আহতদের খোঁজখবরসহ নিহতদের লাশ গ্রহণের জন্য বরগুনা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি টিম ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়েছে।
অগ্নিকাণ্ডের পর নিখোঁজ যাত্রীদের সঙ্গে স্বজনদের যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। নিখোঁজ ব্যক্তিদের খোঁজে বরগুনার নৌবন্দরে এসেও তাদের কোনো খোঁজ পাচ্ছেন না স্বজনরা। নিখোঁজ যাত্রীদের তথ্য দেয়ার মতো কোনো ব্যবস্থাও নেই বরগুনা নৌবন্দরে।
বরগুনা নৌবন্দরের সহকারী পরিচালক মামুনুর রশীদ বলেন, লঞ্চটিতে সব বয়সের প্রায় ৩০০-৪০০ জন যাত্রী ছিলেন।
ক্যান্সার আক্রান্ত শ্বশুরকে ডাক্তার দেখাতে মেয়ে তাইফা আফরিনকে (১০) সঙ্গে নিয়ে ঢাকা গিয়েছিলেন বরগুনা সদর উপজেলার কেওড়াবুনিয়া ইউনিয়নের রোডপাড়া গ্রামের বশির উদ্দিন। কিন্তু ঢাকা থেকে ফেরার পথে এম?ভি অভিযান-১০ যাত্রীবাহী ল?ঞ্চে আগুন লাগে। ঘটনার সময় জীবন বাঁচাতে লঞ্চ থেকে ঝাঁপ দেন তাইফার নানা। তাকে এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাইফার বাবা ও তাইফা লঞ্চের ডেকে আটকে পড়েন। তাইফা অগ্নিদগ্ধ হয়ে লঞ্চেই মারা যায়, তার বাবা বশির গুরুতর দগ্ধ হন। বর্তমানে তাইফার বাবা বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তাইফার মৃত্যুতে এলাকায় শোক নেমে এসেছে।
লঞ্চ দুর্ঘটনায় মা-ছেলেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এরা হলেন- জিয়াসমিন আক্তার (২৮) ও তার ছেলে তামিম হাসান (১০)। গতকাল শুক্রবার বেলা ৩টার দিকে অ্যাম্বুলেন্স যোগে তারা ঢাকায় পৌঁছান। ঢাকায় আসার পথে মাওয়া ফেরিঘাটে মারা যায় জিয়াসমিনের মেয়ে মাহিনুর (৬)। জিয়াসমিন তার স্বামী-সন্তান নিয়ে বরগুনা সদরে থাকেন। তার বাবার বাড়ি ঢাকার কেরানীগঞ্জে সুবাড্ডা এলাকায়। ১০-১২ দিন আগে জিয়াসমিনের নানীর মৃত্যুর খবর শুনে দুই সন্তানকে নিয়ে বাবার বাড়ি আসে জিয়াসমিন। গত বৃহস্পতিবার রাতে আবার সন্তানদের নিয়ে বরগুনা ফিরছিলেন। তখন লঞ্চে অগ্নি দুর্ঘটনার শিকার হন।
হাসপাতালের মেঝেতে অগ্নিদগ্ধ দুই হাত উঁচু করে বসে আছেন স্ত্রী হনুফা বেগম। পাশেই শুয়ে পুড়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন মেয়ে রুবি আক্তার। আর স্বামীর মরদেহ বরিশাল হাসপাতাল মর্গে। দীর্ঘদিন ধরে স্ত্রী হনুফা বেগমের শারীরিক নানা অসুস্থতার কারণে ঢাকায় চিকিৎসা করিয়ে মেয়ে রুবি আক্তারকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন। ঘটনার পরেই মা-মেয়ে অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় বরিশাল মেডিকেলে চিকিৎসাধীন থাকলেও স্বজনরা শিক্ষক আ. রাজ্জাককে খুঁজে পাচ্ছিলেন না। দুপুর ২টার দিকে ওই শিক্ষকের মরদেহ শনাক্ত করেন স্বজনরা।
আবদুর রাজ্জাক পাথরঘাটা উপজেলার কালমেঘা দাখিল মাদ্রাসার ইংরেজি শিক্ষক। তার বাড়ি পাথরঘাটা পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডে। তার মেয়ে রুবি আক্তার বরিশাল বিএম কলেজের ডিগ্রি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। ১০ দিন আগে মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে স্ত্রীকে ঢাকায় চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলেন স্বামী আ. রাজ্জাক।
লঞ্চের যাত্রীদের হন্যে হয়ে খুঁজছেন স্বজনরা: এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে আগুন লাগার খবর শুনে বরগুনা সদরের ঢলুয়া ইউনিয়নের খাজুরা গ্রামের রিপন এসেছেন জেলার নৌবন্দরে। ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে আগুন লাগা লঞ্চটিতে ছিলেন তার ফুপাতো ভাই, তার (ফুপাতো ভাইয়ের) ছেলে এবং এক শ্যালিকা। তিনজনকে খুঁজতে এসে রিপন জানান, তারা সবাই নিখোঁজ। হাসপাতাল ও ঘটনাস্থলে খোঁজ নিয়েও পাওয়া যায়নি হদিস।
রিপন বলেন, দুর্ঘটনার পর আমার ফুপাতো ভাই মইন এবং তার ছেলে আবদুল্লাহ ও শ্যালিকা আছিয়া নিখোঁজ রয়েছেন। হাসপাতাল ও ঘটনাস্থলে খোঁজ নিয়েও তাদের পাইনি। তাদের মতো বরগুনার আরও অনেক যাত্রী নিখোঁজ রয়েছেন।
বেঁচে ফেরা বামনা উপজেলার যাত্রী গোবিন্দ সাহা বলছেন, এ লঞ্চের অনেক যাত্রীই ছিলেন বরগুনার। আগুনে হতাহতদের অধিকাংশই এ জেলার বাসিন্দা। তারা বিভিন্ন প্রয়োজনে বাড়িতে ফিরছিলেন। রাত পৌনে ৩টার দিকে ইঞ্জিন রুম থেকে বিকট বিস্ফোরণের শব্দ হয়। মুহূর্তে গোটা লঞ্চ ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। এ সময় ডেকে থাকা ঘুমন্ত যাত্রীরা জেগে ওঠে ছোটাছুটি শুরু করেন। কেউ কেউ নদীতে ঝাঁপ দেন, আবার অনেকে চিৎকার করতে শুরু করেন। তিনি আরও বলেন, একপর্যায়ে যাত্রীদের উদ্ধারে কয়েকটি ট্রলার এগিয়ে আসে এবং তারা ট্রলারে উঠে তীরে নামেন। মূলত আগুন লাগার পর লঞ্চটি তীরে নোঙর করার মতো কেউ ছিল না। লঞ্চ জোয়ারের তোড়ে ভাসতে থাকে।
নিখোঁজ স্বজনরা জানিয়েছেন, তারা বরিশালের শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঝালকাঠি সদর হাসপাতাল ও ঘটনাস্থলে খোঁজ নিয়েও নিখোঁজদের বিষয়ে কিছু জানতে পারেননি।
স্বজনদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, নিখোঁজ ব্যক্তিরা হলেন বরগুনার মাইঠা এলাকার ইদ্রিস খান, নলী এলাকার আবদুল হাকিম, পাথরঘাটা টেংরার পপি আক্তার, পাথরঘাটা পৌরসভার তালতলার আবদুর রাজ্জাক, কালমেঘার কালীবাড়ির রাকিব মিয়া, বরগুনা সদরের হাফেজ তুহিনের মেয়ে (নাম অজ্ঞাত), সদরের ছোট আমতলীর জয়নব বেগম।
এ ছাড়াও রয়েছেন বরগুনা সদরের পরীরখাল এলাকার মা রাজিয়া, তার মেয়ে নুসরাত, ঢলুয়া এলাকার মোল্লারহোড়া গ্রামের একই পরিবারের মা তাসলিমা ও তার মেয়ে মিম তানিশা, ছেলে জুনায়েদসহ অজ্ঞাত চারজন রয়েছেন। এছাড়া বরগুনায় বেড়াতে আসা চাঁদপুরের মনোয়ারা, পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার রিনা বেগম ও তার মেয়ে রিমা নিখোঁজ রয়েছেন।
বরগুনার বামনা উপজেলার বুকাবুনিয়া গ্রামের বাসিন্দা গীতা রানী। দুই সন্তান স্বপ্নীল চন্দ্র হালদার ও প্রত্যয়কে (৬) নিয়ে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছিলেন গীতা রানী। লঞ্চে বড় ছেলে স্বপ্নীল নিখোঁজ হয়। স্বপ্নীল ঢাকার উত্তরা স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র। গীতার স্বামী চন্দ্র হালদার ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। তারা থাকেন রাজধানীর উত্তরায়। গীতা রানী বলেন, আগুন লাগার কিছু আগে স্বপ্নীল লঞ্চের টয়লেটে যায়। এরপরই আগুন লাগলে যাত্রীরা আত্মরক্ষায় দিগ্বিদিক ছুটতে থাকেন। স্বপ্নীলের জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ছোট ছেলেকে নিয়ে নিচে নামি। এক পর্যায়ে যাত্রীদের ধাক্কায় ছোট ছেলেকে ছেড়ে দিয়ে আমি লঞ্চ থেকে নেমে আসি এবং তাকেও হারিয়ে ফেলি। আবার লঞ্চে উঠে প্রত্যয়কে পেয়ে তাকে সঙ্গে নিয়ে স্বপ্নীলকে খুঁজতে থাকি। কিন্তু কোথাও তাকে খুঁজে পাইনি। সেখানকার লোকজন আমাকে মেডিকেলে খবর নিতে বললে আমি সেখানেও যাই। সব ওয়ার্ডে খোঁজ করেছি কিন্তু আমার স্বপ্নীলকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না।
প্রাণে বেঁচে ফেরা জেলার তালতলি উপজেলার সোনিয়া বেগম (২৫) জানান, লঞ্চে আগুন লাগার সময় তিনি ইঞ্জিন রুমের ওপরে দোতলার ডেকে অবস্থান করছিলেন। আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে ডেক গরম হয়ে চারদিক ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। এরপর লঞ্চের সঙ্গে বাঁধা দড়ি বেয়ে ছোট ছেলেকে নিয়ে নিচে নেমে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতরে তীরে ওঠেন। তবে তার মা রেখা বেগম এবং ৫ বছরের বড় ছেলে জুনায়েদ সিকদার এখনো নিখোঁজ।
মা, স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে ছুটিতে গ্রামের বাড়ি বরগুনায় ফিরছিলেন বায়িং হাউস কর্মকর্তা ইসমাইল হোসেন। ছুটি কাটাতে গ্রামে ফিরছিলেন তিনি। লঞ্চে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের মুহূর্তে উদ্ধারকারীদের একজন লাথি দিয়ে নদীতে ফেলে দেয় এক মেয়ে লামিয়াকে। পরে নদী থেকে উদ্ধার করে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গুরুতর দগ্ধ হয় লামিয়া। তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। আর ইসমাইলের মা মমতাজ বেগমকে বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হয়েছে। তবে অগ্নিকাণ্ডের মুহূর্তেই ইসমাইল হোসেন হারিয়ে ফেলেছেন তার স্ত্রী রাজিয়া ও ছোট মেয়ে নুসরাতকে। সপরিবারে ঢাকার উত্তর বাড্ডার সাঁতারকুল থাকেন ইসমাইল হোসেন। গ্রামের বাড়ি বরগুনা সদর উপজেলার এম বালিয়াতলী ইউনিয়নে। মেয়ে লামিয়া ৮ম শ্রেণি আর নুসরাত ২য় শ্রেণিতে পড়ে।
ইসমাইল হোসেন বলেন, রাত পৌনে ৩টার দিকে চিৎকার চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে যায়। সবাই ছোটাছুটি করছে। আমি তখন বোধশূন্য অবস্থা। একদিকে বৃদ্ধ মা, সঙ্গে শিশুকন্যা ও স্ত্রী। দ্রুত ছুটে যাই নিচে। লাইফ বয়া নিয়ে ফিরে এসে দেখি আমার মা ছাড়া আর কেউ সেখানে নেই। তখন আগুন ছেয়ে গেছে গোটা লঞ্চ। মাকে নিয়ে কোনোমতে উদ্ধারকারী ট্রলারে উঠে তীরে আসি। মাকে তীরে রেখে ট্রলারে করে খুঁজতে যাই আমার স্ত্রী ও সন্তানদের। কিন্তু কোথাও খুঁজে পাইনি। সকালে হাসপাতালে খুঁজে পাই মেয়ে লামিয়াকে। লামিয়ার মুখমণ্ডল আগুনে ঝলসে গেছে। আর মায়ের দুই হাত আগুনে পুড়ে বাঁকা হয়ে গেছে। তারা দু’জন চিকিৎসাধীন। ছোট মেয়ে নুসরাত আর স্ত্রী রাজিয়াকে এখনো খুঁজে পাইনি।
নারায়ণগঞ্জ থেকে বরগুনায় বা?ড়ির উদ্দেশে রওনা দিয়েছিল ১৩ বছরের রাকিবুল। তবে বা?ড়ি আর যাওয়া হয়?নি তার। লঞ্চে আগুনের খবর পেয়ে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া যাত্রীদের মধ্যে একমাত্র ছেলেকে হনে?্য হয়ে খুঁজছেন বাবা শাহজালাল। আগুনে পুড়ে যাওয়া লঞ্চ অ?ভিযান-১০ বা হাসপাতাল, কোথাও মিলছে না তার ছেলের খোঁজ।
জেলার পাথরঘাটা উপজেলার বা?সিন্দা শাহজালাল বলেন, প্রতিবেশী লোকমানও একই ল?ঞ্চে করে বরগুনা আস?ছিলেন। তার হাত পুড়ে গেছে। তিনিই সকালে আমাকে দুর্ঘটনার কথা জানান। এরপরই আ?মি দৌড়াতে দৌড়াতে ছুটে এসেছি। সন্ধ্যার দিকে সদরঘাট থেকে অ?ভিযান-১০ ল?ঞ্চে ওঠে রাকিবুল। এরপর আর কথা হয়?নি। আমার ছেলে নারায়ণগঞ্জে মাদ্রাসায় পড়তো। ওর কপালের ডান পাশে তিল রয়েছে।
বরগুনা সদরের রাজু আহমেদ ঢাকার খিলগাঁওয়ে ব্যবসা করেন। স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে ঢাকাতেই থাকেন। জমিজমার ভাগবাটোয়ারা সংক্রান্ত কাজে বৃহস্পতিবার রাতে এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে বাড়ির পথে রওনা দেন। লঞ্চের দোতলার ডেকে বিছানা পেতে রাতে চারজনই ঘুমিয়ে পড়েন। আশা ছিল ঘুম ভেঙে সকালে বাড়ি পৌঁছাবেন। কিন্তু বাড়ি যাওয়া আর হলো না।
পথে লঞ্চে মর্মান্তিক অগ্নি দুর্ঘটনায় কোনোরকমে প্রাণে বেঁচে শীতের রাতে নদী সাঁতরে কোনোরকমে তীরে উঠেছেন একজন। তিনি বলেন, বিকট শব্দে ঘুম ভাইঙ্গা যায়। আগুন লাগার ১৫ মিনিট পর লঞ্চ একটা চরে ভিড়ছিল। তখনো মাইনষের গায়ে আগুন লাগে নাই। সবাই দৌড়াদৌড়ি, কান্নাকাটি করতে আছিল। ওই সময় ইঞ্জিনরুমে কেউ ছিল না। চরে নোঙর করার লোক না থাকায় জোয়ারের তোড় লঞ্চ ভাসাইয়া মাঝগাঙ্গে লইয়া যায়। প্রায় এক ঘণ্টা ভাসতে ভাসতে অপর পাড়ের কাছাকাছি চইলা যায়। তহন পুরা লঞ্চে আগুন। আমি ওই সময় তিনতলা থেকে আমার মাইয়া লইয়া আর আমার বউ-পোলাডা লইয়া গাঙ্গে লাফ দেই। মরতে মরতে হাতুইড়া পারে উঠছি।