কীর্তনখোলা নদীর পোর্ট রোড ব্রিজ পয়েন্ট থেকে বরিশাল নগরের মাঝ দিয়ে পশ্চিমে বয়ে গেছে জেল খাল। ‘জনগণের জেল খাল, আমাদের পরিচ্ছন্নতা অভিযান’- স্লোগানে ২০১৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর হাজার হাজার মানুষের স্বেচ্ছাশ্রমে খালটি পরিস্কার করা হয়। তৎকালীন জেলা প্রশাসক গাজী মো. সাইফুজ্জামানের উদ্যোগে পরিচ্ছন্ন অভিযানের আগে খালের দুই তীরের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। তখন ২৫৫ দখলদারের তালিকা করা হয়েছিল। উচ্ছেদ এবং পরিচ্ছন্নতা অভিযানের পর কীর্তনখোলার ভরা জোয়ারে জেল খালের বুকে পানি থৈথৈ করত। তিন বছর না যেতেই ফের দখলদারদের আগ্রাসন এবং ময়লা-আবর্জনায় পূর্ণ হয়ে খালটি এখন মৃতপ্রায়।
সে বছর শুধু জেল খাল নয়, নগরীর মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া সাগরদী খাল, চাঁদমারী খাল, লাকুটিয়া খাল, নবগ্রাম খাল, ভাটার খাল ও শোভারানীর খালসহ ২২টি খালের অস্তিত্ব উদ্ধার ও পরিচ্ছন্ন করা হয়েছিল। তৎকালীন জেলা প্রশাসন ওই খালগুলোর তীরে খালের নামসহ সাইনবোর্ডও স্থাপন করেছিল। এখন সেই খালগুলো আবার ময়লা-আবর্জনায় পরিপূর্ণ হয়ে আছে। সাইনবোর্ডগুলোর অস্তিত্বও বিলীন। অথচ এসব খাল দিয়ে এক সময় যাত্রীবাহী ও পণ্যবোঝাই নৌকা চলাচল করত। গয়নার নৌকা চলত জেলার বিভিন্ন নৌপথে। নগরীর ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণ ছিল খালগুলো। দখলদারদের দৌরাত্ম্য আর ময়লা-আবর্জনায় খালগুলো এখন ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। এ কারণে ভারি বৃষ্টি হলেই নগরজুড়ে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়।
বরিশাল নগরের খালগুলোর মালিকানা বা তদারকি কর্তৃপক্ষ নিয়েও রয়েছে ধোঁয়াশা। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে নগরের ২২টি খাল দখলমুক্ত, পরিচ্ছন্ন ও চিহ্নিত করা হয় জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে। অথচ বরিশাল নদী-খাল বাঁচাও আন্দোলনের তালিকা অনুযায়ী মাত্র দুটি খাল জেলা প্রশাসনের এবং দুটি সিটি করপোরেশনের। বাকি ১৮টি খাল জেলা পরিষদের আওতাধীন। জেলা পরিষদের দায়িত্বশীল সূত্রও এ তথ্যের সত্যতা স্বীকার করেছে।
জেল খালের বড় অংশ বয়ে গেছে নগরীর ২ নম্বর ওয়ার্ডের নাজিরেরপুল থেকে নতুন বাজার পুল পর্যন্ত। এ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মুরতজা আবেদিন বলেন, জেল খাল বরিশালের ঐতিহ্য। ধান-নদী-খালের বরিশাল থেকে খাল হারিয়ে যেতে পারে না। তিন বছর আগে জেল খাল দখলমুক্ত করা হয়েছিল। তখন দুই তীরের বাসিন্দাদের কাছ থেকে খালে ময়লা না ফেলার অঙ্গীকারনামাও নেওয়া হয়েছিল। সেই কথা কেউ রাখেনি। জেল খাল এখন আবর্জনায় পূর্ণ হয়ে আছে। জোয়ারের পানি ঢোকে না। দখলদাররাও বসে নেই। ফের দখল-দূষণে মরে যাচ্ছে জেল খাল।
কীর্তনখোলার ডিসি ঘাট থেকে ভাটার খালটি জিলা স্কুলের পাশ দিয়ে গিয়ে মিশেছিল বটতলার নবগ্রাম খালের সঙ্গে। নগরের ১০ নম্বর ওয়ার্ডের ওপর দিয়ে যাওয়া ভাটার খালটি ময়লা-আবর্জনা আর দখলের কারণে উৎসমুখ হারিয়ে যাচ্ছে। খালটির একাংশ ২০১০ সালে ভরাট করে সড়ক নির্মাণ করে সিটি করপোরেশন। এ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এটিএম শহিদুল্লাহ কবির বলেন, ‘ভাটার খালে আর হয়তো কোনো দিন জোয়ার আসবে না’।
চাঁদমারী খাল দিয়ে পণ্যবোঝাই নৌকা যেত বাংলাবাজারে। নগরের ১২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মজিবর রহমান এ কথা জানিয়ে বলেন, দুই তীরের অধিকাংশ বাসিন্দা খালটি দখল করে আছে। পাকা স্থাপনাও করেছে। ময়লা-আবর্জনায় কোথাও কোথাও খালের অস্তিত্ব খুঁজেও পাওয়া যায় না। চাঁদমারী খালের স্টেডিয়াম পয়েন্টে গিয়ে দেখা গেছে, বহু দোকান গড়ে তোলার ফলে উৎসমুখ মরে যাচ্ছে।
বধ্যভূমির পশ্চিম পাশ দিয়ে বয়ে গেছে সাগরদী খাল। প্রবহমান এ খালটির আলেকান্দা-কাজিপাড়া পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটারে এখনও জোয়ারের পানি আসে। ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের মিরাবাড়ি-চৌমাথা বাজার থেকে পশ্চিমে পপুলার বিদ্যালয় পর্যন্ত ময়লা-আবর্জনায় বন্ধ হয়ে গেছে খালটির প্রবহমানতা। দুই তীরও দখলের কবলে। ২৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর এনামুল হক বাহার স্বীকার করেছেন, মানুষের অসচেতনতায় এ খালটির পশ্চিমাংশ মরে যাচ্ছে। কিছু মানুষ খালের জমিও দখল করেছে।
একই রকম অবস্থা নগরের লাকুটিয়া খাল, নবগ্রাম খাল, জাগুয়া খাল, আমানতগঞ্জ খাল, টিয়াখালী খাল, নাপিতখালী খাল, ভেদুরিয়া খাল, কাশিপুর খাল, কলাডেমা খাল ও কড়াপুর খালসহ অন্য খালগুলোর।
বরিশাল নদী-খাল বাঁচাও আন্দোলনের সদস্য সচিব এনায়েত হোসেন শিপলু বলেন, বরিশাল নগরের খালগুলো নগরবাসীর সৌভাগ্যের প্রতীক। তবে কেউ যত্ন নিচ্ছে না। এত খালের শহর বরিশাল আর নেই। খালগুলো নগরের পরিবেশ-প্রতিবেশের জন্য আশীর্বাদ। এগুলো বাঁচানো গেলে বরিশাল প্রকৃত অর্থেই প্রাচ্যের ভেনিস হতো। খালগুলোর অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ায় পানির উৎস ধ্বংস হচ্ছে। পয়ঃনিস্কাশন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) বরিশাল বিভাগীয় সমন্বয়কারী লিংকন বায়েন বলেন, জেল খালের সীমানা নির্ধারণ ও সংরক্ষণের জন্য তারা ২০১০ সালে আদালতে মামলা করেছিলেন। ওই মামলা এখনও চলছে। যে কোনো উপায়ে নগরীর খালগুলো রক্ষা করা প্রয়োজন।
বরিশাল নগরের খালগুলোর দুরবস্থা নিয়ে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বলেন, বরাদ্দ না থাকায় জেলা পরিষদের আওতাধীন খালগুলো রক্ষা করা যাচ্ছে না। খালের তীরের জমি ইজারা দেওয়া তিনি বলেন, ইজারা না দিলেও খালের জমি বেদখল হয়ে যায়। খালগুলো খনন এবং সংরক্ষণের জন্য সিটি করপোরেশন একটি মেগা প্রকল্প করে অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে।
বরিশাল সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, নগরীর খালগুলো খনন, তীর সংরক্ষণ ও সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য দুই হাজার ৬৫০ কোটি টাকার একটি বড় প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। মাসখানেক আগে এর প্রস্তাব স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। প্রস্তাবিত ওই প্রকল্প অনুমোদন এবং অর্থ বরাদ্দ পেলেই নগরীর খালগুলোর হারানো চেহারা আবার ফিরে পাবে।