ট্রেনের তেল চুরি করে কোটিপতি, ভাইয়ের দাপটে বেপরোয়া আনোয়ার
প্রকাশ: ১২ জানুয়ারি, ২০২৩, ১২:৪৭ অপরাহ্ণ |
অনলাইন সংস্করণ
শাহীন রহমান, পাবনা ||
বড় ভাই কামাল উদ্দিন ঈশ্বরদী পৌরসভার এক নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এবং একই ওয়ার্ডের যুবলীগ সভাপতি। আর সেই দাপটেই এক সময়ের তালিকাভুক্ত ট্রেনের তেল চোর খ্যাত আনোয়ার উদ্দিনের এতো দাপট যে, সে কথায় কথায় পকেট থেকে পিস্তল বের করে প্রকাশ্যে প্রাণনাশের হুমকি দেন। এমনকি গুলি করে প্রাণ কেড়ে নিতেও দ্বিধাবোধ করেন না।
সম্প্রতি তুচ্ছ ঘটনায় প্রকাশ্যে গুলি করে মামুন নামের এক রিকশাচালককে হত্যার পর আনোয়ার উদ্দিন সম্পর্কে খোঁজ নিতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে নানা অপকর্মের তথ্য।
রেলওয়ের জমি দখল করে ব্যক্তিগত অফিসসহ একাধিক বাড়ির মালিক আনোয়ার এলাকায় নিজস্ব সিন্ডিকেট তৈরি করে একদিকে যেমন ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন। তেমনি দলীয় একাধিক নেতার বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর, মারধর, হত্যাকাণ্ড, জমি দখল, মাদক ব্যবসা, জুয়ার আসর বসানোসহ এহেন কোনো অপকর্ম নেই যা আনোয়ার করেন না। কথায় কথায় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের অপমান অপদস্থ করতে দ্বিধা করেন না।
এলাকার সাধারণ মানুষের কাছেও তিনি একজন মূর্তিমান আতঙ্ক। কেউ তার ভয়ে মুখ খুলতেও সাহস পান না। ট্রেনের তেল চুরি করে আনোয়ার উদ্দিন বনে গেছেন কোটিপতি।
অভিযোগ রয়েছে, আনোয়ার অস্ত্র ও চোরাকারবারির সঙ্গেও জড়িত। বড় ভাই কামাল উদ্দিন যুবলীগের এক নম্বর ওয়ার্ড শাখার সভাপতি ও পৌরসভার কাউন্সিলর হওয়ায় তিনি এখন নিজে যুবলীগের সদস্য না হয়েও এলাকায় যুবলীগ নেতা হিসেবে পরিচিত।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, রহিমপুর এলাকায় রানা হত্যাকাণ্ডের এক নম্বর আসামি হিসেবে জেল খেটে জামিনে মুক্ত আছেন আনোয়ার। তিনি ইতোপূর্বে তেল চুরির মামলা, ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার হওয়ার মামলা, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সংঘর্ষ, মারামারি, হামলা, মাদকের একাধিক মামলার আসামি হয়ে কয়েকবার জেলও খেটেছেন। ৩-৪ বছর আগে এক নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মজিদের বাড়িতে ভাঙচুর, রানা নামের এক যুবককে কুপিয়ে আহত করার ঘটনা, সাদিপাড়ার আব্দুর রশিদকে মারধর করা, ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আতাউর রহমান আতাউরের ওপর হামলা, রহিমপুরের যুবলীগ সদস্য মনিকে মারধরের ঘটনায় অভিযুক্ত ওই সন্ত্রাসী।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, রেলওয়ের জায়গা দখল করে একাধিক অফিস তৈরি করে সেখানে রাতভর জুয়ার আসর বসিয়ে এলাকার পরিবেশ বিষিয়ে তুলেছেন আনোয়ার। এলাকার বহু মানুষ তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে।
গত বুধবার (৫ জানুয়ারি ২০২৩) তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঈশ্বরদী শহরের পশ্চিমটেংরির কড়ইতলা এলাকায় আনোয়ার উদ্দিন প্রকাশ্যে মামুন নামে অটোরিকশা চালককে গুলি করে হত্যা করেন। এরপর পর মুখ খুলতে শুরু করেছেন এলাকায় তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ দলীয় নেতাকর্মী ও এলাকাবাসী। আনোয়ারের ভয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয়রা বলেন, মাদক, সন্ত্রাস, জুয়াসহ এমন কোনো অপরাধ নেই যা আনোয়ার করে না।
এক নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রশিদ বলেন, আনোয়ার উদ্দিন ছিলেন ট্রেনের পেশাদার ও তালিকাভুক্ত তেল চোর। ঈশ্বরদী লোকোমোটিভ সেড থেকে তেল চুরিই ছিলো যার পেশা। তেলচুরির টাকায় কোটিপতি বনে গেছেন। আর সেইসঙ্গে তার বড় ভাই কামাল উদ্দিন পৌরসভার কাউন্সিলর ও ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি হওয়ার পর থেকে আনোয়ার এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। ভাইয়ের ক্ষমতার দাপটে রেলের জায়গা দখল ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপের হোতা বনে যান তিনি। এখন এলাকায় তার ভয়ে কেউ কোনো কথা বলতে চায় না।
এক নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মজিদ বলেন, আমার ভাগ্নে রানাকে তুচ্ছ কথায় কুপিয়ে আহত করা ছাড়াও, ওই আনোয়ার আমার বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও গুলিবর্ষণ করে ত্রাস সৃষ্টি করেছিল।
তিনি বলেন, আনোয়ারের ব্যবহার এতটাই উগ্র যে, তিনি কথায় কথায় অস্ত্র দেখিয়ে যাকে তাকে ভয় ভীতি দেখান।
গুলি করে মামুন হত্যা ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী পারভেজ হোসেন জানান, ওইদিন রাত ৮টার দিকে ঈশ্বরদী ইপিজেড থেকে দ্রুতগামী ভটভটি ও লেগুনা গাড়ি শহরের পশ্চিমটেংরি কড়ইতলায় থামিয়ে তাদের বেপরোয়া গতিতে চলাচলে নিষেধ করে স্থানীয় দোকানীরা। এ নিয়ে দোকানী ও অটোরিকশা চালকদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে সন্ত্রাসী আনোয়ার উদ্দিন ১০-১২ জন ক্যাডারসহ মোটরসাইকেল বহর নিয়ে ঘটনাস্থলে এসে প্রতিবাদকারীদের ওপর চড়াও হয়। এ সময় প্রকাশ্যে পকেট থেকে সবার সামনে পিস্তল বের করে মামুনকে গুলি করে হত্যা করেন।
ঈশ্বরদী পৌর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম লিটন বলেন, আনোয়ার উদ্দিন পৌর কিংবা ওয়ার্ড যুবলীগের কোনো কমিটিতে সদস্যও নয়। তার বড় ভাই কামাল উদ্দিন ওই ওয়ার্ডের যুবলীগের সভাপতি হওয়ায় সে তার ভাইয়ের দাপটে নিজেকে যুবলীগের নেতা বলে পরিচয় দিয়ে থাকতে পারেন।
আনোয়ার উদ্দিন গত ৫ জানুয়ারি হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর থেকে পলাতক রয়েছেন। তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনও বন্ধ। এ কারণে তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
তবে এসব বিষয়ে তার স্ত্রী বিচিত্রা পারভিন বলেন, উল্লেখিত অভিযোগ সম্পর্কে আমি কিছু জানি না। আমার স্বামীকে ফাঁসাতে স্থানীয় প্রতিপক্ষের লোকজন তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করেছে, এসব ষড়যন্ত্র।
এদিকে স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রকাশ্যে অনেক মানুষের সামনে গুলি করে একজন মানুষকে হত্যা করলেও পুলিশ এখনো কেন তাকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে তার অবস্থান চিহ্নিত করে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন নিহত মামুনের পরিবারের সদস্যরা।
তবে মামুন হত্যা মামলার প্রধান আসামি আনোয়ার উদ্দিনের বড় ভাই কামাল উদ্দিন ও তার ভাতিজা হৃদয় হোসেনকে গত ৬ জানুয়ারি গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
ঈশ্বরদী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) অরবিন্দ সরকার বলেন, ঘটনার পরপরই অভিযুক্ত আনোয়ারকে গ্রেপ্তার করতে পুলিশ অভিযানে নেমেছে। তদন্তের স্বার্থে সব কথা এখনই বলা যাচ্ছে না। তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে তার মোবাইল ট্র্যাক করে অবস্থান নিশ্চিত হলেই আমরা অল্প সময়ের মধ্যে তাকে গ্রেপ্তার করতে পারবো বলে আশা করছি।