* গ্রেফতার হলেও জামিনে বেরিয়েই পুরনো কাজে ফিরছে চক্রের সদস্যরা.
* ফ্ল্যাট ভাড়া করে তৈরি করা হয় কোটি কোটি টাকার জালনোট.
ইকবাল হাসান ফরিদ :
জাল টাকার কারবারিরা বেপরোয়া। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এরা সক্রিয় রয়েছে। অভিজাত ধানমণ্ডি এলাকাসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে গোপনে চলছে জাল টাকা তৈরির কর্মযজ্ঞ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এ পর্যন্ত তিন ধরনের জাল নোটের খোঁজ পেয়েছে। এর মধ্যে কদর বেশি ‘ওয়াশ নোটের’।
আসল ১০০ টাকার নোট দিয়ে ‘ওয়াশ নোট’ নামের ৫০০ টাকার জাল নোট তৈরি হচ্ছে শুধুই প্রিন্টারের ‘কল্যাণে’। বিভিন্ন সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এদের গ্রেফতার করলেও জামিনে বেরিয়েই পুরনো কাজে ফিরে যাচ্ছে চক্রের সদস্যরা।
পুলিশ বলছে, জাল টাকার কারবারিদের নির্মূলে সাধারণ নাগরিকদেরও এগিয়ে আসতে হবে।
ফরিদপুরের সাইফুল ইসলাম ৫ বছর আগে রাজধানীর অভিজাত ধানমণ্ডি এলাকায় ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে গড়ে তোলেন ‘টাকশাল’। কোনো রকম বাধাবিঘ্ন ছাড়াই তিনি কোটি কোটি টাকার জাল নোট তৈরি করছিলেন।
সম্প্রতি কদমতলী থেকে দুই লাখ টাকার জাল নোটসহ শাহ আলমকে গ্রেফতারের পরই সাইফুলের নাম সামনে চলে আসে। পরে র্যাব-১০-এর সদস্যরা ধানমণ্ডির ৭/এ সড়কের একটি ফ্ল্যাটে অভিযান চালিয়ে এই ‘টাকশাল’-এর সন্ধান পায়। তৃতীয় তলার ওই ফ্ল্যাট থেকে কোটি টাকার বেশি জাল নোটসহ সাইফুলকে আটক করা হয়। ২০১৫ সাল থেকে এই ফ্ল্যাটে তৈরি হচ্ছিল জাল টাকার নোট।
জানতে চাইলে র্যাব-১০-এর উপ-অধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমান বলেন, ফ্ল্যাট থেকে কোটি টাকার বেশি মূল্যের ৫০০ ও ১০০০ টাকার জাল নোট উদ্ধার করা হয়েছে। এ সময় জাল টাকা তৈরির ডায়াস, কাগজ, প্রিন্টার, কেমিক্যালসহ বিভিন্ন উপাদান জব্দ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে সাইফুল জানিয়েছে, সে ২০ বছর ধরে জাল টাকা তৈরির কাজে নিয়োজিত। এ ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে রাজধানীর কদমতলীর রাজবাড়ি, ডেমরার বাঁশের পুল ফরমান খাঁ মার্কেট এলাকায় অভিযান চালিয়ে জাল টাকার কারখানার সন্ধান পাওয়া যায়।
এ ছাড়া রামপুরা, মোহাম্মদপুর, কেরানীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় জাল নোটের কারখানায় অভিযান চালিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। রীতিমতো বেপরোয়া হয়ে উঠছে জাল মুদ্রার কারিগররা। একটি সংঘবদ্ধ চক্র নিয়ন্ত্রণ করছে অন্তত অর্ধশতাধিক গ্রুপ। এর বাইরে আছে আরও অর্ধশতাধিক জাল টাকার ডিলার। প্রত্যেক ডিলারের সঙ্গে কমপক্ষে পাঁচ-ছয়জন বাজারজাতকারী রয়েছে। এসব কারখানায় ভারতীয় রুপিসহ বিভিন্ন দেশের জাল মুদ্রা তৈরি হচ্ছে। ছড়িয়ে পড়ছে দেশ-বিদেশে।
গোয়েন্দা সূত্র বলছে, রাজধানীসহ সারা দেশে অর্ধশতাধিক গ্রুপ জাল টাকা তৈরি এবং বিপণনে জড়িত। প্রতিটি উৎসবের আগে জাল নোট তৈরির চক্রগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে। ভেজাল টাকা নিখুঁত করার ব্যাপারে প্রতিযোগিতাও চলে। যেই চক্রের টাকা যত নিখুঁত, দামও তত বেশি।
জাল টাকা তৈরি ও বিপণনের কাজে জড়িত চক্রের সদস্যরা ৩ ভাগে বিভক্ত। একটি গ্রুপ অর্ডার অনুযায়ী জাল নোট তৈরি করে, অপর গ্রুপ টাকার বান্ডিল পৌঁছে দেয়, আরেক গ্রুপ এসব টাকা বাজারে ছড়িয়ে দেয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এ পর্যন্ত তিন ধরনের জাল নোটের অস্তিত্ব মিলেছে। এর মধ্যে ‘ওয়াশ নোট’ নামের জাল নোটের কদর সবচেয়ে বেশি। আসল ১০০ টাকার নোট দিয়ে এটি তৈরি করা হয়। ১০০ টাকার নোট প্রথমে রাসায়নিক দিয়ে সাদা করা হয় এবং পরে প্রিন্টারের মাধ্যমে ৫০০ টাকার নোট জাল নোট বের করা হয়। এক লাখ টাকা মূল্যমানের এই ‘ওয়াশ নোট’ বিক্রি হয় ৪০-৫০ হাজার টাকা।
এ ছাড়া আর্ট পেপারে তৈরি জাল ১০০টি এক হাজার টাকার নোট বিক্রি হয় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। তৃতীয়ত, খসখসে কাগজে তৈরি এক লাখ টাকা মূল্যমানের ১ হাজার টাকার জাল নোট ২৫-৩০ হাজার টাকা বিক্রি করা হয়।
সূত্র বলছে, জাল টাকা তৈরির কারিগরদের মধ্যে সগির, কামাল, হুমায়ূন কবির, কাওসার, মাহবুব মোল্লা, আলাউদ্দীন, বাবু, লিয়াকত হোসেন জাকির, রহিম বাদশা ছাড়াও অন্তত ২০ জন রাজধানীতে সক্রিয় আছে। এরা বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার হলেও পরে ছাড়া পেয়ে আবার পুরনো ‘পেশায়’ নামে।
এই চক্রের অন্যতম হোতা হুমায়ূন কবির। তিনি পুলিশ কনস্টেবল পদে চাকরি করতেন। নানা অপরাধের কারণে ২০০৩ সালে তাকে চাকরিচ্যুত করার পর রাজশাহী এলাকার একটি জাল নোট চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। ২০১৭ সাল পর্যন্ত ৪ বছরে হুমায়ূন কবির পুলিশ, র্যাব ও ডিবির হাতে ৫ বার গ্রেফতার হন। জামিনে বের হয়েই আবার পুরনো পেশায় ফেরেন। ৮-১০ জনের একটি দল নিয়ন্ত্রণ করছে হুমায়ূন কবির।
পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি আবুল কালাম আজাদ বলেন, জাল নোট কারবারিরা দেশের অর্থনীতির জন্য অভিশাপ। তাদেরকে রুখতে হলে সবাইকে সচেতন হতে হবে। এ ছাড়া আইনের ফাঁকফোকরে যাতে তারা কারাগার থেকে না বেরোতে পারে সে দিকে নজর দেয়া জরুরি। এ ব্যাপারে আইনজীবীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন পুলিশের এ কর্মকর্তা।
এদিকে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার বলেন, শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানেই জাল টাকার কারবারিদের রোখা সম্ভব নয়। জনগণকেও সচেতন হতে হবে। বিশেষ করে বাড়ির মালিককেও ভাড়াটিয়া সম্পর্কে জেনেশুনে ফ্ল্যাট ভাড়া দিতে হবে। তাছাড়া পাশের ভাড়াটিয়ার এখানে ভূমিকা আছে। তাদেরও সচেতন হতে হবে। সবার সচেতনতাই পারে জাল টাকার কারবারিদের রুখতে।