মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ.) বাংলাদেশে ইসলামী শিক্ষার আলোকবর্তিকা
প্রকাশ: ২০ মার্চ, ২০২৩, ১২:৩৩ পূর্বাহ্ণ |
অনলাইন সংস্করণ
মুহাম্মাদ হেদায়াতুল্লাহ
মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ.) (১৮৯৬-১৯৬৯) ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম ইসলামী শিক্ষাবিদ ও সমাজসংস্কারক। ইসলামী শিক্ষা প্রসারে রাজধানীর লালবাগ, ফরিদাবাদ, বড় কাটরা, গওহরডাঙ্গাসহ অসংখ্য ঐতিহ্যবাহী মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা তিনি। ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সক্রিয় নেতা।
জন্ম ও পারিবারিক ঐতিহ্য : ১৩০২ বঙ্গাব্দের (১৮৯৬) ২ ফাল্গুন গোপালগঞ্জ (বৃহত্তর ফরিদপুর) জেলার টুঙ্গিপাড়া উপজেলার গওহরডাঙ্গা গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্বপুরুষরা প্রায় তিন শ বছর আগে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে আরব থেকে বাংলায় আসেন। তাঁর পিতা মুন্সি আবদুল্লাহ ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহে এবং পিতামহ চেরাগ আলী সাইয়েদ আহমদ বিন ইরফান বেরেলভি (রহ.)-এর সঙ্গে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন।
পড়াশোনা : মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া ও বরিশালের সুটিয়াকাঠী স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। এরপর যশোরের নোয়াপাড়ায় স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। এরপর কলকাতা আলিয়া মাদরাসার অ্যাংলো পারসিয়ান বিভাগে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯২০ সালে সেখানে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বৃত্তি নিয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে কলেজ ত্যাগ করে হাকিমুল উম্মাত মাওলানা আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সাহচর্যে চলে যান। এরপর থানভি (রহ.)-এর পরামর্শে সাহারানপুরের মাজাহিরুল উলুম মাদরাসায় ভর্তি হন। সেখানে কয়েক বছর পড়ার পর দারুল উলুম দেওবন্দে উচ্চশিক্ষা অর্জন করেন। আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরি, মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানি ও মাওলানা এজাজ আলী (রহ.)-এর কাছে হাদিসের পাঠ গ্রহণ করেন।
বর্ণাঢ্য কর্মজীবন : ১৯২৮ সালে দেশে ফিরে পুরো জীবন তিনি হাদিসের অধ্যাপনা করেছেন। বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে তিনি দেশের আনাচে-কানাচে অনেক ঐতিহ্যবাহী মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথমে তিনি ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জামিয়া ইউনুসিয়া মাদরাসায় হাদিসের পাঠদান করেন। সেখানে তাঁর সহকর্মী হিসেবে ছিলেন মাওলানা তাজুল ইসলাম, মাওলানা আবদুল ওয়াহহাব পীরজি হুজুর, মাওলানা মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জি হুজুর (রহ.)-সহ আরো অনেকে। এরপর ১৯৩৫ সালে বাগেরহাটের গজালিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৩৬ সালে আশরাফুল উলুম বড় কাটরা মাদরাসা, ১৯৩৭ সালে গওহরডাঙ্গা মাদরাসা, ১৯৫০ সালে লালবাগ মাদরাসা ও ১৯৫৬ সালে ফরিদাবাদ মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন।
গবেষণা সংস্থা প্রতিষ্ঠা : মাদরাসা পরিচালনা ও পাঠদানের পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন সমাজসংস্কারমূলক কাজে নিয়োজিত ছিলেন। ইসলামী আদর্শ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১৯৪০ সালে তিনি ‘খাদেমুল-ইসলাম জমাআত’ এবং মিশনারি প্রকল্প প্রতিরোধে ‘আঞ্জুমান-ই-তাবলিগুল-কুরআন’ (কোরআন প্রচার সমিতি) প্রতিষ্ঠা করেন। তা ছাড়া আল্লামা নূর মোহাম্মদ আজমী (রহ.)-এর পৃষ্ঠপোষকতায় ‘ইদারাতুল-মাআরিফ’ নামে একটি ইসলামী গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করেন। যোগ্য আলেমদের তত্ত্বাবধানে এই প্রতিষ্ঠান থেকে অনুবাদ, রচনা, প্রবন্ধ তৈরির মাধ্যমে আধুনিক সমস্যার ইসলামী সমাধানসহ বিভিন্ন নতুন বিষয়ে গবেষণা হতো। প্রথম দিকে আল্লামা হারুন ইসলামাবাদী (রহ.) এই প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন।
মক্তব ও প্রাথমিক শিক্ষার ইসলামীকরণ : বাঙালি মুসলিমদের মধ্যে ধর্মীয় শিক্ষা প্রসারে শিশুদের জন্য মক্তব ব্যবস্থার পুনর্জাগরণে তাঁর ভূমিকা ছিল অপরিসীম। তা ছাড়া ধর্মীয় ও জাগতিক শিক্ষার সমন্বয়ে প্রাথমিক স্তরের পাঠক্রমের নতুন বিন্যাসেও তাঁর অবদান রয়েছে। তাঁরই স্বপ্ন বাস্তবায়নে মাওলানা কারি বেলায়েত (রহ.) নুরানি পদ্ধতি চালু করেছেন।
রাজনৈতিক ভূমিকা : তিনি আল্লামা সাব্বির আহমেদ উসমানি (রহ.) ও আল্লামা জফর আহমদ উসমানি (রহ.)-এর নেতৃত্বে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় জনমত গড়তে অবদান রাখেন। সিমলায় মুসলিম লীগের মহাসম্মেলনে ভাষণের পর তাঁকে অবিভক্ত বাংলার মুসলিম লীগের সভাপতি হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হলে তিনি তা ফিরিয়ে দেন। এ সময় তিনি পূর্ব পাকিস্তান জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সভাপতি ছিলেন। দেশভাগের সময় সীমান্ত রেফারেন্ডাম ও সিলেট রেফারেন্ডামে আলেমদের মাধ্যমে সীমান্ত প্রদেশ ও সিলেট জেলা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। এতে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান সরকারের হঠকারিতার কারণে মুসলিম লীগকে চিরদিনের জন্য বর্জন করেন।
রচনা ও অনুবাদ : তিনি শতাধিক পুস্তক রচনা ও অনুবাদ করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গ্রন্থ হলো হক্কানী তফসীর, জীবনের পরিচয়, চরিত্র গঠন, বেহেশতী জেওর, তবলীগে দ্বীন, বুখারী শরীফ ইত্যাদি।
ইন্তেকাল : ১৯৬৯ সালের ২১ জানুয়ারি তিনি ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর।