দাবি উঠেছিল ৫৭ ধারা বাতিলের বিষয়টি নিয়ে। ‘৫৭ ধারা থাকবে না’ বলেছিলেন অনেক মন্ত্রী, এমনকি পুলিশও। নামে না থাকলেও, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫, ২৮, ২৯, ৩১ ধারায় ৫৭ ধারা প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। যা আরও বিস্তৃত, আরও ভীতিকর। তা নিয়ে আলোচনায় যাওয়ার আগে, ‘আলোচনা’ বিষয়ে দু’একটি কথা।
তথ্য প্রযুক্তিমন্ত্রী বলেছেন, ‘আইনটি সম্পন্ন করার প্রক্রিয়া চলাকালীন সবার সঙ্গে লাইন বাই লাইন আলোচনা করা হয়েছে। সবার মতামত নিয়ে করা হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন।’
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে সম্পাদক- সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন, মতামত নিয়েছেন, কথা সত্য। কিন্তু সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ‘আলোচনা’র বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে, তা বলা যাচ্ছে না। সম্পাদক পরিষদ ও সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ পরিষ্কার করেই তা বলছেন।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কয়েকটি ধারা প্রসঙ্গে আসি।
১. আইনটির ২৫ ধারায় লেখা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ডিজিটাল মাধ্যমে আক্রমণাত্মক, মিথ্যা বা ভীতি প্রদর্শনমূলক, তথ্য- উপাত্ত প্রেরণ, রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বা সুনাম ক্ষুণ্ণ, বিভ্রান্তি ছড়ানো বা অপপ্রচার… করলে, ৩ বছরের কারাদণ্ড ও ৩ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
২. আইনের ৪৩ ধারাবলে একজন পুলিশ অফিসার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়া তল্লাশি করতে পারবেন, জব্দ করতে পারবেন, গ্রেপ্তার করতে পারবেন। আদালতের অনুমোদন ছাড়া, শুধু ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সির মহাপরিচালকের অনুমতি নিলেই চলবে। একজন আমলা বা সরকারের পছন্দের কেউ হবেন মহাপরিচালক। সুতরাং অনুমোদন নেওয়ার প্রক্রিয়াটা কেমন হবে, সহজেই তা অনুমেয়।
এই ধারা অনুযায়ী, ‘যদি কোনো পুলিশ অফিসারের এইরূপ বিশ্বাস করিবার কারণ থাকে যে কোনো স্থানে এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ সংঘটিত হইয়াছে বা হইতেছে বা হইবার সম্ভাবনা রহিয়াছে বা সাক্ষ্য প্রমাণাদি হারানো, নষ্ট হওয়া, মুছিয়া ফেলা ফেলা, পরিবর্তন বা অন্য কোনো উপায়ে দুষ্প্রাপ্য হইবার বা করিবার সম্ভাবনা রহিয়াছে’ – তাহলেও তিনি তল্লাশি- গ্রেপ্তার করতে পারবেন। গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে যদি বিষয়টি বিবেচনা করা হয়, তবে একটি সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পরেই নয়, প্রকাশিত হতে পারে এটা ভেবেও পুলিশ তল্লাশি- গ্রেপ্তার- জব্দ করতে পারবেন।
৩. ৩২ ধারার ‘গুপ্তচরবৃত্তি’ বিষয়টি নিয়ে সর্বমহলের আপত্তি ছিল। গুপ্তচরবৃত্তির পরিবর্তে সেখানে ‘অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ‘গুপ্তচরবৃত্তি’র চেয়ে অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট আরও বিস্তৃত, আরও ভীতিকর।
উল্লেখ্য আইনটি ব্রিটিশরা তৈরি করেছিল ১৯২৩ সালে। দখলদারিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যে, নিপীড়ন- নির্যাতন এবং মানুষের মুখ বন্ধ রাখতে বাধ্য করাই ছিল ব্রিটিশদের উদ্দেশ্য। পাকিস্তানি সামরিক শাসকেরা বাঙালি জাতির প্রতিবাদ স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্যেও ব্যবহার করেছে ঔপনিবেশিক এই কালো আইন। ২০১৮ সালে সেই আইন আবার ফিরিয়ে আনা হলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ধারায়।
‘সরকারি গোপনীয়তা ভঙ্গের অপরাধ ও দণ্ড’ বিষয়ে লেখা হয়েছে ‘কোনো ব্যক্তি অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট-এর আওতাভুক্ত কোনো অপরাধ কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ডিজিটাল মাধ্যমে সংঘটন করেন বা করিতে সহায়তা করেন, তাহা হইলে সর্বোচ্চ ১৪ বৎসর কারাদণ্ডে বা অনধিক ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।’
ধরুন একটি ব্যাংকে হাজার কোটি টাকা জালিয়াতির ঘটনা ঘটল। এখন প্রায় সব তথ্য কম্পিউটারেই থাকে। গণমাধ্যম কর্মী হিসেবে কেউ যদি সেই নথি- তথ্য সংগ্রহ করেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট অনুযায়ী মামলা করা যাবে। ১৮০ দিনের মধ্যে তার বিচার সম্পন্ন করে ১৪ বছর কারাদণ্ড এবং ২৫ লাখ টাকা জরিমানা করা যেতে পারে।
একটি উদাহরণ দেই। মিয়ানমারে সম্প্রতি রয়টার্সের দুই সাংবাদিককে সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হলো। তাদের অপরাধ কী ছিল জানেন? তারা রোহিঙ্গা নিধনের তথ্য সম্বলিত নথি সংগ্রহ করেছিল। এই অপরাধে গ্রেপ্তার এবং দণ্ড দেওয়া হয়েছে। সুতরাং বেসিক ব্যাংকের টাকা জালিয়াতির প্রমাণ বা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির তথ্য সংগ্রহ করলেও ‘সরকারি গোপনীয়তা ভঙ্গ’র দায়ে অভিযুক্ত করা যাবে।
৪. ২৮ ধারায় লেখা আছে, ধর্মীয় অনুভূতি বা মূল্যবোধের ওপর আঘাত করে এমন কিছু কেউ প্রকাশ বা প্রচার করলে তা অপরাধ হবে। সাজা হবে সর্বোচ্চ ৫ বছর কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড।
কার ‘অনুভূতি’ কেমন, কীসে কার অনুভূতিতে আঘাত লাগবে? কারও কথা বা লেখার প্রেক্ষিতে ‘অনুভূতি’তে আঘাত লেগেছে মনে করে কেউ একজন থানায় গেলেন, পুলিশ কর্মকর্তারও মনে হলো যে তার ‘অনুভূতি’তে আঘাত লাগার বিষয়টি সঠিক, গ্রেপ্তারে আর কোনো বাধা নেই।
৫. মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতার বিরুদ্ধে অপপ্রচারে (প্রোপাগান্ডা), জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে অপপ্রচার অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। এর জন্যে ১০ বছর কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ১ কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে।
কোনটা অপপ্রচার বা প্রোপাগান্ডা আর কোনটা গবেষণালব্ধ ইতিহাসের উপাদান, তা বিবেচনার মাপকাঠি কী? একজন পুলিশ কর্মকর্তা তা বিবেচনা করবেন? মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ। অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধ, জাতির পিতা, জাতীয় পতাকা- সংগীতকে অশ্রদ্ধা- অসম্মান করার অধিকার কারও থাকা উচিত নয়। কিন্তু আইন করে যদি প্রতিবন্ধকতার দেয়াল নির্মাণ করা হয়, তবে প্রয়োজনীয় গবেষণা করা যাবে? মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণার প্রয়োজনীয়তা তো শেষ হয়ে যায়নি।
৬. ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ যেভাবে পাস হলো, তার অনেকগুলো ধারা শুধু সংবাদ মাধ্যমের জন্যে নয়, রাজনৈতিক নেতা- কর্মী, নাগরিক সমাজ, মানবাধিকার কর্মীদের জন্যেও আতঙ্কজনক। এই আইনের প্রয়োগ শুরু হলে মত প্রকাশের স্বাধীনতা বলে কিছু অক্ষুণ্ণ থাকার কথা নয়। সবচেয়ে বড়ভাবে চেপে ধরবে ‘সেলফ সেন্সরশিপ’।
৭. শেষ করি ‘আলোচনা’র প্রসঙ্গ দিয়ে। ‘আলোচনা’ করে কোনো কোনো ক্ষেত্রে যে দণ্ড ছিল যাবজ্জীবন, তা ১০ বছর, ৩ কোটি টাকা জরিমানা থেকে ১ কোটি করা হয়েছে। তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রী বলেছেন, অনেক দেশ ও সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গেও আলোচনা করা হয়েছে। ১০টি পশ্চিমা দেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনীতিকরাও সুনির্দিষ্ট করে আইনের অনেকগুলো ধারা নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিলেন। শাস্তি এবং অর্থদণ্ড একটু কমিয়েই কি বলে দেওয়া যায় ‘আলোচনা’ করে আইন করা হয়েছে? আপত্তি কিন্তু এমন ছিল না যে, যাবজ্জীবন শাস্তি কমাতে হবে। আপত্তি ছিল সুনির্দিষ্ট কিছু ধারা সংশোধন বা বাদ দিতে হবে। তা করা হয়নি।
সাংবাদিক নেতা মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল বলেছেন, ‘…আইনটি পাশ করার আগে আরও একবার আলোচনায় বসার কথা ছিল। তা করা হয়নি।’ আপত্তিগুলোর কতটা বাদ দেওয়া হলো, তা দেখার সুযোগ না দিয়েই আইন পাস করা হয়েছে।