এমপিওভুক্তি, বদলি, গ্রেড পাইয়ে দেওয়া- এক তুড়িতেই সমাধান! যাঁর তুড়িতে কাজ হয়, তিনি মনিরুজ্জামান। খর্বকায়, তাই সহকর্মীরা তাঁকে ডাকেন ‘পিচ্চি মনির’। বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা এই নামেই মনিরকে চেনেন। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) খুলনা অঞ্চলের উপপরিচালকের কার্যালয়ে মনিরের পদ উচ্চমান সহকারী হলেও ক্যাশিয়ারগিরি তাঁর দারুণ পছন্দ! সেই যোগসূত্রে কর্মস্থলে তিনি রীতিমতো ‘ঘুষযন্ত্র’। বাঁ হাতে টাকা উঠলে তাঁর ডান হাত নিমেষেই কাজ করে। ক্যাশিয়ার আর ঘুষের রসায়নে চুয়াডাঙ্গার ছেলে মনির এখন টাকার পাহাড়ের চূড়ায়। তবে ‘গভীর জলের মাছ’ মনির অধিকাংশ সম্পদই গড়েছেন স্ত্রী ও আত্মীয়স্বজনের নামে। সব মিলিয়ে তিনি এখন কত টাকার মালিক? সমকাল দুই মাস অনুসন্ধান চালিয়েও সেই টাকার অঙ্কের হিসাব মেলাতে পারেনি।

গাড়িতে ‘প্রেস’ সাঁটিয়ে তুলতে যান ঘুষের টাকা :গেল মার্চ ও এপ্রিল মাসে মনিরের বিষয়ে অনুসন্ধান চালায় সমকাল। সেখানে বের হয়ে আসে পিলে চমকানো সব তথ্য। জানা যায়, তিনি সাপ্তাহিক দুই ছুটির দিন খুলনা বিভাগের জেলাগুলোতে ঘুষ সংগ্রহে বের হন। মনির নিজের প্রাইভেটকার নিয়ে জেলায় জেলায় ঘোরেন, সেই গাড়ির সামনে সাঁটানো থাকে ‘প্রেস’ স্টিকার। কোথাও কোথাও নিজেকে চুয়াডাঙ্গার স্থানীয় একটি দৈনিকের সম্পাদক, আবার কখনও দেন ওই দৈনিকের সাংবাদিক পরিচয়।

কুষ্টিয়া থেকে প্রকাশিত একটি দৈনিকের সাংবাদিক, যিনি একটি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকও। তিনি এমপিওভুক্ত হতে আবেদন করলে মনির তাঁকে তিন মাস চরকির মতো ঘোরাতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত মনিরের হাতে ৫০ হাজার টাকা তুলে দিলে চক্কর থেকে মুক্তি পান। ওই শিক্ষক সমকালকে বলেন, ‘মনির একটা ঘুষযন্ত্র। প্রতিদিনই সে লাখ লাখ টাকা হাতায়।’ আরও অনেক শিক্ষক-কর্মচারী এই প্রতিবেদকের কাছে মনির ঘুষ ছাড়া কোনো কাজ করেন না বলে অভিযোগ তোলেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চুয়াডাঙ্গার একাধিক শিক্ষক বলেন, শিক্ষকদের এমপিওভুক্তি, বদলি, উচ্চতর গ্রেড করে দেওয়ার নাম করে উৎকোচ নেওয়ার কাজে মনিরকে সহয়তা করে যাচ্ছেন চুয়াডাঙ্গার স্থানীয় সাংবাদিক সাইফ জাহান, শিক্ষক আলমগীর হোসেন ও জেলা শিক্ষা অফিসের কর্মচারী মিকাইল হোসেন।

মনির ২০১৪ সাল পর্যন্ত রাজধানীর শিক্ষা ভবনে মাউশির প্রধান কার্যালয়ে স্কুল শাখায় চাকরি করেছেন। তখন বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিওভুক্তির কাজ কেন্দ্রীয়ভাবে শিক্ষা ভবন থেকেই হতো। ২০১৪ সালে তা বিকেন্দ্রীকরণ করে মাউশির ৯টি অঞ্চলে ভাগ করে দেওয়া হয়। মনির সে সময় তাঁর নিজের বিভাগ খুলনা আঞ্চলিক অফিসে পদায়ন নেন।

মনিরের রাজকীয় জীবন: চুয়াডাঙ্গা পুলিশের এমএলএসএস নুরুল ইসলামের ছেলে মনিরুজ্জামান মনিরের এক রাজকীয় জীবন। দুই স্ত্রী তাঁর, দ’জনের জন্য দুই শহরে পৃথক বাড়ি।

রাজধানী ঢাকায় মনিরের কেনা বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে আয়েশি জীবন কাটাচ্ছেন স্ত্রী রিমা। মোহাম্মদপুর শিয়া মসজিদের পাশে ১ হাজার ৭৮০ বর্গফুটের ওই ফ্ল্যাটের দাম কোটি টাকা ছাড়াবে। রাজধানীর বিভিন্ন ব্যাংকে রিমার নামে রয়েছে কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র ও এফডিআর। নিজ জেলা চুয়াডাঙ্গার মুসলিমপাড়ায় ১৪ কাঠা জমির ওপর মনিরের রয়েছে নিজস্ব একটি বাগানবাড়ি। স্থানীয়রা জানান, জমিসহ এ বাড়ির আনুমানিক দাম ৬০ লাখ টাকা। ওই জমির ১০ কাঠার মালিকানা করে রেখেছেন প্রথম স্ত্রীর বাবার নামে। বাকি চার কাঠা নিজের নামে।

মনিরের আরেক স্ত্রী সোনিয়া চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজে সহকারী হিসাবরক্ষক হিসেবে কর্মরত। চুয়াডাঙ্গা শহরের জোলের ধারে চারতলার বাড়িতে তাঁর বাস। ৬০ লাখ টাকা দামের ওই বাড়ি সোনিয়ার নামে। শহরের লিনার মোড়েও রয়েছে ৫০ লক্ষাধিক টাকা মূল্যের সম্পত্তি। মনির চুয়াডাঙ্গায় দ্বিতীয় স্ত্রীর স্বজনদের নামে একাধিক ব্যাংক হিসাব খুলেছেন। সেই হিসাবগুলোতে টাকার স্থিতি কত, সেটা নিরূপণ করা যায়নি।

চুয়াডাঙ্গা শহরে মনিরের বাড়ি  ●

 

দৈনিক পত্রিকার মালিকানা: চুয়াডাঙ্গার স্থানীয় একটি দৈনিক পত্রিকার মালিকানার শেয়ার হিসেবে ১০ লাখ টাকা মনির বিনিয়োগ করেছেন বলে একাধিক সূত্র সমকালকে নিশ্চিত করেছে। সে সুবাদেই ওই দৈনিকের কখনও সম্পাদক, কখনও সাংবাদিক বলে মনির নিজেকে জাহির করেন। তাঁর প্রাইভেটকারটি স্থানীয় ওই দৈনিকের সম্পাদক ব্যবহার করেন। তবে মনির নিজেও মাঝেমধ্যে সেটিতে চড়েন। এ ছাড়া সরকারি কর্মচারী হয়েও তিনি চুয়াডাঙ্গা প্রেস ক্লাবের দাতা সদস্যের পদ নিয়েছেন। প্রেস ক্লাবের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অর্থ সহায়তা করেন।

শুধু গণমাধ্যমে বিনিয়োগ নয়, মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে স্থানীয় এক যুবলীগ নেতার নামে মনির কেরু অ্যান্ড কোম্পানির প্রায় ১০০ বিঘা জমি ৮০ বছরের জন্য লিজ নিয়ে চাষাবাদও করছেন।

উপপরিচালককেও ‘নিয়ন্ত্রণ’ করেন মনির: ‘ক্যাশিয়ার’ হিসেবে মনিরের ঘুষকীর্তি, দুর্নীতি আর অবৈধ সম্পদের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে মাউশির খুলনা অঞ্চলের উপপরিচালক এস এম আবদুল খালেক বলেন, ‘আমার নাম করে টাকা তুলতে আমি তাঁকে বলিনি। এটা মিথ্যা কথা। আমার নাম বললে কেউ তাঁকে টাকা দেবে কেন? মনিরের কোথায় কী সম্পদ আছে, তা জানি না।’ তিনি বলেন, ‘মনিরকে আমি কী নিয়ন্ত্রণ করব! সে এতই ক্ষমতাবান, পারলে সে-ই আমাকে নিয়ন্ত্রণ করে। ‘

ঘি-মাখনওয়ালাদের খোঁজ নিতে বললেন মনির: বিপুল এই সম্পদের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে মাউশির উচ্চমান সহকারী মনিরুজ্জামান মনির সমকালকে ছোড়েন পাল্টা প্রশ্ন। বলেন, ‘আমার এত সম্পদ আছে, তাহলে আমি এই ছোট চাকরি করব কেন? আমাকে যারা হিংসা করে, তারাই এসব রটিয়ে বেড়ায়। আমার এত সম্পত্তি নেই।’

তিনি বলেন, ‘মাউশির যে অফিসে এমপিও আছে, সেখানেই বদনাম আছে। সে কারণেই আমারও আছে। আমি খুলনা ডিডি অফিসে এসেছি ২০১৯ সালে। এরপরই আমার পেছনে লোক লেগে যায়। যারা আজীবন ধরে এক জায়গায় আছে, ঘি-মাখন খাচ্ছে, তাদের কিছু বলেন না কেন আপনারা?’

ঢাকার ফ্ল্যাট, পত্রিকায় বিনিয়োগ সব অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘আমার এত টাকা-পয়সা নেই।’ সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার বিষয়ে তাঁর বক্তব্য, ১৯৯৮-৯৯ সালে তিনি দৈনিক মাথাভাঙ্গা পত্রিকার সাংবাদিক ছিলেন। ২০০৫ সালে সরকারি চাকরিতে এসে সাংবাদিকতা ছেড়ে দেন।

পারিবারিক প্রসঙ্গে কথা তুললে দুই স্ত্রী বিষয়ে বলেন, ‘প্রথম যাঁর নাম বললেন, তিনি আমার স্ত্রী। আর দ্বিতীয় যাঁর নাম বললেন, সেটা একটা দুর্ঘটনা। পরে এ বিষয়ে বলব। এখন আর কোনো কথা নয়।’