মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান
রমজানকে সিয়াম সাধনার এক উপযুক্ত মাস হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সিয়াম অর্থ আত্মসংযম। রোজা আমাদের মিথ্যাচারিতা, কাউকে কষ্ট দেয়া, গীবত করা, মিথ্যা বলা, চোখ, জিহবা, বা যে কোন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের হেফাজত করা এবং হারামভাবে উপার্জিত মাল না খাওয়ার মধ্য দিয়ে সংযমী হতে শেখায়।
দেহকে আত্মনিয়ন্ত্রণে আনতে হলে দৈহিক প্রেরণাকে সংযত করতে হয়। আত্মিক শক্তিকে সমৃদ্ধ করতে হয়। এই যে আত্মিক শক্তিকে দৃঢ় করার অনুশীলন তা সব সময়ই অনুসরনীয়। কিন্তু বছরের ১১টি মাসে আমরা আস্তে আস্তে এই অনুশীলন থেকে দূরে থেকে আমাদের আত্মিক শক্তিকে দুর্বল করে ফেলি।
যে কারণে পবিত্র রমজানে তাকওয়া বা খোদাভীতির এ অনুশীলন অব্যাহত রাখতে সুস্পষ্টভাবে আহ্বান জানানো হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘প্রকৃত মুজাহিদ তো সে-ই যে তার নিজের নফস ও রিপুর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে।’ (মুসনাদে আহমাদ) সিয়াম সাধনার বৈশিষ্ট্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো অনর্থক কথাবার্তা, মিথ্যাচার, পরনিন্দা, গিবত, কটুবাক্য ব্যবহার প্রভৃতি গর্হিত কাজ থেকে জীবকে সংযম অবস্থায় রাখতে হবে। মাহে রমজানের রোজার উদ্দেশ্য হচ্ছে পশুপ্রবৃত্তিকে দমন করা এবং ইমানি শক্তিতে বলীয়ান হওয়া।
কিন্তু আমরা রমজান এলেই লক্ষ্য করি তাকওয়া বা সংযমী হওয়ার শিক্ষার কোন তোয়াক্কা না করে আসাধু ব্যবসায়ীরা ডাল, চিনি, মাছ-মাংসসহ, তেল, পেঁয়াজ, মসলার দাম বাড়িয়ে দেন। শ্রেণী নির্বিশেষে সব ধর্মপ্রাণ মুসলমান মূল্যবৃদ্ধির এ অসহনীয় চাপে না পারে রোজা পালন করতে না পারে জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহ করতে। এবার আন্তর্জাতিক প্রতিকূলতায় এ বাজার মূল্য যেন আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। যে কারণে রমজানে আগেই সারা দেশে টিসিবির মাধ্যমে নিত্যপরোজনীয় দ্রব্যে বিক্রির জন্য সরকার বিশেষ কার্ডে এক কোটি পরিবারের মধ্যে পণ্য বিক্রির ব্যবস্থা নিয়েছে।
আসধু ব্যবসায়ীরা যেমন অতিরিক্ত মুনাফার জন্য সংযমী হতে পারছেন না তেমনি একশ্রেণীর ভোক্তা বছরের ১১ মাস প্রচুর খাওয়ার পর রমজানের এক মাস কিছুটা কম খেয়ে পশু প্রবৃত্তি দমন ও সংযম সাধনায় আত্মনিয়োগ করতে পারছেন না। উল্লেখ্য, যাদের ইন্দ্রীয় তৃষ্ণা প্রবল তাদের রমজান ছাড়াও অন্য মাসেও রোজা রাখার জন্য উপদেশ দেওয়া হয়েছে।
রমজান মাসে অসহনীয় দ্রব্য মূল্যের লাগাম টানতে যখন সংযমী হওয়ার অনুশীলন অকার্যকর প্রতিপন্ন হয়, তখন সরকারকেই বাজার মূল্য নিয়ন্ত্রণে এগিয়ে আসতে হচ্ছে প্রতি বছরই। এ বছর পণ্য আমদানিতে শুল্ক ছাড়ের পাশাপাশি বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়েছে।
সরকার ইতোমধ্যে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সারাদেশে কঠোর বাজার মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা নিয়েছে। চাহিদা অনুযায়ী বাজারে পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে থাকবে প্রশাসন। দাম বাড়াতে তৎপর অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি বন্ধে পুরো রমজান মাসজুড়ে বাজার তদারকি করবে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং টিম বাজারে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করবে। কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি ও অবৈধ মজুদের বিরুদ্ধে তিনটি গোয়েন্দা সংস্থাকে নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি ঢাকা সিটি করপোরেশন, র্যাব, নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তর এবং জেলা প্রশাসনের একাধিক টিম বাজার মনিটরিংয়ে কাজ করবে।
খবরে প্রকাশ বাজার ব্যবস্থাপনার ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণটা শিথিল। আর ব্যবসায়ীরা প্রতি বছরই দাম বাড়ানোর নিত্যনতুন কৌশল নেয়। এ কারণে বাজার তদারকির যে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়, সেটা বাস্তবে কার্যকর করা যায় না। আমদানিকারক থেকে শুরু করে খুচরা বিক্রেতা সবার মধ্যেই রোজাকে ঘিরে মুনাফা করার একধরনের অসৎ প্রতিযোগিতা শুরু হয়। সবাই দাম বাড়ায়। আর তার খড়গ পড়ে সাধারণ মানুষের ঘাড়ে। সংযম ও পবিত্রতার এ মাসে আমাদের দেশের অসাধু ব্যবসায়ীরা কি তাকওয়া অর্জনে আত্মনিয়োগ করবেন না?
রোজা মানুষকে সংযমী মনোভাব গড়ে তোলার অতুলনীয় শিক্ষা দেয়। সংযত ও নিষ্ঠাবান হওয়ার যে শিক্ষা সিয়ামে রয়েছে, আমরা যেন ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি, যার ওপর নির্ভর করবে প্রকৃত রোজাদারদের সংযম সাধনা।