করোনা মহামারির কারণে দুই বছর বন্ধ থাকার পর এবারও জানুয়ারি মাসের দ্বিতীয় ও তৃতীয় সপ্তাহে শুক্রবার তাবলীগ জামাতের দুই গ্রুপের ৫৬তম বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হবে। প্রতি বছরই বাংলাদেশে তাবলীগ জামাতের বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। ইজতেমা শুধু বাংলাদেশেই হয় তা নয়। বরং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন সময়ে বেশ কিছু ইজতেমা হয়। কোথাও পুরো দেশের হয়। কোথাও কয়েকটি দেশ মিলে হয়। কখনো কোনো দেশের একটা প্রদেশ বা অঞ্চলেরও ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশে মূল ইজতেমা ছাড়াও বিভিন্ন জেলায় (কয়েকটি জেলা মিলে) ইজতেমা আগেও হয়েছে এবং এখনো হয়, যেগুলোকে আঞ্চলিক ইজতেমা বলা হয়। সাধারণত ইজতেমা যে অঞ্চলে হয়, সেই এলাকার নামানুসারে ঐ ইজতেমা পরিচিত পায়। টঙ্গীসহ অন্যান্য স্থানে অনুষ্ঠিত ইজতেমাগুলোর মূল উদ্দেশ্য হলো দিনের দাওয়াত দেওয়ার লক্ষ্যে আল্লাহর রাস্তায় বের হওয়া। বর্তমান সময়ে কেউ শুধু কয়েকটা বয়ান শুনে ইসলাম পালন শুরু করবে এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। তবে জামাতে গিয়ে যখন কেউ একনাগাড়ে কিছুটা সময় দ্বীনি পরিবেশে থাকে; তখন তার জন্য ইসলাম মানা অনেকটা সহজ হয়ে যায়। এজন্য শুধু ইজতেমা নয়, প্রায় সব ক্ষেত্রেই দাওয়াত ও তাবলীগের কাজে মানুষকে জামাতে বের করার চেষ্টা করা হয়। বেশি বেশি ইজতেমা হলে ইজতেমাকে উপলক্ষ করে অনেকের জন্যই জামাতে বের হওয়া সহজ হয়। এজন্য ইজতেমায় বিশেষভাবে দিনের দাওয়াতের গুরুত্ব এবং ইমান-আমলসংক্রান্ত কথা বলা হয়। ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে নবী-রাসূল ও সাহাবায়ে কেরামদের কষ্ট ও ত্যাগ-তিতিক্ষার বিভিন্ন ঘটনা উল্লেখ করা হয়। এর ফলে সাধারণ মানুষ দিনের কাজে আত্মনিয়োগে উত্সাহী হয়। এজন্য দেখা যায় যে, সারা বছর মিলে যে পরিমাণ জামাত বের হয়, ইজতেমা থেকেই তার অনেক বেশি জামাত আল্লাহর রাস্তায় ইমানের দাওয়াত নিয়ে বের হয়।
দৈনিক ইত্তেফাকের সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন
তাবলীগ আরবি শব্দ, যার শাব্দিক অর্থ পৌঁছানো, প্রচার করা, প্রসার করা, বয়ান করা, চেষ্টা করা, দান করা ইত্যাদি। পরিভাষায় একজনের অর্জিত জ্ঞান বা শিক্ষা নিজ ইচ্ছা ও চেষ্টার মাধ্যমে অন্যের কাছে পৌঁছানোকে তাবলীগ বলে। তাবলীগের আদর্শ যিনি পৌঁছান, তাকে মুবাল্লিগ বলে। বিংশ শতাব্দীর প্রখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ ও সাধক হজরত মাওলানা ইলিয়াস আখতার কান্ধলভি (১৮৮৫-১৯৪৪ খ্রি.) দাওয়াতে তাবলীগ জামাতের পুনর্জাগরণ করেন। তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী দিল্লির দক্ষিণ পাশে অবস্থিত এক জনবিরল নীরব অঞ্চল ‘মেওয়াত’। চারিত্রিক বিপর্যস্ত ধর্মকর্মহীন, অশিক্ষিত ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন নামেমাত্র মুসলমান ‘মেও’ জনগোষ্ঠীকে ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস, ধর্মের পূর্ণাঙ্গ অনুশীলন ও কালেমার দাওয়াতি মর্ম শিক্ষাদান এবং বিভ্রান্তির কবল থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে হজরত মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) তাবলীগ জামাতের কার্যক্রম শুরু করেন।
১৩৫২ হিজরিতে তৃতীয় হজ পালনের পর তিনি বুঝতে পারলেন যে গরিব মেওয়াতি কৃষকদের পক্ষে দিন শেখার সময় পাওয়া কষ্টকর। ঘর-সংসার ছেড়ে মাদ্রাসায় দিন শেখাও অসম্ভব। ওয়াজ-নসিহতের মাধ্যমে সামগ্রিক জীবন পালটে দেওয়া বা জাহেলি বিশ্বাসকে পরিবর্তন করাও সম্ভব নয়। তাই ক্ষুদ্র দল বা ছোট জামাত আকারে ইলমি ও দ্বীনি প্রতিষ্ঠানগুলোয় গিয়ে সময় কাটানোর জন্য উদ্বুদ্ধ করলেন এবং ধর্মীয় পরিবেশে তালিম দিতে আরম্ভ করলেন। সেসব ধর্মীয় মজলিসে ওলামা-মাশায়েখদের ওয়াজ-নসিহতের পাশাপাশি তাদের দৈনন্দিন জীবনের নিয়মনীতি বাতলে দেওয়া হতো। মানুষ দিনদার পরহেজগার লোকদের জীবনযাপন, কথাবার্তা, আচার-আচরণ, চালচলন গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করত। শুরুতে তাবলিগি কার্যক্রম ব্যাপক সমর্থন পায়নি, কিন্তু ধীরে ধীরে এর জনপ্রিয়তা বাড়ে।
রসুলুল্লাহ (স.)-এর মুখ নিঃসৃত শাশ্বত বাণী :‘কাছে যদি কোনো বাণী থাকে, তা অন্যের কাছে পৌঁছে দাও’—এই দাওয়াতি আহ্বানকে কেন্দ্র করেই পর্যায়ক্রমে তাবলীগের বিশ্বব্যাপী প্রচার ও প্রসার ঘটে। এ ব্যাপারে তাবলীগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা হজরত মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) অত্যন্ত ন্যায়নিষ্ঠা, ধৈর্য, পরিশ্রম, পরিকল্পনা ও দিকনির্দেশনায় অপরিসীম ভূমিকা রাখেন। তাবলীগ জামাতের দ্বিতীয় আমির মাওলানা ইউসুফ কান্ধলভি (রহ.)-এর যুগে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে এই আন্দোলন সবচেয়ে বেশি ও শক্তিশালী ছিল। প্রথম ইজতেমা ১৯৪১ সালে দিল্লির নিজামউদ্দীন মসজিদের ছোট এলাকা মেওয়াতের নুহ মাদ্রাসায় আয়োজন করা হয়।
বাংলাদেশে ১৯৪৬ সালে ঢাকার রমনা পার্কসংলগ্ন কাকরাইল মসজিদে তাবলীগ জামাতের বার্ষিক সম্মেলন বা ইজতেমা প্রথম অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ১৯৪৮ সালে চট্টগ্রামে তৎকালীন হাজি ক্যাম্পে ইজতেমা হয়, ১৯৫৮ সালে বর্তমান নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। তখন এটা কেবল ইজতেমা হিসেবে পরিচিত ছিল। প্রতি বছর ইজতেমায় অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা আশাতীতভাবে বাড়তে থাকায় ১৯৬৬ সালে ইজতেমা টঙ্গীর পাগার গ্রামের খোলা মাঠে আয়োজন করা হয়। ঐ বছর স্বাগতিক বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা অংশ নেওয়ায় ‘বিশ্ব ইজতেমা’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ১৯৬৭ সাল থেকে বর্তমান অবধি (২০১১ সাল থেকে দুই পর্বে) ‘বিশ্ব ইজতেমা’ টঙ্গীর কহরদরিয়া খ্যাত তুরাগ নদের উত্তর-পূর্ব তীরসংলগ্ন ডোবা-নালা, উঁচু-নিচু মিলিয়ে রাজউকের হুকুমদখলকৃত ১৬০ একর জায়গার বিশাল খোলা মাঠে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রতি বছর বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রাম-শহর-বন্দর থেকে লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান এবং বিশ্বের প্রায় ৫০ থেকে ৫৫টি দেশের তাবলিগি দিনদার মুসলমান জামাতসহ ২৫ থেকে ৩০ লক্ষাধিক মুসল্লি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম আন্তর্জাতিক ইসলামি মহাসম্মেলন বা বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নেন।
বিশ্ব ইজতেমার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে তিন দিন দেশ-বিদেশের ইমানদার ত্যাগী আলেম-ওলামাদের কাছ থেকে পবিত্র কোরআন ও হাদিসের আলোকে বয়ান শুনে আখেরি মোনাজাত করে ইমান-আমলের দাওয়াত সারা বিশ্বে পৌঁছে দেওয়া। শুধু ইসলামি বয়ান শোনা কিংবা আখেরি মোনাজাতে প্রচুর লোকজনের অংশগ্রহণ করা ইজতেমার মূল উদ্দেশ্য নয়। লক্ষ্য হলো, যাতে বেশি তাবলীগ জামাত বের হয়। প্রতি বছর ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৭০০ জামাত বিশ্ব ইজতেমা থেকে দেশে-বিদেশে এক চিল্লা (৪০ দিন), তিন চিল্লা (চার মাস), ছয় মাস ও এক বছরের জন্য আল্লাহর দিনের তাবলীগ ও দাওয়াতের জন্য বের হয়। তৃতীয়ত, প্রতিটি মসজিদে পাঁচ আমল পরিপূর্ণ চালু করা (সপ্তাহে দুই দিন গাশ্ত করা, প্রতিদিন মাশওয়ারা করা, প্রতিদিন আড়াই ঘণ্টা দিনের দাওয়াত দেওয়া, প্রতিদিন মসজিদ ও বাড়িতে তালিম করা এবং মাসে তিন দিন তাবলীগে যাওয়া)। প্রতিটি জামাত নির্ধারিত এলাকার প্রতি মসজিদে দুই-তিন দিন করে থেকে তাওহিদ, রিসালাত, আখিরাত, ইমান ও আমলের দাওয়াত দেওয়া। এ বছর দেশের প্রতিটি মসজিদ থেকে একটি করে তাবলীগ জামাত বের করার লক্ষ্য নিয়ে ৫৬তম বিশ্ব ইজতেমা ২০২৩ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এবারও দুই দফায় ইজতেমা অনুষ্ঠিত হবে। ১৩ থেকে ১৫ জানুয়ারি প্রথম পর্ব এবং ২০ থেকে ২২ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে দ্বিতীয় পর্ব।
পরিশেষে বলতে চাই, পবিত্র কোরআন ও হাদিসের আলোকে নিজ নিজ পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে এই ইজতেমার গুরুত্ব ও ভূমিকা অপরিসীম। আল্লাহ আমাদের তাবলিগি ইজতেমার জ্ঞানগর্ভ দলিলভিত্তিক আলোচনা থেকে শিক্ষা লাভ করে তা নিজ পরিবার ও সমাজজীবনে বাস্তবায়নের তাওফিক দান করুন, আর বিশ্ব ইজতেমার শেষ ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আখেরি মোনাজাত। প্রবল ধর্মচেতনার উদ্দীপনা নিয়ে মুসল্লিগণ আখেরি মোনাজাতে অংশগ্রহণ করেন আর আমিন আমিন বলে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। আখেরি মোনাজাতের সময় টঙ্গীর তুরাগতীর যেন পরিণত হয় মুসল্লিদের জোয়ারে। আর আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে বিশ্ব ইজতেমার মূল কার্যক্রম শেষ হয়। বলা হয়ে থাকে, মক্কা-মদিনায় হজের পর এটাই মুসলিম উম্মাহর সব থেকে বড় জমায়েত। আল্লাহ যেন আমাদের সবাইকে দিন ও ইসলামকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করিয়ে এর আমল করার তৌফিক দেন। আমিন!