কলেজ অ্যাকাউন্ট্যান্টের হিসাবে ২৪ কোটি টাকার নেপথ্যে!
প্রকাশ: ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১০:৩৪ পূর্বাহ্ণ |
অনলাইন সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক,
বাংলায় প্রাচীন একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে ‘দুই টাকার কেরানি’। সেই প্রবাদকে ভুল প্রমাণ করেছেন রাজধানীর মাতুয়াইলে অবস্থিত ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মো. আকরাম মিয়া। তার পাঁচটি ব্যাংক হিসাবে ২৪ কোটি টাকার সন্ধান পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ইতিমধ্যে ব্যাংকের ওই পাঁচ এফডিআরে থাকা বিপুল অর্থ অবরুদ্ধ করতে আদালতের অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছে সংস্থাটি।
আদালতে ব্যাংক হিসাবগুলো অবরুদ্ধ করতে দুদকের দেওয়া চিঠিতে বলা হয়, ‘অভিযোগ-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি উক্ত টাকা নগদে উত্তোলন করে অন্যত্র স্থানান্তর করার চেষ্টা করছেন। বর্ণিত টাকা অবরুদ্ধ (ফ্রিজ) করা না হলে তা বেহাত হবার সম্ভাবনা রয়েছে। অনুসন্ধান নিষ্পত্তির পূর্বে বর্ণিত হিসাবসমূহে জমাকৃত টাকা হস্তান্তর বা স্থানান্তর হয়ে গেলে রাষ্ট্রের সমূহ ক্ষতির কারণ রয়েছে। সেহেতু উল্লিখিত ব্যাংক হিসাবসমূহ অবিলম্বে ফ্রিজ করা আবশ্যক।’
প্রশ্ন উঠেছে, কলেজের হিসাবরক্ষকের ব্যাংক হিসাবে এত টাকা কীভাবে এল? তার মাসিক বেতনই বা কত?
কলেজটি যার নামে, মাহবুবুর রহমান মোল্লা নিজেও একজন শিক্ষক। তিনি ডেমরার সামসুল হক খান স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ। নিজ উদ্যোগে ২০১০ সালে নিজের নামে কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। সেই হিসেবে কলেজ প্রতিষ্ঠার এক যুগ পূর্ণ হয়েছে। এই সময়ে একজন হিসাবরক্ষক এত টাকা কোথায় পেলেন?
মাসিক ৫০ হাজার টাকা বেতন হিসেবে ধরলেও গত বারো বছরে আকরাম মিয়া সর্বসাকুল্যে বেতনই পেয়েছেন ৭২ লাখ টাকা। খেয়ে-পরে তার লাখ পাঁচেক টাকাও থাকার কথা নয়। কিন্তু আকরাম মিয়ার নামে খোলা বেসিক ব্যাংকের মাতুয়াইল শাখার পাঁচটি হিসাবে মিলেছে ২৪ কোটি ২৯ লাখ ৮৯ হাজার ৫২৪ টাকার সন্ধান।
নিজের ব্যাংক হিসেবে থাকা এত টাকা তার নয় বলে দাবি করেন আকরাম। এ ছাড়া এককভাবে এত টাকা সরানো সম্ভব নয় বলেও দাবি কলেজটির শিক্ষকদের।
কলেজের হিসাব রক্ষকের ব্যাংক হিসাবে বিপুল পরিমাণ টাকার কথা শুনে আঁতকে উঠেছেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের বেসরকারি কলেজ শাখার সহকারী পরিচালক আব্দুল কাদের। তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, কলেজ ফান্ডের এক পয়সা ব্যক্তিগত হিসাবে কোনো অজুহাতেই রাখার সুযোগ নেই। এই বিষয়ে শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক একটি প্রজ্ঞাপনও দিয়েছেন। এটা সুস্পষ্ট আইনের লঙ্ঘন ও অনিয়ম।
ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে প্রতিষ্ঠাকাল থেকে শিক্ষকতা করছেন এমন একজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষকের সঙ্গে কথা হয় ঢাকাটাইমস প্রতিবেদকের। নিজের নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘কলেজটিতে ১০২ জন শিক্ষক আছেন, যাদের বেশির ভাগই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ। চুক্তিভিত্তিক শিক্ষকদের নামমাত্র বেতন দেওয়া হলেও তাদের নামে বেতন বেশি দেখিয়ে কলেজ ফান্ডের টাকা সরিয়ে নিয়েছেন কলেজটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা।’
ওই শিক্ষক আরো বলেন, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ঢাকায় সবচেয়ে বেশি বেতন আদায় করা হয় এই কলেজ থেকে। প্রতি মাসে ৬ হাজার শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বেতন বাবদ আয় প্রায় দেড় কোটি টাকা। কিন্তু সেই হিসেবে স্থায়ী শিক্ষক নিয়োগসহ অনেক বিষয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষ উদাসীন।
এছাড়া কলেজে উন্নয়নের নামে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে পাওয়া বিপুল অর্থের কানাকড়িও খরচ না করে আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে অভিযোগ ওই শিক্ষকের। বছরে অন্তত ৫০ কোটি টাকা টাকা আয় করলেও এর দশ ভাগের এক ভাগ টাকাও খরচ নেই কলেজে।
ওই শিক্ষক বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে চাকরি করলেও আমাদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি বিষয়ে বরাবরই উদাসীন কর্তৃপক্ষ। অন্য দিকে নিজের স্ত্রী আফরোজা রহমান লোটাকে কলেজের কো-চেয়ারম্যান পদে বসিয়ে লাখ লাখ টাকার বেতন দিচ্ছেন চেয়ারম্যান। কলেজ ফান্ডের টাকায় স্ত্রীর জন্য দেড় কোটি টাকার ল্যান্ড ক্রোজার গাড়ি কেনার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এছাড়া পরিবারের বিভিন্ন সদস্যকে কলেজের গভর্নিং বোর্ডে জায়গা করে দিয়েছেন।’
কলেজ কর্তৃপক্ষ আয়কর ফাঁকিসহ শিক্ষকদের কম বেতন দেওয়ার বিষয়টি আড়াল করতে ব্যাংক অ্যাকাউন্টের পরিবর্তে শিক্ষকদের হাতে হাতে নগদ বেতন দেওয়া হয়ে থাকে বলেও অভিযোগ রয়েছে। চাকরিচ্যুতির ভয়ে কোনো শিক্ষকই এসব বিষয়ে প্রতিবাদ করেন না বলে জানান গণিত বিভাগের একজন শিক্ষক। এছাড়া সরকারি আদেশ অমান্য করে শুক্র ও শনিবার কলেজ খোলা রাখার অভিযোগও রয়েছে কলেজ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে।
ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের হিসাবরক্ষণ বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে পাওয়া মাসিক বেতন, বই-খাতা, পোশাক-পরিচ্ছদ তৈরি ও উন্নয়ন ফি বাবদ আদায় করা টাকার বেশির ভাগই থেকে যায় কলেজের ব্যাংক হিসাবের বাইরে। আর এসব হিসাবের একটি বড় অংশই তদারক করেন মাহবুবুর রহমান মোল্লার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত আকরাম মিয়া।
এসব অভিযোগ সম্পর্কে জানতে আকরাম মিয়ার ফোন নম্বরে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান মোল্লার ব্যক্তিগত ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি সাড়া দেননি। খুদে বার্তা পাঠালে সেটি সিন করলেও উত্তর দেননি তিনি।
গত এক যুগে বেআইনিভাবে কলেজ ফান্ড থেকে শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠছে মাহবুবর রহমান মোল্লার বিরুদ্ধে। আকরাম মিয়াসহ বেশ কয়েকজন আত্মীয়ের নামে বিপুল অর্থ আত্মসাতের অভিযোগও করেন একাধিক শিক্ষক।