এশিয়ার সেরা প্রতিষ্ঠানের তালিকায় বরিশালের ফরচুন সুজ, নাম উঠেছে ফোর্বসেও
প্রকাশ: ১১ জুলাই, ২০২২, ২:৪২ অপরাহ্ণ |
অনলাইন সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক,
প্রায় ১১ বছর আগে যাত্রা শুরু করে একটি জুতা তৈরির কারখানা। জনবল ছিল মাত্র ৪৭২ জন। সেই কারখানার জুতা এখন রপ্তানি হচ্ছে ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে। তাদের বার্ষিক লেনদেনের পরিমাণ ৮০০ কোটি টাকার বেশি। এশিয়ার সেরা ২০০ প্রতিষ্ঠানের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে ‘ফরচুন সুজ’ নামের এই পাদুকা কোম্পানি। প্রতিষ্ঠানটির কৃতিত্বের গল্প উঠে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসা-বাণিজ্যবিষয়ক সাময়িকী ফোর্বসে।
বরিশালে প্রতিষ্ঠিত এই কোম্পানি ঐকান্তিক প্রচেষ্টা, দৃঢ় মনোবল আর সততায় ভর করে বিশ্বে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। সম্পূর্ণ রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে স্পেন, জার্মানি, ভারত, ইতালি, পোল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোয় তাদের উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি করছে। পাশাপাশি বরিশাল অঞ্চলের অবহেলিত নারী ও বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। এরই মধ্যে কোম্পানির চেয়ারম্যান ২০১৮ সালে দেশে শ্রেষ্ঠ তরুণ শিল্পোদ্যোক্তা হিসেবে পুরস্কার পেয়েছেন।
২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বিজনেস ম্যাগাজিন ফোর্বসের ‘এশিয়াস ২০০ বেস্ট আন্ডার আ বিলিয়ন’ প্রতিষ্ঠানের তালিকায় দেশের শীর্ষ তিন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বরিশালের ফরচুন সুজের নাম উঠে আসে। অন্য দুই প্রতিষ্ঠান হলো স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস ও রেনাটা ফার্মাসিউটিক্যাল। এছাড়া ২০২১ সালে বঙ্গবন্ধু শিল্প পুরস্কারে প্রথম স্থান অর্জন করেছে ‘ফরচুন গ্রুপ অব কোম্পানি লিমিটেড’। ফরচুনের জুতা রফতানি হচ্ছে ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। তাদের বার্ষিক লেনদেনের পরিমাণ ৮০০ কোটি টাকার বেশি।
এদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত দুটি পাটকলের জমি ইজারা পেয়েছে ফরচুন সুজ। ৫৬ একর আয়তনের এই জমিতে ফরচুন জুটেক্স নামে নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এই কোম্পানি। এই কারখানায় দেশ ও বিদেশের বাজারে সম্ভাবনাময় পাটজাত পণ্য উৎপাদন করা হবে।
চলতি বছরের শুরুর দিকে চট্টগ্রাম ও খুলনা জোনে রাষ্ট্রায়ত্ত ১৩টি পাটকল বেসরকারি খাতে ইজারা দেওয়ার জন্য একটি আন্তর্জাতিক দরপত্র ডেকেছিল বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন—বিজেএমসি।
ওই দরপত্রে অংশ নেয় পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত দুটিসহ মোট ১৮টি দেশি-বিদেশি সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান। সর্বশেষ গত ২৫ মে চূড়ান্ত প্রস্তাব জমা দেয় কোম্পানিগুলো। এর মধ্যে ফরচুন সুজ খুলনা জোনে প্লাটিনাম জুবিলি জুট মিলস ও দৌলতপুর জুট মিলস ইজারা পেতে প্রস্তাব দিয়েছিল। বিজেএমসির মূল্যায়ন কমিটি চূড়ান্ত প্রস্তাব জমা দেওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে বিজয়ী প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকারি মালিকানাধীন পাটকল ইজারা দেওয়ার জন্য চুড়ান্ত করে। এদের মধ্যে ফরচুন সুজ দেওয়া হয় ৫৬ একর জমি।
পাট খাতে বিনিয়োগের চিন্তা থেকে ফরচুন সুজ সরকারি জমির ইজারায় অংশ নেয় জানিয়ে কোম্পানিটির সেক্রেটারি রিয়াজউদ্দিন ভূইয়া বলেন, গ্রুপ ম্যানেজমেন্ট নতুন কোম্পানির মাধ্যমে পাট খাতে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে অল্প সময়ে নতুন কোম্পানি খোলা সম্ভব নয় বিধায় ফরচুন সুজের নামে দরপত্র জমা দেয়া হয়েছিল।
কোম্পানি সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালের ১৪ মার্চ বরিশাল শিল্পনগরীতে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ফরচুন সুজ লিমিটেড’। মাত্র ৪৭২ জন জনবল নিয়ে জুতা তৈরির কারখানাটি চালু হয় ২০১১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর। ২০১২ সালের ৪ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা আর দক্ষ শ্রমিকের অভাব থাকলেও ধীরে ধীরে এগিয়ে চলা প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদিত পণ্য পশ্চিমা দেশগুলোয় বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এর ধারাবাহিকতায় সম্পূর্ণ রফতানিনির্ভর এ প্রতিষ্ঠান ২০১৫ সালের ১৪ জানুয়ারি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তরিত হয়।
ব্যবসা বাড়ার মধ্যে উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ২০২১ সালে আরও চারটি (প্রিমিয়ার ফুটওয়্যার লি., এমজে ইন্ডাস্ট্রিজ, ইউনিওয়ার্ল্ড ফুটওয়্যার অ্যান্ড টেকনোলজি লি. ও ফেন-এন ফুটওয়্যার লি.) প্রোডাকশন লাইন সংযুক্ত করে মোট ছয়টি লাইন করার পরিকল্পনা নেয় কোম্পানিটি।
স্পেন, জার্মানি, ভারত, ইতালি, পোল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোয় ফরচুনের উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি করায় একদিকে যেমন দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আসছে, অন্যদিকে স্বাবলম্বী হচ্ছেন বরিশাল অঞ্চলের অবহেলিত নারীরা। এখানে কর্মরত সাড়ে চার হাজার শ্রমিকের মধ্যে ৮০ ভাগই নারী।
ফরচুন গ্রুপ অব কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহম্মদ রেদওয়ান বলেন, তাদের কোম্পানির তৈরি জুতার আকৃতি, গঠন ও গুণগত মান দেশের অন্য যেকোনো ব্র্যান্ডের জুতার চেয়ে উন্নত। ফরচুন পণ্য তৈরিতে ক্রেতা সন্তুষ্টির বিষয়ে কখনই কোনো আপস করে না। ফরচুন বিশ্বের বিখ্যাত ব্র্যান্ডের জন্য সুজ তৈরি করে।
রেদওয়ান জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে রফতানির জন্য নারী, পুরুষ ও শিশুদের জন্য বিভিন্ন স্টাইলের সুজ, ফ্যাশনেবল ও স্পোর্টস সুজ উৎপাদন করে। নিজস্ব ল্যাব সেকশনের মাধ্যমে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এ জুতাগুলো বহির্বিশ্বে রফতানি করা হয়। প্রতিষ্ঠানটির মার্কেটিং ব্যবস্থাকে আরো বিস্তৃত করতে চীনের গুংঝুয়ান শহরে রয়েছে একটি কার্যালয়। সেখান থেকেই পুরো ইউরোপে এ প্রতিষ্ঠানের পণ্য সরবরাহ ও বিক্রি করা হচ্ছে।
প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান জানিয়েছেন, বরিশালকেন্দ্রিক এ প্রতিষ্ঠানের কারখানা রয়েছে দেশের বিভিন্ন জেলায়। পদ্মা সেতুর দ্বার খুলে যাওয়ায় বরিশাল অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যে কী ধরনের পরিবর্তন আসছে, তা বলা যাচ্ছে না। এতদিন আমাদের পণ্যবাহী ট্রাকগুলো চট্টগ্রাম বন্দরে নেয়ার সময় বিভিন্ন ফেরিঘাটে অনেক সময় দিনের পর দিন আটকে থাকত। এ কারণে অনেক সময় আমাদের শিপমেন্ট বাতিল করতে হয়েছে। এতে আর্থিকভাবে লোকসানের মুখে পড়েছি। ভোগান্তি এখন লাঘব হয়েছে। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর বেশ সুবিধা হচ্ছে। আশা করছি, শিপমেন্ট বাতিলের মতো পরিস্থিতিতে আর পড়তে হবে না।
বাংলাদেশ ৫০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানির মাইল ফলকে পৌঁছার ব্যাপারে ফরচুন গ্রুপের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, দক্ষিণবঙ্গ থেকে এর অংশীদার হতে পেরে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি। দক্ষিণ এশিয়ায় আজ ভারতের পরই রফতানি ৫০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করা আমাদের বিশেষ অর্জন। আশা করছি শিগগিরই আমরা রফতানিকারক হিসেবে হাই প্রডাক্ট রপ্তানি করে ভারতকেও পেছনে ফেলতে সক্ষম হব।
ফরচুন সুজ বর্তমানে তাদের নয়টি উৎপাদন লাইনে প্রতিদিন সাড়ে ৩৫ হাজার জুতা তৈরি করছে। গত অর্থবছরে কোম্পানিটির রাজস্ব ১৮ শতাংশ বেড়ে ১ হাজার ৪৪০ কোটি ৪০ লাখ টাকা হয়েছে। এছাড়া ১০৯ শতাংশ বেড়ে কর-পরবর্তী নিট মুনাফা হয়েছে ২৪ কোটি ৫৫ লাখ টাকা।