ডা. সাবিরা হত্যা স্বামীকে সন্দেহ করার ২৫ কারণ, খুন তবু রহস্যময়
প্রকাশ: ২৩ অক্টোবর, ২০২২, ৩:৫৭ অপরাহ্ণ |
অনলাইন সংস্করণ
বকুল আহমেদ : রাজধানীর কলাবাগানে চিকিৎসক কাজী সাবিরা রহমান লিপি হত্যারহস্যের এখনও কিনারা হয়নি। তবে ঘনিষ্ঠজনদের কেউ এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে সন্দেহ করছেন তদন্ত-সংশ্নিষ্টরা। সন্দেহের এ তালিকার পুরোভাগে রয়েছেন ডা. সাবিরার স্বামী এ কে সামছুদ্দিন আজাদ। তাঁকে সন্দেহ করার মতো অন্তত ২৫ কারণ খুঁজে পেয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। আজাদকে গ্রেপ্তার করা হলেও এখন জামিনে আছেন।
তদন্ত-সংশ্নিষ্টরা বলছেন, সংসারে সুখ ছিল না সাবিরার। বিয়ের পর জানতে পারেন, দ্বিতীয় স্বামী আজাদ আগে আরও দুটি বিয়ে করলেও একটি তাঁর কাছে গোপন করেছিলেন। এটি তাঁর সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে- এমনটিই মনে করতেন ওই চিকিৎসক। বিষয়টি জানাজানির পর পারিবারিকভাবে বিবাহবিচ্ছেদের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল। যেদিন কলাবাগানের ভাড়া বাসায় সাবিরার লাশ উদ্ধার হয়, সেদিন সেই ঘর থেকে ৩০০ টাকা মূল্যের নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে লেখা তালাকনামা জব্দ করেছিল পুলিশ। সেটি ২০১৬ সালের ২২ মার্চের। সেই তালাকনামা ঘিরে রহস্য এখনও রয়েই গেছে। বিচ্ছেদের জন্য সাবিরা সেটি প্রস্তুত করিয়েছিলেন বলে তদন্ত-সংশ্নিষ্টরা জানতে পেরেছেন।
গত বছরের ৩১ মে সকালে কলাবাগানের প্রথম লেনের ৫০/১ নম্বর ভবনের তৃতীয়তলা থেকে সাবিরার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। লাশ ছিল ৭৫ শতাংশ দগ্ধ। গলা কেটে হত্যার পর লাশে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ওই ফ্ল্যাটের একটি কক্ষে তিনি একা থাকতেন। অন্য দুটি কক্ষ দুই তরুণীকে সাবলেট দিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে সেদিন কানিজ সুবর্ণা নামে এক তরুণী বাসায় ছিলেন। আরেক তরুণী ঘটনার বেশ কিছুদিন আগেই গ্রামের বাড়ি যান।
সাবিরা হত্যার ঘটনায় তাঁর মামাতো ভাই রেজাউল হাসান মজুমদার জুয়েল বাদী হয়ে কলাবাগান থানায় অচেনা কয়েকজনকে আসামি করে মামলা করেন। প্রথমে মামলাটি কাগজে-কলমে থানা পুলিশ তদন্ত করলেও র্যাব ও পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট আলাদাভাবে ছায়াতদন্ত শুরু করে। হত্যারহস্যের গতি করতে না পেরে গত বছরের ২৩ আগস্ট মামলা তদন্তের জন্য পিবিআইকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
তদন্ত-সংশ্নিষ্টরা জানিয়েছেন, এতটাই চতুরতার সঙ্গে খুন করা হয়েছে, ঘাতকরা কোনো চিহ্ন রাখেনি। যে কারণে একটু সময় লাগছে। তদন্তে নেমে সন্দেহ হওয়ায় গত ১৯ এপ্রিল স্বামী আজাদকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ড নিয়ে তিন দিন জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তবে তিনি হত্যায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেননি। নানাভাবে এড়িয়ে গেছেন।
তদন্ত যে পর্যায়ে :মামলাটি তদন্ত করছেন পিবিআই ঢাকা মহানগর উত্তরের পরিদর্শক জুয়েল দেওয়ান। তদন্তে নানা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন তিনি। এ পর্যন্ত অন্তত ৩৫ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেন- বাড়ির মালিক, দারোয়ান, কেয়ারটেকার, সাবলেটের ভাড়াটে কানিজ সুবর্ণা, সাবিরার বান্ধবী, ছেলেমেয়ে, ছেলের বন্ধু, তাঁর কর্মস্থল গ্রিন লাইফ হাসপাতালের সহকর্মী, গৃহপরিচারিকা, আজাদের ব্যক্তিগত গাড়িচালক, আত্মীয়স্বজন এবং আগুনের খবর শুনে আসা ফায়ার সার্ভিসের ৫ কর্মীকে। এ ছাড়া ৮টি মোবাইলের ফরেনসিক প্রতিবেদন পরীক্ষা করা হয়েছে। সাবিরার ছেলেমেয়ে, বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়স্বজনের মোবাইল নম্বরের সিডিআর পর্যালোচনা করেছেন তদন্ত-সংশ্নিষ্টরা। এতে হত্যারহস্য উদ্ঘাটনের মতো কিছুই পাওয়া যায়নি।
কানিজ সুবর্ণা তদন্ত-সংশ্নিষ্টদের বলেছেন, ঘটনার আগের রাতে বাসায় ফিরে দেখেন, সাবিরার কক্ষ ভেতর থেকে আটকানো। রাত সাড়ে ১০টার দিকে উত্তেজিত সুরে ফোনে কারও সঙ্গে কথা বলতে শোনেন সুবর্ণা। ফোনে তুমুল ঝগড়া হচ্ছিল। অবশ্য সাবিরার ফোনের ফরেনসিক প্রতিবেদনে সে তথ্য উঠে এসেছে। ওই রাতে প্রায় ২৬ মিনিট মেসেঞ্জারে স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া হয়।
স্বামী ও সাবিরার সম্পদের হিসাবসহ অর্থনৈতিক-সংক্রান্ত তথ্যও সংগ্রহ করেছেন তদন্ত-সংশ্নিষ্টরা। ওই চিকিৎসকের সঙ্গে কারও শত্রুতা ছিল কিনা, সেটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সন্দেহজনক বিভিন্নজনের মোবাইল ফোন বিশ্নেষণ করা হয়েছে। তদন্ত-সংশ্নিষ্টরা জানতে পেরেছেন, আজাদের ব্যক্তিগত গাড়িচালক সাইফুলের বাসা মালিবাগ এলাকায়। তিনি কখনও শান্তিনগরের আজাদের বাসায় রাত কাটাননি। অথচ ৩০ মে রাত দেড়টার দিকে সাইফুল আজাদের বাসায় গিয়ে রাত কাটান। ভোর ৪টা থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত সাইফুল ও আজাদের ফোন বন্ধ ছিল।
এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের মুখে আজাদ তদন্ত-সংশ্নিষ্টদের কাছে দাবি করেন, তিনি ও চালক ফোন বন্ধ করে ঘুমিয়েছিলেন। সকাল ১০টার পর ফোন খুলেই সাবিরার মৃত্যুর খবর পান তিনি। ওই রাতে সাইফুল মালিকের বাসায় থাকার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন তদন্ত-সংশ্নিষ্টরা। এরই মধ্যে আজাদ তাঁকে চাকরিচ্যুত করেছেন। তদন্ত-সংশ্নিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে সাবিরার মৃত্যুর নির্দিষ্ট সময় জানা যায়নি।
মামলার তদারক কর্মকর্তা পিবিআই ঢাকা মহানগর উত্তরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কুতুবুর রহমান বলেন, গুরুত্বসহকারে মামলাটির তদন্ত ও রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা চলছে।
পেছনের কথা :এ কে সামছুদ্দিন আজাদ ব্যাংকার ছিলেন। সাবিরাকে বিয়ে করার আগে তাঁর দুই বিয়ে আছে। দুই সংসারে দুটি মেয়ে রয়েছে তাঁর। এক মেয়ের বিয়ে হয়েছে। আরেক মেয়েকে নিয়ে রাজধানীর শান্তিনগরে নিজের ফ্ল্যাটে থাকেন। সাবিরার মায়ের বাসা কলাবাগান এলাকায়। ২০০৩ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় সাবিরার চিকিৎসক স্বামী মারা যান। সেই সংসারে তাঁর এক ছেলে আছে। ২০০৫ সালে আজাদকে বিয়ে করেন তিনি। অবশ্য সাবিরাকে বিয়ের সময় আজাদ বলেছিলেন, এটি তাঁর দ্বিতীয় বিয়ে। তবে বছরখানেকের মধ্যে সাবিরা জানতে পারেন আজাদের তৃতীয় স্ত্রী তিনি। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে শুরু হয় বিরোধ। এদিকে আজাদের আগের পক্ষের মেয়ে মিথিলা মা হিসেবে মেনে নেয়নি সাবিরাকে। কিছুদিনের মাথায় তিনি শান্তিনগরে স্বামীর বাসা থেকে চলে আসেন কলাবাগানে মায়ের বাসায়। আর স্বামীর বাসায় যাননি তিনি।
তদন্ত-সংশ্নিষ্টরা জানতে পেরেছেন, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক না থাকলেও মাঝেমধ্যে দেখা-সাক্ষাৎ হতো তাঁদের। তাঁদের সংসারে নুসাইবা আনবার নামে এক মেয়ে রয়েছে। নুসাইবার নামে ফ্ল্যাট কিনে দেওয়ার জন্য স্বামীকে বলতেন সাবিরা। এ নিয়েও দ্বন্দ্ব ছিল তাঁদের।
সন্তানদের রেখে আলাদা বাসায় সাবিরা : নুসাইবা ও আগের পক্ষের ছেলে আহম্মেদ তাজওয়ারকে কলাবাগানে নানির কাছে রেখে তাদের মা সাবিরা ২০২০ সালে কলাবাগানেই আলাদা একটি ভাড়া বাসায় ওঠেন। সেখানে বছরখানেক থাকার পর একই এলাকার প্রথম লেনের ৫০/১ নম্বর ভবনের তৃতীয়তলার ফ্ল্যাট ভাড়া নেন।