ফেসবুকে ছড়িয়েছে বরগুনায় ছাত্রলীগের ওপর পুলিশের নির্বিচার লাঠিচার্জের ভিডিও। একই সঙ্গে সংসদ সদস্যের সঙ্গে পুলিশের পদস্থ কর্মকর্তার কথা কাটাকাটির ভিডিও-ও ভাইরাল হয়েছে।
এ নিয়ে দেশজুড়ে চলছে তোলপাড়। সরিয়ে দেওয়া হয়েছে আলোচিত অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মহরম আলীকে। উত্তেজনা যখন তুঙ্গে ঠিক তখনই বেরিয়ে আসছে ভেতরের খবর।
পুরো ঘটনার জন্য উলটো স্থানীয় এমপি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুকেই দায়ী করছেন বরগুনার আওয়ামী লীগ নেতারা। পছন্দের ছেলেদের দিয়ে ছাত্রলীগের কমিটি সাজাতে না পারার কারণেই এমনটা ঘটেছে। এসব কর্মকাণ্ড ঢাকতেই মহরম আলীকে সামনে এনে শম্ভু নিজেকে রক্ষার চেষ্টা করছেন বলে অনেকের অভিযোগ।
তবে এমপি শম্ভু অবশ্য এসব অভিযোগ স্বীকার করেননি। নিষেধ করার পরও পুলিশ কেন ছাত্রলীগকে মারল প্রশ্ন করে তিনি বলেন, ‘আমার ছেলেদের অপরাধের বিচার আমরা করব। তাদের বলেছিলাম, গাড়ির গ্লাস ঠিক করে দেব। তারপরও মহরম ও তার বাহিনী যা করেছে তা আইনবহির্ভূত।’
তিনি বলেন, ‘এত দুর্বল কমিটি আগে আর কখনো হয়নি বরগুনায়। কমিটি করার ক্ষেত্রে আমাদের পরামর্শও নেওয়া হয়নি।’
হামলা শুরু হয় সকাল থেকেই : ভিডিওতে বরগুনা শিল্পকলা একাডেমির ভেতরে-বাইরে ছাত্রলীগ কর্মীদের ওপর পুলিশের লাঠিচার্জের দৃশ্য দেখা গেলেও দফায় দফায় হামলার ঘটনা ঘটে ওইদিন সকাল থেকেই। ১৭ জুলাই সম্মেলনের পর ২৪ জুলাই ঘোষিত হয় জেলা ছাত্রলীগের কমিটি।
সভাপতি রেজাউল কবির রাজা এবং সাধারণ সম্পাদক তৌফিকুর রহমান ইমরান স্কুলজীবন থেকেই ছাত্রলীগের কর্মী। তবে কমিটি নিয়ে শুরু থেকেই ক্ষুব্ধ জেলা আওয়ামী লীগের টানা ৩০ বছরের সভাপতি এমপি শম্ভু।
নতুন কমিটির সভাপতি রেজাউল কবির বলেন, ‘কমিটির বিরোধিতা করে বরগুনায় যারা বিক্ষোভের নামে হামলা ভাঙচুর করছিল তারা সবাই এখানকার শীর্ষ নেতৃত্বের অনুসারী। কমিটি বাতিল বা পুনর্গঠন না হওয়া পর্যন্ত আমরা যাতে পথে নামতে না পারি তার নির্দেশনাও ছিল। যে কারণে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত একটানা বাধা দেওয়া হয়েছে আমাদের। ঘোষিত কর্মসূচির স্থলে পালটা কর্মসূচি দেওয়ায় ১৪৪ ধারা পর্যন্ত জারি হয়েছে এখানে।’ ১৫ আগস্ট জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে চলছিল প্রশাসনের শোক দিবসের অনুষ্ঠান।
ফুল দেওয়ার জায়গা বঙ্গবন্ধু কমপ্লেক্সে যেতে হয় শিল্পকলার পাশ দিয়েই। নতুন কমিটির নেতারা যাতে ফুল দিতে না পারে সেজন্য আগে থেকেই বাধা দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে রাখে এমপি শম্ভুর অনুসারী ছাত্রলীগ কর্মীরা। সকালে বঙ্গবন্ধু কমপ্লেক্সে যাওয়ার পথে প্রথম হামলা হয় শিল্পকলা এবং বার লাইব্রেরির মাঝামাঝি জায়গায়। সে সময় লাঠিচার্জসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করে পুলিশ।
ফুল দিয়ে ফেরার পথে দ্বিতীয় দফা হামলা হয় শিল্পকলা এলাকায়। শিল্পকলার ওপর অবস্থান নেওয়া শম্ভুর অনুসারী ছাত্রলীগ কর্মীরা বৃষ্টির মতো ইট ছুড়তে থাকে নয়া কমিটির নেতাকর্মীদের ওপর। এ সময় পুলিশের একটি গাড়ির কাচ ভেঙে যায়। প্রথমে নিচে রাস্তায় থাকা নেতাকর্মীদের লাঠিচার্জ করে হটিয়ে দেয় পুলিশ। এ সময় শিল্পকলা থেকে বাইরে বেরিয়ে আসেন শম্ভু। ভবনের ভেতর আটকা পড়া ছিল তার অনুসারী ছাত্রলীগ কর্মীরা। পুলিশকে তিনি বলেন, তাদের নিরাপদে যেতে দিতে। এই নিয়েই তার সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মহরম আলীর।
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ‘বাহিনীর সদস্যদের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ এবং পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর হওয়ায় এমনিতেই ক্ষিপ্ত ছিল পুলিশ সদস্যরা। তার ওপর এমপি সাহেবের পক্ষপাতিত্ব সেই ক্ষোভ আরও বাড়িয়ে দেয়। কমিটি ঘোষণার পর থেকেই এমপির অনুসারী ছাত্রলীগ কর্মীরা হামলা ভাঙচুর চালাচ্ছিল শহরে।
নেপথ্যে সংসদ সদস্যের সমর্থন থাকায় তেমন কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছিল না পুলিশ। এ নিয়েও ক্ষোভ ছিল পুলিশের ভেতরে। সকালে প্রথম দফা হামলা হওয়ার পর এমপি সাহেবকে অনুরোধ করা হয়েছিল তার ছেলেদের সামলে রাখতে। তা না করে উলটো তিনি চড়াও হন পুলিশের ওপর। ফলাফল বেপরোয়া লাঠিচার্জ।’
জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তৌফিকুর রহমান ইমরান বলেন, ‘শিল্পকলা একাডেমির শোকসভায় দোতলা-তিনতলা পর্যন্ত ইট-লাঠিসোটা নিয়ে কেন উঠেছিল তারা? সেখানে থাকা নেতারা তা দেখেননি? সকালে আমাদের ওপর হামলা ভাঙচুর হওয়ার পরও কেন তাদের আটকানো হলো না? এসব বিষয়ে খোঁজ নিলেই সব পরিষ্কার হয়ে যায়।’
আধিপত্য ধরে রাখার লড়াই, সব অস্বীকার এমপি শম্ভুর : কথা হয় জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম সরোয়ার টুকুর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘অপছন্দের লোকজন নেতৃত্বে এলেই এমন ঘটনা ঘটান এমপি শম্ভু। কেবল ছাত্রলীগই নয়, সব অঙ্গসংগঠনেই চলে এমন রীতি।
পেটালো পুলিশ আর উনি (এমপি শম্ভু) প্রতিবাদ সভা করে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করলেন ছাত্রলীগের কমিটি। পছন্দের লোকজন দিয়ে কমিটি করতে না পেরে যে খেলা খেলছিলেন তারই ফলাফল ১৫ আগস্টের লাঠিচার্জ। টানা ৩০ বছর ধরে উনি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। এমপি হয়েছেন ৪ বার। আর কত? দলে কি কোনো যোগ্য লোক নেই? নিজের আধিপত্য ধরে রাখতে যে নোংরা খেলা উনি খেলছেন তার খেসারত দিচ্ছে দল।’
জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান জয় বলেন, ‘আমরা যখন কমিটি ঘোষণার প্রস্তুতি নিচ্ছি তখন বরগুনা থেকে সভাপতি সাধারণ সম্পাদক পদে ৩টি অনুরোধ এসেছে। এমপি শম্ভু মহোদয় এবং তার ঘনিষ্ঠরাই এসব অনুরোধ করেছেন। সবুজ মোল্লা, বিশাল এবং সাগর নামে ৩ জনের মধ্যে যে কোনো দুজনকে সভাপতি বা সম্পাদক পদ দেওয়ার অনুরোধ ছিল। এক্ষেত্রে জোরালো অনুরোধ ছিল বিশালের জন্য। কিন্তু তার বয়স মাত্র ১৯ বছর। তাছাড়া এরা খুব একটা সক্রিয়ও ছিল না। তাই সেসব অনুরোধ রাখতে পারিনি।’
বিশালের জন্য সবচেয়ে বেশি অনুরোধ ছিল, সে এমপি শম্ভুর ভায়রার ছেলে। তাছাড়া বাকি দুজনও তার এবং জাহাঙ্গীর কবিরের ঘনিষ্ঠ অনুসারী।
পুরো বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু বলেন, ‘ছাত্রলীগের কমিটি নিয়ে আমার কখনোই কোন মাথাব্যথা ছিল না। তবে এটা ঠিক যাদের পদ-পদবি দেওয়া হয়েছে তারা অপরিচিত। অত্যন্ত দুর্বল একটা কমিটি হয়েছে। আমরা সুপারিশ করেছিলাম। কিন্তু তারা আমাদের কথা রাখেনি। তাছাড়া এটি কোনো ইস্যু নয়। আমার ছেলেদের কেন পুলিশ বেধড়কভাবে পেটাল?’
ছাত্রলীগের একাংশ আপনার নির্দেশে নয়া কমিটি প্রতিহত করার মিশন নিয়ে মাঠে ছিল এবং নিচে যখন পুলিশ নয়া কমিটির নেতাকর্মীদের মারছিল তখন আপনি কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে পরে আপনার অনুসারীদের বাঁচাতে পুলিশের সঙ্গে তর্কে জড়ান প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘আমার আর তাদের কী? সবাই-ই তো ছাত্রলীগ। যাতে কোনো বাড়াবাড়ি না হয় সেটাই বলেছিলাম। কিন্তু তারা আমার কোনো কথা শোনেনি। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মহরম আলীকে বরখাস্ত না করানো পর্যন্ত আমরা থামব না।’