অমিতোষ পাল : বিদ্যুতের সাবস্টেশন আর জেনারেটর বসানো হয়েছে কোটি টাকা খরচায়। এর চেয়েও বেশি ব্যয়ে তৈরি করা হয় অটোমেটিক ব্লক মেকিং প্লান্ট। পিলে চমকানো তথ্য হলো- এ সবকিছুই জন্ম থেকে মৃত! গেল তিন বছরে প্লান্টে তৈরি হয়নি একটি ব্লকও। শুরু থেকেই বিদ্যুতের সাবস্টেশন ও জেনারেটর নিশ্চল, তাই যন্ত্রে হাত পড়েনি কারও। অনিয়ম আছে আরও। প্রতিষ্ঠানটিতে আদতে কাজ করতেন ২৮ নিরাপত্তাকর্মী, তবে বেতন তোলা হতো ৪১ জনের নামে।
রাজধানীর দারুস সালামে দেশের একমাত্র সরকারি আবাসন গবেষণা প্রতিষ্ঠান হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটে (এইচবিআরআই) চলেছে এসব তুঘলকি কারবার। এই প্রতিষ্ঠানেরই গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন অনিয়ম-দুর্নীতির ছবি। ৩৭২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনটি সম্প্রতি জমা দেওয়া হয়েছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে।
সংশ্নিষ্ট সূত্রে জানা যায়, এইচবিআরআইর অনিয়ম নিয়ে বিভিন্ন সময় নানা অভিযোগ জমা পড়ে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালের ২৯ জুলাই সংস্থার সিনিয়র রিসার্চ আর্কিটেক্ট ও হেড (হাউজিং ডিভিশন) নাফিজুর রহমানকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়। অন্য দুই সদস্য হলেন সিনিয়র রিসার্চ অফিসার আহসান হাবিব ও লাইব্রেরিয়ান প্রশান্ত কুমার রায়।
যখন অনিয়মের ঘটনা ঘটে, তখন এইচবিআরআইর ডিজি ছিলেন মোহাম্মদ শামীম আখতার। বর্তমানে তিনি গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলীর দায়িত্বে আছেন। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, তদন্ত কমিটি গঠন ও প্রতিবেদন তৈরি করে যেভাবে মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে, তা উদ্দেশ্যমূলক ও সার্ভিস রুলের পরিপন্থি। একজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত করতে হলে সমপদমর্যাদাসম্পন্ন কর্মকর্তাকে দিয়ে কমিটি করতে হয়। এইচবিআরআইর বর্তমান ডিজি আশরাফুল আলম যদি নিজে তদন্ত করতেন, তাহলেও একটা কথা ছিল।
শুরু থেকেই বিকল অটোমেটিক ব্লক :এইচবিআরআইর ভেতরে একটি অটোমেটিক ব্লক মেকিং প্লান্টের কাজ পায় মহাখালী ডিওএইচএসের কিংডম বিল্ডার্স লিমিটেড। কিছুদিনের মধ্যে প্লান্টটি তৈরি করে ১ কোটি ১ লাখ ১১ হাজার টাকার পুরো বিল নিয়ে চলে যায় প্রতিষ্ঠানটি। পরে দেখা যায়, প্লান্টটি নিশ্চল। এ পর্যন্ত একটি ব্লকও তৈরি করতে পারেনি। এর পর থেকেই প্লান্টটি সেভাবে পড়ে আছে। তদন্ত কমিটি দেখতে পায়, প্লান্ট স্থাপনে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল ২০১৯ সালের ১৯ মে। তবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চীন থেকে প্লান্টটি আমদানি করে ওই বছরের ১৪ মে, অর্থাৎ দরপত্রের পাঁচ দিন আগেই। আমদানি দর ছিল ৮৭ হাজার ২৮০ মার্কিন ডলার। তখন প্রতি মার্কিন ডলার ছিল ৯১ টাকা। এ থেকে পরিস্কার হয়ে যায়, ওই প্রতিষ্ঠানকে আগেভাগে কাজ দেওয়ার যোগসাজশ ছিল এইচবিআরআইর কর্মকর্তাদের। যে কারণে দরপত্র আহ্বানের আগেই প্লান্ট আমদানি করে বসেছিল কিংডম বিল্ডার্স।
কিংডম বিল্ডার্সের মহাখালী ডিওএইচএস কার্যালয়ে গিয়ে জানা যায়, মালিক নুসরত হোসেন থাইল্যান্ডে চিকিৎসাধীন। পরে ফোনে কিংডম বিল্ডার্সের নির্বাহী পরিচালক মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ওখানে সব কাজই তারা করে দিয়ে এসেছেন; বরং তাদের আরও বিল বকেয়া আছে।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, বিশাল টিনশেডের নিচে স্থাপন করা প্লান্টটির ত্রিশঙ্কু দশা। এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আসলে পুরো কাজ শেষ করেনি। এ কারণে প্লান্টটি থেকে কোনো ব্লক তৈরি হচ্ছে না। কর্তৃপক্ষ বিষয়টি বুঝলেও তখন তা আমলে না নিয়ে বিল পরিশোধ করেছে। এখন চালু করতে হলে আরও কিছু কাজ করতে হবে।
এ ব্যাপারে সে সময়ের ডিজি শামীম আখতার সমকালকে বলেন, কাজ করার পর প্রথম দিকে চালুও করা হয়েছিল। সামান্য একটা বিষয় বাকি ছিল। অতিমারি করোনা শুরু হলে প্লান্ট সরবরাহকারী চীনা প্রতিষ্ঠানের লোকজন বলল, করোনার এ অবস্থায় তাদের পক্ষে কোনো লোকজন পাঠানো সম্ভব নয়। তবে এটার সবকিছুই ঠিক আছে। চাইলেই চালু করা যাবে। তবে ব্লক তৈরি করতে যে উপকরণ প্রয়োজন, সেটারই সংকট।
জেনারেটর-সাবস্টেশন নিশ্চল :এর আগে ২০১৯ সালের ২ এপ্রিল কিংডম বিল্ডার্সকে এইচবিআরআই কমপ্লেক্সে সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য একটি সাবস্টেশন ও জেনারেটরের কাজ দেওয়া হয়। সাবস্টেশন বাবদ খরচ ধরা হয় ৫০ লাখ টাকা। জেনারেটর বাবদ ৩৯ লাখ ২৩ হাজার টাকা। স্থাপনসহ মোট দর ছিল ৮৪ লাখ ৩৪ হাজার ৬১৯ টাকা। অথচ এর বিপরীতে এইচবিআরআই বিল পরিশোধ করে ৯২ লাখ ৫৩ হাজার টাকা। অতিরিক্ত প্রায় ৮ লাখ টাকা বিল পরিশোধ করার পরও শুরু থেকেই সাবস্টেশন ও জেনারেটর উভয়ই বিকল। এরই মধ্যে এক বছরের সার্ভিসিং সময়ও শেষ। ঠিকাদারকেও কখনও তলব করা হয়নি। প্রায় কোটি টাকা খরচ করে এক টাকারও উপযোগিতা পায়নি এইচবিআরআই।
এ ব্যাপারে সাবেক ডিজি শামীম আখতার বলেন, সাবস্টেশন ও জেনারেটর স্থাপন করা হয়েছিল একটি প্রকল্পের আওতায়। অনেক সময় কাজের বিল কিছু কমবেশি হয়। এটা স্বাভাবিক। তবে সাবস্টেশন ও জেনারেটর ঠিক আছে। ডেসকোর সংযোগ দিলেই সাবস্টেশন কাজ করবে। সেই সংযোগটাই দেওয়া হয়নি।
কাজ করেন ২৮ জন, বেতন পান ৪১ জন :ন্যাশনাল সিকিউরিটি সার্ভিসেস নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে বাদ দিয়ে ২০১৮ সালের ৭ আগস্ট দরপত্র ছাড়াই এলিমেন্টস সিকিউরিটিজ কোম্পানিকে নিরাপত্তাকর্মী সরবরাহের দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরে ওই প্রতিষ্ঠানকে বাদ দিয়ে ২০১৯ সালের ৩০ অক্টোবর একাত্তর সিকিউরিটি ফোর্স নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কাগজে-কলমে ৪১ নিরাপত্তাকর্মীর দায়িত্ব পালন করার কথা। প্রতি মাসে ৪১ জনের বিলও পরিশোধ করেছে এইচবিআরআই। তবে তদন্ত কমিটি বাস্তবে পেয়েছে ২৮ জনকে। বাকি ১৩ জনের বেতন কাগজে-কলমে তুলে নেওয়া হয়। প্রতিজনের মাসিক বেতন ৯ হাজার ৫০০ টাকা হিসাবে দুই বছরে ২৯ লাখ ৬৪ হাজার টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। বর্তমানে ওই প্রতিষ্ঠানেরই ২৮ কর্মী কাজ করছেন।
এ ব্যাপারে একাত্তর সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশিকুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন ধরেননি। এ ব্যাপারে সাবেক ডিজি শামীম আখতার বলেন, আশরাফ সাহেব থাকার সময় যে কয়জনের বিল দেওয়া হচ্ছিল, তাঁর সময়েও সেটাই বিল পরিশোধ করা হয়েছে। একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির অনুরোধে কেবল কোম্পানি বদল করা হয়েছে।
এদিকে তদন্ত কমিটি দেখতে পায়, পোড়াবিহীন ইট তৈরি প্রকল্পের জন্য ইয়ামিন আক্তারকে মাসিক ১ লাখ টাকা বেতনে চুক্তিভিত্তিক আট মাসের জন্য পরামর্শক নিয়োগ করা হয়। চুক্তি শেষ হলে একই বেতনে তাঁকে মহাপরিচালকের পরামর্শক করা হয়। ডিজি শামীম আখতার বদলি হওয়ার পর ইয়ামিন আক্তারের চাকরি আর নবায়ন করেনি এইচবিআরআই।
তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ও এইচবিআরআইর সিনিয়র রিসার্চ আর্কিটেক্ট ও হেড (হাউজিং ডিভিশন) নাফিজুর রহমান বলেন, ‘তদন্তে যা যা পেয়েছি, তা প্রতিবেদনেই তুলে ধরা হয়েছে। এর বাইরে আর কিছু বলতে পারব না।’
এইচবিআরআইর মহাপরিচালক (ডিজি) আশরাফুল আলম বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর কিছু অনিয়ম বন্ধ করেছি। আগে যেগুলো ঘটেছে, সেগুলোর ব্যাপারে আমার কিছু করার নেই।’