ময়মনসিংহ নগরীর যে এলাকায় রইছ উদ্দিন শ্যামলের বসবাস, সেখানে তিনি পরিচিত ‘বাবু’ নামে। এলাকায় এখন রীতিমতো তিনি ‘ধনকুবের’ হিসেবে পরিচিত। সরকারি বিদ্যালয়ে পিয়ন হিসেবে চাকরিতে ঢোকার পর থেকেই তাঁর দিনবদল শুরু। পরে বদলি হন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) ময়মনসিংহ আঞ্চলিক উপপরিচালকের (ডিডি) কার্যালয়ে। সেখানে এখন তাঁর পদ কম্পিউটার অপারেটর। উপপরিচালকের হয়ে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিওভুক্তির জন্য ঘুষের টাকা ‘ক্যাশিয়ার’ হিসেবে এই শ্যামলই আদায় করে থাকেন।

উপজেলা শিক্ষা অফিস থেকে শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির আবেদনসংবলিত ফাইল জেলা শিক্ষা অফিসে যাওয়ার পর থেকেই শ্যামলের তৎপরতা শুরু হয়। শিক্ষকদের ইনডেক্স নম্বর পড়া পর্যন্ত পুরো কাজ করে দেন চুক্তিবদ্ধ হয়ে। যার ফাইলে যত বেশি ত্রুটি, তার ঘুষের পরিমাণ ততই বেশি। এই অঙ্ক ১০ হাজার থেকে কয়েক লাখ টাকা পর্যন্ত হয় বলে ভুক্তভোগী অনেকেই জানিয়েছেন। নিয়ম অনুযায়ী যেসব এমপিওভুক্তি সম্ভ্ভব নয়, সেগুলোও শ্যামল করে দিতে পারেন- এমন কথাও জানিয়েছেন একাধিক শিক্ষক।

এসব কাজ করেই গত কয়েক বছরে অঢেল টাকার মালিক বনে গেছেন শ্যামল- এমন তথ্যের সত্যতা মেলে শ্যামলের ঠিকুজি খুঁজতে নেমে। দেখা যায়, মাউশির সামান্য বেতনের এই কর্মচারী অস্বাভাবিক রকমের ধনসম্পদের মালিক।

ময়মনসিংহ নগরীর বাদেকল্পা এলাকায় শ্যামলের বিলাসবহুল বাড়ির সামনে স্ত্রীর নামে কেনা গাড়ি (বাঁয়ে), একই এলাকায় রয়েছে তাঁর আরও একটি বাড়ি। এ রকম কয়েকটি বাড়ির সন্ধান মিলেছে 

জানা যায়, শ্যামলদের আদি নিবাস নড়াইল জেলায়। চার দশক আগে তাঁর বাবা মো. রবি উল্লাহ ওরফে রবু ময়মনসিংহ শহরে এসে বসবাস শুরু করেন। ময়মনসিংহ শহরের সানকিপাড়ার শেষ মোড় ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় তিনি ছোটখাটো ঠিকাদার হিসেবে পরিচিত। গোয়াইলকান্দি ইন্দারাপাড় এলাকায় সাড়ে ৬ শতক জমিতে নির্মিত একতলা বাড়িতে বসবাস করেন শ্যামলের বাবা-মা।

গোয়াইলকান্দি এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, শ্যামল তাঁর বাবার বাড়ির কাছেই করেছেন নিজের পাঁচতলা বাড়ি। চার শতক জমিতে করা এই বাড়ির নাম দেওয়া হয়েছে ‘হাসিনা মঞ্জিল’। স্থানীয়রা জানান, বাড়িটি শ্যামলের স্ত্রী হাসিনা আক্তারের নামে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সুদৃশ্য এ বাড়িতেই সপরিবারে শ্যামলের বসবাস। শ্যালকদের কাছ থেকে নেওয়া এ জমিটির মূল্য ২০ লাখ টাকা- এমনটি জানা যায় স্থানীয়দের কাছ থেকে।

তবে সমকালের কাছে শ্যামলের দাবি, হেবা দলিল মূলে এ সম্পত্তি তাঁর হয়েছে। এই একটিমাত্র বাড়িই আছে তাঁর।

কিন্তু সমকালের অনুসন্ধানে বলছে, ময়মনসিংহ নগরীর বাদেকল্পা এলাকায় অন্তত চারটি স্থানে মূল্যবান জমি রয়েছে শ্যামলের। এই জমিগুলোর মালিক হিসেবে শ্যামলকেই জানেন স্থানীয়রা। এর মধ্যে ১৩ শতক জমিতে রয়েছে একটি একতলা বাড়ি। এ বাড়িতে থাকেন শ্যামলের আপন খালা। দৃষ্টিনন্দন তোরণ করা এ বাড়িটি বছরখানেক আগে নির্মাণকাজ শেষ হয়। এ বাড়িতেই শ্যামল তাঁর নিজের বিলাসবহুল প্রিমিও গাড়িটি রাখেন। এ বাসাটির পাশেই সাড়ে ৬ শতক জমিতে ৬ তলা বিশিষ্ট আরেকটি ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। তৃতীয় তলার ছাদ ঢালাই শেষ হয়েছে। এটিও শ্যামলের। এর আরেক পাশেই রয়েছে প্রাচীরঘেরা আরেকটি প্লট। এ ছাড়াও বাদেকল্পা রুস্তমের মোড় এলাকায় শ্যামলের রয়েছে প্রাচীরঘেরা আরও সাড়ে ৬ শতক জমি।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, এসব জমির সবই গত কয়েক বছরের মধ্যে কেনা হয়েছে। ৫ লাখ টাকা শতক হিসেবে জমিগুলো সে সময়ে বিক্রি হতো। সে হিসাবে ২৬ শতক জমির দাম অন্তত ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা। নির্মিত বাড়ি ও নির্মাণাধীন বাড়ির বাজারমূল্য হবে আরও অন্তত ৪ কোটি টাকা।

৩৩ লাখ টাকা দামের প্রিমিও ব্র্যান্ডের নতুন মডেলের ঢাকা মেট্রো-গ-৪২-৯৮৬৩ গাড়িতে চড়েন শ্যামল। গাড়িটি নিয়ে প্রশ্ন করলে বছর তিনেক আগে কেনা হয়েছে বলে দাবি করেন শ্যামল। গাড়িটির ব্লু বুক পরীক্ষা করে দেখা গেছে, স্ত্রী হাসিনার নামে সেটি কেনা। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন অথরিটি (বিআরটিএ) থেকে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

বাদেকল্পা এলাকার বাসিন্দা মোশাররফ হোসেন রুবেল বলেন, তাঁর জানা মতে, ‘এই এলাকায় অন্তত পাঁচটি জমি রয়েছে শ্যামলের; দুটি বাড়ি আছে। এত ছোট চাকরি করে এত সম্পত্তির মালিক হওয়া প্রতিবেশী হিসেবে তাঁদের কাছেও আশ্চর্য লাগে।’ স্থানীয় বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম জানান, শ্যামলের বাবা ছোট ঠিকাদার ছিলেন। এত সম্পত্তি কীভাবে শ্যামল করলেন, তা সত্যিই রহস্যের।

শ্যামলের বাবার বাড়িতে গিয়ে কথা হয় তাঁর মা ডলি আক্তার ও বোন দীপার সঙ্গে। তাঁরা জানান, অন্তত চার দশক ধরে এ এলাকায় তাঁরা বসবাস করছেন। দীপা নিজের স্ব্বামীকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা পরিচয় দেন। তিনি জানান, তাঁর বাবা রবি উল্লাহ ময়মনসিংহ ক্যান্টনমেন্টের প্রথম শ্রেণির ঠিকাদার। শ্যামলের মা-বোন দু’জনই স্বীকার করেন, তাঁদের বাড়ির কাছের পাঁচতলা বাড়িটি শ্যামলের। বাকিগুলোও সব শ্যামলের বাবার নামে শ্যামলই করেছেন।

তবে মোবাইল ফোনে রইছ উদ্দিন শ্যামল সমকালকে জানান, তাঁর বাবার ভবনে নির্মাণকাজ চলছে। সব সম্পত্তি তাঁর বাবার। রুস্তমের মোড়ের জমিটি মানুষ জানে তাঁর নামে, তবে সেটি তিনি কিংবা তাঁর বাবার নয়, এটি অন্য আরেকজনের। তাঁর বাড়ি একটিই। পাঁচতলা বাড়িটিই তাঁর। আর গাড়িটি কেনা হয়েছে তিন বছর আগে।

তাঁর বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হয়ে ওঠা নিয়ে শ্যামলের দাবি, এগুলো মানুষের ভুয়া আলাপ। তাঁর নিজের নামে ২ শতাংশ ৩০ পয়েন্ট জমি রয়েছে। পাঁচতলা বাড়িটির জমি কেনা হলেও দলিলটি তাঁর স্ত্রীর নামে হেবা করা। শ্যামল বলেন, সম্পদ যদি বেশি থাকে তা লুকানোর সুযোগ নেই। সব ডকুমেন্ট ফাইল করে রাখা হয়েছে। অত্যাচারিত হওয়ার ভয়ে সব সময় ফাইল রেডি রাখেন বলেও তিনি দাবি করেন।