সাপে কাটা রোগীদের হাসপাতালে নেন তিনি স্কুলে পড়ার সময় থেকেই বন্য প্রাণী ভালোবাসতেন । কোথাও বন্য প্রাণী আটকা পড়েছে শুনলেই ছুটে গিয়ে মুক্ত করে দিতেন । বিষধর সাপ ধরার খবর পেলেও ছুটে যেতেন । প্রাণীটিকে মুক্ত করার উদ্যোগ নিতেন । সাপ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে নানাভাবে প্রশিক্ষণও নেওয়া আছে তাঁর । তিনি সাপের জাত , বিষ প্রয়োগ , অ্যান্টিভেনোমের বিষয়ে যথেষ্ট ধারণা রাখেন । তাঁর কারণে হাসপাতালে সাপে কাটা রোগীরা চিকিৎসা পাচ্ছেন । বুঝতে পারেন , সাপে কাটার কারণে প্রতিবছর অনেক মানুষ মারা যায় দেশে । এর মূল কারণ গ্রামের মানুষের অজ্ঞতা । সাপে কাটা রোগীকে হাসপাতালে না নিয়ে সাধারণত ওঝার কাছে নিয়ে যায় গ্রামের লোক । সময়মতো চিকিৎসা না পেয়ে মারা যায় মানুষটি । সম্প্রতি হরিণাকুণ্ডু উপজেলার ধুলিয়া গ্রামের কৃষক মোজাম্মেল হককে ( ৪৬ ) সাপে কাটে । পরিবারের লোকজন তাঁকে নিয়ে যান এক ওঝার বাড়িতে । সেখানে ঝাড়ফুঁক করা হয় । কিন্তু রোগীর অবস্থা ক্রমেই খারাপ হতে থাকে । খবর পেয়ে সেখানে ছুটে যান মারুফ । স্বজনদের বুঝিয়ে রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যান । এরপর চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন মোজাম্মেল । রোগীর বাড়ি গিয়ে মারুফ শুরুতেই রোগীকে শান্ত থাকার পরামর্শ দেন । বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে কাপড় দিয়ে আক্রান্ত স্থানটি বাঁধা , কোন হাসপাতালে গেলে দ্রুত সেবা পাওয়া যাবে , তা মুঠোফোনে যোগাযোগ করে ব্যবস্থা নেন । কোন হাসপাতালে অ্যান্টিভেনম আছে এবং কোথায় চিকিৎসক প্রস্তুত আছেন , তারও খোঁজ নেন তিনি । ঝিনাইদহ জেলার ছয় উপজেলাসহ পাশের চুয়াডাঙ্গা সদর , আলমডাঙ্গা উপজেলা , কুষ্টিয়া সদর উপজেলা থেকেও মারুফের কাছে ফোন আসে । এসব এলাকার মধ্যে হরিণাকুণ্ডু ও শৈলকুপাতে সাপের উপদ্রব বেশি বলে আশপাশের কয়েকটি হাসপাতালের চিকিৎসকেরাও জানিয়েছেন । কারণ , ওই দুই উপজেলা থেকে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক সাপে কাটা রোগী তাঁদের কাছে আসে । মারুফের এসব কাজ প্রশংসার দাবি রাখে বলে মনে করেন স্থানীয় তাহেরহুদা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনজুর রাশেদ । তিনি বলেন , তাঁর কারণে এলাকার সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা আবদুল্লাহ মারুফ ( ৪৫ ) স্বজনদের বুঝিয়ে রোগীকে নিয়ে যান হাসপাতালে । বেঁচে যায় একটি প্রাণ । এভাবে একে একে সাপে কাটা ৩০০ মানুষকে হাসপাতালে নিয়ে জীবন বাঁচিয়েছেন মারুফ । পাঁচ বছর ধরে নিরন্তর কাজটি করে চলেছেন ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলার রামনগর গ্রামের এই যুবক । এর মধ্যে অর্ধেক রোগীকে গ্রাম্য ওঝার অপচিকিৎসা থেকে বাঁচিয়েছেন । ঝিনাইদহ সদর , হরিণাকুণ্ডুসহ আশপাশের কয়েকটি উপজেলায় মারুফ এতটাই জনপ্রিয় যে কাউকে সাপে কাটলেই সঙ্গে সঙ্গে তাঁর কাছে ফোন আসে । স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ এলাকার অনেকের কাছেই তাঁর মুঠোফোন নম্বর আছে । খবর পাওয়ামাত্র মোটরসাইকেলে ছুটে আসেন মারুফ । বিষধর সাপে কাটা রোগীকে প্রথম ১০০ মিনিটের মধ্যে চিকিৎসা দেওয়া গেলে বাঁচানো যায় । এমন রোগীর ব্যাপারে প্রাথমিকভাবে করণীয় সম্পর্কে প্রশিক্ষণ নেওয়া আছে তাঁর । শুরুতেই সে কাজটি করেন । তারপর রোগী নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স বা অন্য কোনো যানবাহনে কাছের হাসপাতালে ছোটেন । নেহাত কিছু না পেলে নিজের মোটরসাইকেলে বসিয়েই রোগীদের প্রথম আলো হাসপাতালে নেন । সদরসহ মারুফের এই উদ্যোগের ফলে ঝিনাইদহ আশপাশের উপজেলার হাসপাতালগুলোতে সাপে কাটা রোগীদের হাসপাতালে আসার পরিমাণ আগের চেয়ে বেড়ে গেছে , জানালেন ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালের চিকিৎসক রাজীব চক্রবর্তী । তিনি গণমাধ্যম প্রতিনিধিকে বলেন , আবদুল্লাহ মারুফ সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসাবিষয়ক বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন । ফিরেছে । তিনি মানুষ হিসেবেও বেশ পরোপকারী । খোঁজ নিয়ে জানা গেল , গ্রামে বেশ কিছু ধানি জমি আছে মারুফের । রয়েছে মাছের খামার । এসবই দেখাশোনা করেন তিনি । বলেন , উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন । এরপর সাংসারিক কারণে কর্মজীবনে ঢুকতে হয় । এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন , রোগীর কাছে ছোটাছুটিতে যে খরচা , সেটা তিনি নিজেই বহন করেন । তবে রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার খরচ রোগীর স্বজনেরা দেন । তিন শ রোগীকে হাসপাতালে নেওয়ার হিসাব সম্পর্কে জানতে চাইলে মারুফ বলেন , তাঁর কাছে একটা হিসাব আছে । আবদুল্লাহ মারুফ বলেন , বর্তমানে এই অঞ্চলে খৈয়া গোখরা ও পদ্ম গোখরা , কালাস , শঙ্খিনী ও চন্দ্রবুড়া সাপে কাটার ঘটনা বেশি । এগুলোর সবই বিষধর । তবে সব সময় সাপ মানুষকে কামড় দিয়ে বিষ প্রয়োগ করে না । তাঁর স্ত্রী স্কুল শিক্ষক ইয়াসমিন আক্তার । এই দম্পতির রামিসা মালিয়াথ ( ১৪ ) ও আবদুল্লাহ আজয়াদ ( ১১ ) নামের দুটি সন্তান রয়েছে । স্বামীর এসব কাজে গর্বিত ইয়াসমিন আক্তার । তিনি বলেন , ‘ আমিও সব সময় তাঁকে সহযোগিতা করি । ‘ ঝিনাইদহের সব কটি হাসপাতালে এই মুহূর্তে পর্যাপ্ত অ্যান্টিভেনম মজুত রয়েছে । রোগী এলেই চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব বলে জানালেন সিভিল সার্জন শুভ্রা রানী দেবনাথ । গতকাল বৃহস্পতিবার তিনি আমাদের বলেন , আবদুল্লাহ মারুফ অবশ্যই সমাজে ভালো কাজ করছেন । তাঁর কারণে সাপে কাটা রোগীদের হাসপাতালে আসা বেড়েছে । সবাইকে এ বিষয়ে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে সিভিল সার্জন বলেন , সাপে কাটলে ওঝার কাছে নয় , দ্রুততম সময়ের মধ্যে হাসপাতালে আসতে হবে ।