতে পারে। ক্রেতাদের দৃষ্টি নন্দন মচমচে, ফুরফুরে এই মুড়ি রমজানের বাজারকে সামনে রেখে ব্যবসায়ীরা মজুদ করেছে। এই বিষয়ে আলাপকালে ব্যবসায়ীরা জানান, মুড়ি বেচাকেনা বর্তমানে স্বাভাবিক হলেও করোনার রোগের প্রকোপে বিগত দিনের থেকে কিছুটা কম।