সোমবার ৭ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ ২৩শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
ই-পেপার   সোমবার ৭ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ



খুলনায় বঙ্গবন্ধুর ‘দাওয়াল’- আন্দোলন
প্রকাশ: ১৯ মার্চ, ২০২১, ১১:১৮ অপরাহ্ণ |
অনলাইন সংস্করণ

খুলনায় বঙ্গবন্ধুর ‘দাওয়াল’- আন্দোলন

অরবন্দি মৃধা
কৃষিনির্ভর বাংলাদেশে সাধারণ দরীদ্র পরিবারের অতীতে জীবীকা নির্বাহের প্রধান অবলম্বন ছিল কৃষিজ সম্পৃক্ত কাজ যেমন, বর্ষা মৌসুমে ধান, পাট ও অন্যান্য ফসল উৎপাদনের জন্য লাঙ্গল জোয়াল এর সাহায্যে গরু মহিষ দ্বারা হালচাষ, ধান রোপন এবং পরে পাকা ধান দাওয়াল দ্বারা কেটে ঘরে তোলা। তখন জমি ছিল এক ফসলি, প্রকৃতি নির্ভর। ফলে বন্যা খরা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে খাদ্য সংকটে মানুষ না খেয়ে মরতো। জীবন জীবীকার জন্য এক অঞ্চল বা জেলার মানুষ অন্য অঞ্চলে বা জেলায় যেতে বাধ্য হতো। চলাচল এবং মালামাল পরিবহনের মাধ্যম ছিল ছোট, বড় ও মাঝারি সাইজের নৌকো। বলা যায় ১৯৮০ এর দশক পর্যন্ত দেশে এই অবস্থা ছিল। বাংলাদেশের পলল উর্বরা ভূমির সর্বত্রই প্রধান ফসল ছিল ধান। খুলনা, বরিশাল, সিলেট সহ বৃহত্তর কয়েকটি জেলার তখন বেশি ধান চাষ হতো। শীত মৌসুমে জমি থেকে ধান কেটে যাঁরা চাষির বা গৃহন্তের ধান গোলাজাত করে দেয় তাদেরকে বলা হয় ‘দাওয়াল’। ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ অঞ্চলের দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের একটি অংশ খুলনা বরিশাল জেলায় ‘দাওয়াল’ হয়ে নৌকো যোগে ধান কাটতে যেতো। অনুরূপ ভাবে কুমিল্লা অঞ্চলের শ্রমজীবীগণ সিলেট অঞ্চলে ধান কাটতে যেতো।

১৯৪৭ খ্রিঃ ভারত ভাগের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে খাদ্য সংকট দেখা দেয়, বিশেষ করে ঢাকা ফরিদপুর কুমিল্লা অঞ্চলে। ১৯৪৮ এর শেষ বা ১৯৪৯ এর প্রথম দিকে সরকার ‘কর্ডন প্রথা’ চালু করে। এর অর্থ এক জেলা থেকে অন্য জেলায় কোন খাদ্যশষ্য যেতে দেয়া হবে না। ঢাকা ফরিদপুর জেলার দিনমজুর শ্রেণীর মানুষ দল বেঁধে নৌকো যোগে বরিশাল খুলনা জেলায় শীত মৌসুমে ধান কাটতে যেতো। মহাজনের ধান কেটে গুছিয়ে দেয়ার মজুরী হিসেবে ধানের একটি অংশ তারা নিয়ে আসতো পরিবার পরিজন নিয়ে খেয়ে পরে বেঁচে থাকার জন্য। এই কাজে যাওয়ার বেলায় অনেকে মহাজনের নিকট থেকে ধারদেনা করে, অনেকে নৌকো ভাড়া নিয়ে এই দাওয়ালের কাজ করতো। দাওয়ালদের এই কাজ বহু বছর পূর্ব থেকে চলে আসছিল কেউ বাধা দিতো না। কিন্তু ‘কর্ডন প্রথা’ হঠাৎ করে চালু করায় ওই বছর (১৯৪৯ খ্রিঃ) দাওয়াল এবং ধান ব্যবসায়ীরা ধান আনতে বিপাকে পড়ে যায়। ঘোষণা দেয়া হয়, ‘দাওয়ালের প্রাপ্য অংশের ধান খাদ্য গুদামে, সংশ্লিষ্ট জেলায় জমা রেখে সরকারের দায়িত্বপূর্ণ কোন ব্যক্তির/প্রতিষ্ঠানের নিকট থেকে স্লিপ বা রশিদ নিয়ে নিজ জেলার গুদাম থেকে সেই ধান নিতে হবে।’ কিন্তু বাস্তবে হাতে লেখা স্লিপ ধরিয়ে দিয়ে দাওয়ালদের ধান রেখে ছেড়ে দেয়া হয়। তারা নিজ এলাকায় গিয়ে স্লিপ বা রশিদ দেখিয়ে খাদ্যগুদাম থেকে ধান পায়না। যারা কিছু ধরিয়ে দিয়ে যোগাযোগ করতে পেরেছে তারা যৎকিঞ্চিৎ পেয়েছিল। এই মৌসুমে ফরিদপুরের অনেক ব্যবসায়ী খুলনা থেকে ধান কিনে নিজ এলাকায় নিয়ে যেতেন। এই জাতীয় ব্যবসায়ীদের প্রায় দুই শতাধিক নৌকো ধান সহ খুলনায় ‘কর্ডন আইনে’ আটক করা হয়। গরীব, নিরীহ শ্রমজীবী মানুষের প্রতি এই অবিচার ও অন্যায়ের কথা শুনে জন দরদী ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়ান। তাদের ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য ঢাকায় এর বিরুদ্ধে মিছিল মিটিং করে আন্দোলন গড়ে তোলেন। তিনি একাই খুলনায় এসে দাওয়ালদের সাথে নিয়ে আন্দোলন করেন, তিনি উল্লেখ করেছে, ‘এ খবর শুনে আমার পক্ষে চুপ করে থাকা সম্ভব হল না। আমি এর তীব্র প্রতিবাদ করলাম। সভা করলাম, সরকারী কর্মচারীদের সাথে সাক্ষাৎও করলাম কিন্তু কোন ফল হল না। … অনেক সভা সমিতি অনেক প্রস্তাব করলাম কোন ফল হলো না। এই লোকগুলি দিনমজুর দুই মাস পর্যন্ত যে শ্রম দিল, তার মজুরী তাদের মিলল না আর মহাজনদের কাছ থেকে যে টাকা ধারে করে এনেছিল এই দুই মাসের খরচের জন্য, খালি হাতে ফিরে যাওয়ার পরে দেনার দায়ে ভিটাবাড়ীও ছাড়তে হলো। এ রকম শত শত ঘটনা আমার জানা আছে। এদিকে ফরিদপুর, ঢাকা ও কুমিল্লা জেলার অনেক নৌকার ব্যবসায়ী ছিল যারা বড় বড় নৌকায় করে ধান চাউল ঐ সমস্ত জেলা থেকে এনে বিক্রি করত, তাদের ব্যবসাও বন্ধ হল এবং অনেক লোক নৌকার খেটে খেত তারাও বেকার হয়ে পড়ল।… এই সময় একটা ঘটনা ঘটে গেল খুলনায়। ফরিদপুর জেলার দাওয়ালদের প্রায় দুইশত নৌকা আটক করল ধান সমেত। তারা রাতের অন্ধকারে সরকারী হুকুম না মেনে ‘আল্লাহু আকবর’ ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ ধ্বনি দিয়ে নৌকা ছেড়ে দিল ধান নিয়ে। দশ-পনের মাইল চলার পরে পুলিশ বাহিনী লঞ্চ নিয়ে তাদের ধাওয়া করে বাধা দিল, শেষ পর্যন্ত গুলি করে তাদের থামানো হলো। দাওয়ালরাও বাধা দিয়েছিল কিন্তু পারে নাই। জোর করে নদীর পাড়ে এক মাঠের ভিতর সমস্ত ধান নামানো হয়েছিল এবং লোকদের তাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল।… আমি খবর পেয়ে খুলনায় এলাম, তখনও অনেক নৌকা আটক রয়েছে ধান সহ। এই সময় দাওয়ালদের নিয়ে সভা করে জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেবের বাড়িতে শোভাযাত্রা সহকারে উপস্থিত হলাম (খুলনা)। জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট ছিলেন প্রফেসর মুনীর চৌধুরীর বাবা জনাব আব্দুল হালিম চৌধুরী তিনি আমার সাথে আলাপ করলেন এবং বললেন, তাঁর কিছুই করার নাই সরকারের হুকুম। তবে তিনি ওয়াদা করলেন, সরকারের কাছে টেলিগ্রাম করবেন সমস্ত অবস্থা জানিয়ে। আমি দাওয়ালদের নিয়ে ফিরে আসলাম। আমি নিজেও টেলিগ্রাম করলাম। দাওয়ালদের বললাম, ভবিষ্যতে যেন তারা এভাবে আর ধান কাটতে না আসে; একটা বোঝাপড়া না হওয়া পর্যন্ত।’ (তথ্যসূত্র: অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান, পৃষ্ঠা নং- ১০৩, ১০৪ ও ১০৫)। ইনিই স্বাধীনতার স্থপতি বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি এই ভাবেই গরীব দুঃখি অসহায় নির্যাতিত নিপীড়িত সাধারণ মানুষের বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন, মনের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন।




এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত

প্রধান উপদেষ্টা : প্রফেসর শাহ্ সাজেদা ।

উপদেষ্টা সম্পাদক : সৈয়দ এহছান আলী রনি ।

সম্পাদক ও প্রকাশক : মামুনুর রশীদ নোমানী ।

যোগাযোগ: আদালত পাড়া সদর রোড,বরিশাল।

ইমেইল: nomanibsl@gmail.com

মোবাইল: 01713799669/01711358963

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি।
© বরিশাল খবর সম্পাদক মামুনুর রশীদ নোমানী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

  নলছিটির মগড় ইউনিয়নবাসীর সেবা করতে চান মোঃ সাইফুজ্জামান সুমন তালুকদার   প্রাণ ফিরছে বরিশাল নগরীর ৭ খালে   বেতারের সঙ্গীত শিল্পী (পল্লীগীতি) হিসেবে মনোনীত হলেন অ্যাড: জুয়েল   বরিশালের মাহমুদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্বেচ্ছাচারী প্রধান শিক্ষিকা স্ট্যান্ড-রিলিজ !   বরিশাল ল’ কলেজে দুর্নীতি, উন্নয়নের নামে অর্থ আত্মসাৎ   অনিয়ম দুর্নীতির আতুরঘর বরিশাল বেতার : চলছে জোড়াতালি দিয়ে   বরিশাল ডাকঘরের ক্যাশিয়ার নুরুল কবিরের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ   দেড় লাখ মামলা মাথায় বিএনপির ৫০ লাখ নেতাকর্মীর   আলু শুন্য বরিশালের পাইকারী বাজার   বাংলাদেশে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাধাদানকারীদের ওপর মার্কিন ভিসানীতি শুরু   মাদারীপুরের হিমাগারে ৩০ হাজার বস্তা, বাজারে আলুর কৃত্রিম সংকট   যুদ্ধ স্যাংশন সংঘাতের পথ এড়াতে প্রধানমন্ত্রীর আহবান   Mamunur Rashid Nomani charged with violating Bangladesh’s Digital Security Act   ঝালকাঠিতে রোহিঙ্গা আটক এসেছিলো ভোটার হওয়ার জন্য   সাঈদুর রহমান রিমনকে নিয়ে দিলিপ কুচক্র মহলের ষড়যন্ত্রের জবাব!   বাবুগঞ্জে ইজিবাইক ছিনতাই চক্রের চার সদস্য আটক   নলছিটিতে ৫০তম গ্রীষ্মকালীন ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ   অপরাধ ঘটাতে আগাম ‘রেকি‘ করে গেছেন তারা!   ঝালকাঠি কারাগার: কু-প্রস্তাবের দাম দশ লাখ টাকা! জেলার বহাল তবিয়তে   রাজাপুর সাব-রেজিস্ট্রার অফিস দুর্নীতির আখড়া