সাব্বির আলম বাবুঃ
ভোলা জেলা সহ বাংলাদেশের দক্ষিনাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকার বেশীর ভাগ অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত মানুষের পেশাই মাছ ধরা বা জেলে পেশা। ছোট বড় নদী ও সাগরের জলবেষ্টিত বিধায় এ পেশার আধিক্যের মূল কারণ। বর্ষা ঋতু আসার আগেই জেলেদের জীবিকা নির্বাহের প্রধান উপকরন নৌকা ও জাল তৈরীর ধুম পড়ে যায়। গ্রাম বাংলায় একটি কথা প্রচলিত আছে যে,’টাকার নাও পানি থুইয়া রাস্তা দিয়া যায়’। অপর দিকে দেশের উপকূলীয় এলাকার অভ্যন্তরীন বিস্তৃত নৌ-যোগাযোগের মাধ্যমও নৌকা। ছোট বড় সাইজের নৌকায় ইন্জিন বা মোটর লাগিয়ে যাত্রীরা নদী পার হয়। একে ট্রলারও বলে। আবার নৌকা তৈরীর পেশাক অবলম্বন করে পরিবারের যাবতীয় খরচ মেটাচ্ছেন শত শত শ্রমিক বা কারিগর বা মিস্ত্রি। এরা বংশানুক্রমিক এই নৌকা তৈরীর পেশার সাথে জড়িত। ভোলা জেলার গজারিয়া, চরফ্যাশন, মনপুরায় বর্ষা মৌসুমে প্রতিদিন নৌকার হাটে বেচাকেনা হয় মিস্ত্রিদের বানানো এসব নৌকা। নদী মাতৃক বাংলাদেশের দক্ষিনাঞ্চলের প্রায় পুরোটা এলাকাই নদী দিয়ে ঘেরা। প্রবাহিত নদীর পলি বিধৌত এই এলাকা মূলত একটি ব-দ্বীপ। এখানকার মাটি যেমন উর্বর তেমনি নদ-নদী গুলোতে রকমারি দেশী মাছের সমারোহ। মেঘনা-তেঁতুলিয়া-শাহবাজপুর নদী ঘেরা এই অঞ্চলে নৌকা হাটে দেখা যায় নৌকা মিস্ত্রিদের বানানো সারি সারি নৌকা সাজিয়ে রাখা। যুগ যুগ ধরে চলে আসা এই ব্যবসা এলাকা বাসীর কাছে অন্যতম একটি ঐতিহ্য। নয়নাভিরাম নৌকার সাজানো পসরা চোখে না দেখলে মনেই হবে না জলে -ডাঙায় এক সঙ্গে এতো নৌকার সমারোহ থাকতে পারে। এখানকার শত শত পরিবার কয়েক যুগ ধরে বংশপরম্পরায় লগী-বৈঠা-নৌকা তৈরি ও বিক্রি করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উপকূলীয় নদ-নদী বেস্টিত নির্দিষ্ট এলাকা জুড়ে গড়ে উঠেছে নৌকার সামরাজ্য। নৌকা তৈরীর কারিগর জোতিষ মন্ডল জানান, বংশপরম্পরায় তিনি এ পেশার সাথে জড়িত। বিভিন্ন এলাকা থেকে ক্রেতারা নৌকার হাটে এসে নৌকা কিনে। অনেকে আবার শুধু নৌকার নয়নাভিরাম সৌন্দর্য দেখার জন্য দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসে। এক সময় তারা এসব নৌকা তৈরী করতে সুন্দরী কাঠ ব্যবহার করতেন। কিন্তু বর্তমানে কাঠ, কাঁচামাল আর কারিগর স্বল্পতায় রেইনট্রি, মেহগনি, আম, আমড়া সহ বিভন্ন গাছের কাঠ দিয়ে নৌকা তৈরী করেন। প্রকারভেদে ছোট নৌকা ১০০০/ ৩০০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। তবে উপকূলীয় অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা যেহেতু নৌকায় করে খাল বা নদীতে ব্যবসা-বানিজ্য বা যাতায়াত করে সেহেতু এখানে ডিঙ্গি বা বড় নৌকার চাহিদা বেশী। আরেক নৌকার মিস্ত্রি নারায়ণ দাস জানান, ১৮ হাত লম্বা নৌকা তৈরী করতে ৮ জন মিস্ত্রি লাগে। বাজারে এর দাম হয় ১৬ থেকে ২০ হাজার টাকা। এই মিস্ত্রিদের দৈনিক মুজুরী ৪০০/৫০০ টাকা। ছোট একটি নৌকা তৈরী করতে দুইজন মিস্তিরির সময় লাগে তিন দিন এবং এটি বিক্রি করে লাভ হয় ১০০০/১২০০ টাকা। এসকল নৌকা তৈরীর কারখানায় সর্বোচ্চ ২৮ হাত পর্যন্ত লম্বা নৌকা তৈরী হয় যার বাজার মূল্য প্রায় লক্ষাধিক টাকা। অপর দিকে যদি কোন নৌকায় আলকাতরা, গাব ও আলপনার কারুকাজ থাকে সে নৌকার দাম কয়েক গুন বেড়ে যায়। নৌকা বিক্রির সময় সঙ্গে বৈঠা দেয়া হয় না। সেটি আলাদা কিনতে হয়। যার দাম ২০০/২৫০ টাকা পর্যন্ত। নৌকা বেপারী কালাম জানান, জৈষ্ঠ থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত নৌকার হাটে বেচাকেনা বেশি হয়। কিন্তু প্রয়োজনীয় কাঠ, কাঁচামাল ও মিস্তিরি সংকট ও গ্রামাঞ্চলে বর্তমানে আধুনিক নৌযান যেমন স্পিড বোট, লঞ্চ, ওয়াটার বাস ইত্যাদির আধিক্যের কারনে তারা ভালো ব্যবসা করতে পারছেন না।