সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের জামিন আবেদনের শুনানি হবে বৃহস্পতিবার। তাকে আদালতের নির্দেশে কাশিমপুর কারাগারে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু তাকে যে প্রক্রিয়ায় গ্রেপ্তার এবং মামলা দেয়া হয়েছে তা নিয়ে উঠেছে নানা প্রশ্ন।
আর তাকে যদি ‘হাতে নাতে আটক’ করা হয়ে থাকে তাহলে মঙ্গলবার আদালতে হজির করে রিমান্ডের আবেদন কেন? মামলা হয়েছে দুই ধরনের আইনে। দণ্ডবিধি এবং অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে- যা আইনে সাংঘর্ষিক ।
রোজিনাকে সোমবার ‘বেআইনিভাবে’ সচিবালয়ে পাঁচ ঘন্টা আটক রাখার পর থানায় হস্তান্তর করা হয়। এরপর মামলা। কিন্তু এই পাঁচঘন্টা কীভাবে আটক রাখা হলো? রোজিনার আইনজীবী অ্যাডভোকেট প্রশান্ত কুমার কর্মকার বলেন,” এই বেআইনি আটকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ আছে। রোজিনা চাইলে এর বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবেন।”
রোজিনার স্বামী মনিরুল ইসলাম মিঠু সোমবার রোজিনাকে সচিবালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবের পিএস-এর রুমে আটকের পর খবর পেয়ে সেখানে যান। তিনি অভিযোগ করেন,”মোবাইল ফোনে কোনো ডকুমেন্টের ছবি তোলা বা কোনো ডকুমেন্ট চুরির ঘটনা ঘটেনি। পুরো বিষয়টিই সাজানো। তিনি স্বাস্থ্য বিভাগের নানা দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদন করায় তাকে কৌশলে ডেকে নিয়ে ওই মিথ্যা অভিযোগ দাঁড় করানো হয়েছে। আমার সামনেই তারা মোবাইল ফোন ও ব্যাগ চেক করে কিছু পায়নি।
রোজিনাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে পাঁচ ঘন্টা ধরে হেনস্তা করা হয় এবং তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ে বলে জানান তিনি। তিনি এখনো ট্রমার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। আর সোমবারই তিনি করোনা ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজ নেন সচিবালয়ের ক্লিনিকে।
রোজিনার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে দণ্ডবিধির ৩১৯ ও ৪১১ এবং অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের ৩ ও ৫ ধারায়। দণ্ডবিধির ওই ধারায় প্রকাশ্য কোনো জায়গা থেকে কিছু চুরির কথা বলা হয়েছে। আর অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের ধারায় গোপন কোনো জায়গা থেকে রাষ্ট্রের কোনো গুরুত্বপুর্ণ নথি নেয়ার কথা বলা হয়েছ। এই দুইটি ধারা একসঙ্গে প্রয়োগ সাংঘর্ষিক। প্রশান্ত কুমার হালদার বলেন,” এইভাবে মামলা করাই মামলাই প্রমাণ করে যে মামলাটি মিথ্যা এবং বেআইনি।আর মামলার অভিযোগের সাথে কোনো জব্দ তালিকা এবং জব্দ করা কোনো কিছু আদালতে উপস্থাপন করা হয়নি।”
থানায় মামলা করার আগে রোজিনাকে সচিবালয় থেকে একটি ফরোয়ার্ডিং দিয়ে পাঠানো হয়। তাতে শুধু মোবাইলে ছবি তোলার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এজাহারে তার সাথে সরাসরি নথি চুরির বিষয়টি নতুন করে যুক্ত করা হয়।
রোজিনাকে হয়রানির উদ্দেশ্যের বড় প্রমাণ মেলে পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদনে। চুরির ঘটনায় ‘হাতে নাতে’ যদি আটক করা হয় তাহলে তো চুরির মালও উদ্ধার হয়ে গেল। তারপরও রিমান্ডে চাওয়ার উদ্দেশ্য কী? প্রশ্ন আইনজীবী প্রশান্ত কুমার কর্মকারের।
রিমান্ড আবেদনের যে কপিটি ডয়চে ভেলের হাতে এসেছে তাতে বলা হয়েছে,” আসামির(রোজিনা) কাছ থেকে যে গুরুত্বপূর্ণ নথি উদ্ধার করা হয়েচে তা প্রচার হলে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন এবং অন্য দেশের সাথে সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা আছে। এ কারণেই তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ প্রয়োজন।” আরো বলা হয়েছে ,” আসামিকে জামিন দিলে চিরতরে পলাতক হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে।”
পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আবু দাবি করেন,” ওই নথিগুলো ছিলো বিভিন্ন দেশের সাথে টিকা সংক্রান্ত চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকের।” সেগুলো আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে কিনা জানাতে চাইলে তিনি দাবি করেন,” জব্দ তালিকা আছে।”
এই পুরো ঘটনা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আইনজ্ঞ শাহদীন মালিক বলেন,” তাদের অভিযোগ সঠিক ধরে নিলে তাকে হাতেনাতে আটক করা হয়। তাই যদি হয় তাহলে আইন হলো তাকে তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশে দেয়া। সচিবালয়ে পুলিশ আছে। কিন্তু তা না করে রোজিনাকে পাঁচ ঘন্টা আটকে রাখা হলো। এতে প্রমাণ হয় তার বিরুদ্ধে ওই সময়ে মিথ্যা অভিযোগ তৈরি করা হয়েছে। পুলিশ ছাড়া আর কারোর কাউকে আটকে রাখার ক্ষমতা নাই।”
তিনি মনে করেন, রোজিনার ব্যাপারে যা করা হয়েছে তা আক্রোশ থেকে করা হয়েছে। কারণ রোজিনা গত কয়েক মাস ধরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনিয়ম , দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে রিপোর্ট করে আসছিলেন।
তিনি বলেন,” রোজিনার বিরুদ্ধে তাদের আক্রোশটা আরো স্পষ্ট হয় অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে মামলার মধ্য দিয়ে। ১০০ বছরের পুরনো ১৯২৩ সালের আইনে সর্বশেষ মামলার নজির কবে আছে? আর এটা তো ঔপনিবেশিক আইন। শেষ পর্যন্ত রোজিনার বিরুদ্ধে একটি মামলা দিতে হবে তাই স্বাধীন দেশে ঔপনিবেশিক কালা কানুন ব্যবহার ব্যবহার করা হলো। আগে ফৌজদারি আইন বিরোধী রাজনীতিবিদদের শায়েস্তা করতে ব্যবহার করা হয়েছে। এখন সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে।”
” আমি মনে করি গতকাল( সোমবার) তাকে আটক এবং আজ(মঙ্গলবার) আদালতে হাজির করা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক ঘটনা।”
এদিকে সাংবাদিক ইউনিয়নের সোমবারের ভূমিকা ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ায় তারা মঙ্গলবার রোজিনার মুক্তি দাবি করে বিবৃতি দিয়েছে। বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠন ঢাকায় বিক্ষোভ করেছে। ডিউজের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলম খান বলেন,” আমরা ব্যক্তিগতভাবে ঘটনার পর পরই প্রতিবাদ করেছি। তবে সাংগঠনিকভাবে প্রতিবাদ করতে প্রক্রিয়ার কারণে সময় লেগেছে।”
তিনি মনে করেন,” সাংবাদিকরা তথ্য সংগ্রহ করবেন। এটাই তাদের কাজ। যদি মনে হয় তাতে আইনের লঙ্ঘন হয়েছে তাহলে প্রেস কাউন্সিলে প্রতিকার চাওয়া যায়। কিন্তু সরাসরি মামলা ও গ্রেপ্তার স্বাধীন সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে যায়। আমরা রোজিনার মুক্তি এবং তার সাথে যা করা হয়েছে তার তদন্ত ও বিচার চাই।”
তিনি সাংবাদিক সুরক্ষা আইনেরও দাবি জানান।