সঞ্জিব দাস, গলাচিপা (পটুয়াখালী) প্রতিনিধিঃ
“পালকিচলে! পালকিচলে! গগন-তলে আগুন জ্বলে। স্তব্ধ গায়ে আদুল গায়ে, যাচ্ছে কারা রৌদ্র সারা!”কবি সত্যেন্দ্রনাথে লেখা পালকি কবিতা বইয়ের পাতায় আজও থাকলে বাস্তবে নেই এই ঐতিহ্যের বাহনটি। পালকি ছিল এক সময়ে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী ও প্রাচীন বাহন। মানুষ বহন করার কাজেই এর ব্যবহার হতো। সাধারণত ধনী গোষ্ঠী এবং সম্ভ্রান্ত বংশের লোকেরা এর মাধ্যমে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ভ্রমণ করতেন। কিন্তু এখন তা পুরোপুরি বিলুপ্ত।
পালকির ইতিহাস- ধারণা করা হচ্ছে প্রাচীনকালে দেব-দেবীকে আরোহনবা দেব-দেবীর মূর্তি বহনের জন্য পালকি সদৃশ বাহন ব্যবহার করা হতো। অনেক প্রাচীন মন্দিরেও পালকি দিয়ে দেবতা বহনের দৃশ্য ভাস্কর্য আকারে তুলে ধরা হয়েছে। হিন্দুদের রামায়নেও আনুমানিক খ্রীষ্টপূর্ব ২৫০ সালের সময়ের দিকে পালকির উল্লে¬খ পাওয়া যায়। ব্রিটিশ শাসন আমলে ইউরোপের উচ্চ শ্রেণীর সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা এই পালকিতে চলাচল করতেন। তবে উপমহাদেশে রেলগাড়ি প্রচলেন পর ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের মাঝে পালকির ব্যবহার অনেক টাই কমে আসে।
ইউরোপের পালকি গুলোকে শোবার উপযোগী করে বানানো হতো। কোন কোন পালকি খোলা হতো আবার কোনটি হতো বন্ধ। মিশরীয় চিত্রকর্মেও পালকির দেখা পাওয়াযায়। পারস্য রাজ্যে ও পালকির অস্তিত্বছিল। বিখ্যাত পরিব্রাজক ইবনেবতুতা থেকে শুর æকরে চতুর্দশ শতকে পর্যটক জনম্যগনোলিভ্রমণের জন্য পালকি ব্যবহার করতেন বলে জানাযায়। স¤্রাঠঁ আকবরের শাসন আমলে এবং তারও পরবর্তি সময়ে সেনাধ্যক্ষদের যাতায়াতের জন্য প্রধান বাহন হিসেবে পালকিই ব্যবহৃত হতো।(সূত্রঃউইকিপিডিয়া)। বর্তমানে পালকি ব্যবহার একেবারে নেই। বিশেষ করে ১৯৩০ এর পর থেকে শহরাঞ্চলে রিকশার প্রচলন শুরু হলে পালকির ব্যবহার উঠে যায়।
পালকি চাকা বিহীন একটি বাহন।পালকিকে কয়েকজন ঘাড়ে ঝুলিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। যারা পালকিকে ঘাড়ে বা কাঁধে করেবহন করতেন । পালকির ভেতরে আকারভেদে ১বা ২ জন থাকত, আরপালকির বেহার াহিসেবে থাকত ২ থেকে ৮ জন। কাঠমিস্ত্রীরা সেগুনকাঠ, শিমুলকাঠ, গান কাঠসহ বিভিন্ন প্রকার কাঠ দিয়ে তৈরি করত পালকি। পালকির বহন করার দন্ডটিকে বাঁট বলে। এই বাঁট তৈরি হত বট গাছের বড় ঝুরি দিয়ে। আগেরকার দিনে বাংলাদেশে তিন রকমের পালকি দেখা যেতো। সাধারণ পালকি, আয়না পালকি এবং ময়ূরপঙ্খি পালকি। সাধারণ পালকি দেখতে আয়তাকার ছিল। ঢালু ছাদ এবং চারদিকে কাঠের আবরণ এর প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল। এর দু দিকে দুটি দরজাও থাকতো। আয়না পালকির বৈশিষ্ট্য হলো এতে আয়না লাগানো থাকতো। ভেতরে চেয়ারের মতো দুটি বসার জায়গা এবং একটি টেবিলে রাখা হতো। তবে আয়তনের দিক থেকে বলতে গেলে ময়ূরপঙ্খি পালকি সবচেয়ে বড়। এই পালকিটি ময়ূরের আকৃতিতে তৈরি করা হয়। এর ভেতরে দুটি চেয়ার, একটি টেবিল এবং একটি তাকও থাকতো।
কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীতে এসে সড়ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে যাতায়াতের বাহন হিসেবে পালকির ব্যবহার প্রায় বন্ধই হয়ে যায়। বর্তমানে পালকিকে আমাদের অতীত ঐতিহ্যের নিদর্শন হিসেবেই ধরা হয়।
বেহারাদের কাঁধ থেকে পালকির স্থান হয়েছে এখন বিভিন্ন জাদুঘরে। সভ্যতা এবং বাস্তব তার কথা চিন্তা করলে পালকিকে হয়ত আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। তবে আমরা এবং আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম যাতে পালকির কথা ভুলেনা যাই সেদিকে আমাদের সুদৃষ্টি রাখা খুব প্রয়োজন।