ফল ও সবজি হিসেবে পেঁপে বেশ জনপ্রিয়। শুধু পরিবারের চাহিদা মেটানোর জন্য একসময় বাড়ির আঙিনায় চাষ করা হতো ফলটি। বাণিজ্যিকভাবে পেঁপে চাষে চমক সৃষ্টি করেছেন বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার চাঁদপাশা ইউনিয়নের বায়লাখালি গ্রামের প্রবাসী আবু বকর সিদ্দিকী সুমন।কাজের সুবাদে তিনি ২২টি দেশ ঘুরে এসে নিজ এলাকায় পেঁপে চাষে সফল হয়েছেন। ২০২২ সালে শুধু পেঁপে চারা বিক্রি করে লাভ করেছেন ৬ লাখ টাকা।
সম্পর্কিতপোস্ট
এছাড়া এবছর এখন পর্যন্ত প্রায় ৫শত মন পেঁপে বিক্রি করেছেন তিনি। প্রতি মন সময় ভেদে ৬০০-১৪০০ টাকা বিক্রি করেছেন। এবছর আরো ৫ শত মন বিক্রি করতে পারবেন বলে জানিয়েছেন তিনি। তার বাগানে শাহী,কাশ্মিরি, টপ লেডি জাতের ৯ শতাধিক পূর্ণবয়স্ক পেঁপে গাছ রয়েছে। প্রতিটা পেঁপে গাছে প্রায় ৫-৭ মন পেঁপে ধরে। বর্তমানে এক একর জমিতে দুইটি ঘেরের পাড়ে সারি সারি পেঁপে গাছ শোভা পাচ্ছে। প্রতিটি গাছের গোরা থেকে মাথা পর্যন্ত ঝুলে আছে অসংখ্য পেঁপে। তিনি সর্বোচ্চ সারে ৪ কেজি ওজনের পেঁপে সংগ্রহ করছেন।
আবু বকর সিদ্দিকী সুমন এখন এলাকার (মসজিদ, মাদ্রাসা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান) বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আঙ্গিনায় ফ্রি পেঁপে চারা লাগিয়ে বৃক্ষরোপণে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করছেন। উন্নত জাতের এই সব পেঁপে চারা প্রতিবেশীদের বাড়ির আঙ্গিনায় লাগিয়ে নিজেদের প্রয়োজন মিটানোয় উদ্বুদ্ধ করে নজির স্থাপন করেছেন। নিজের ফলানো পেঁপে বিনামূল্যে সবজি হিসাবে এলাকার এতিমখানায়ও দিচ্ছেন তিনি।
আবু বকর সিদ্দিকী সুমন বলেন, আমি এখন এলাকার বেকার ও শিক্ষার্থীদের পেঁপে চাষে উদ্বুদ্ধ করার জন্য কাজ করছি। একজন শিক্ষার্থী যদি লেখাপড়ার পাশাপাশি মাত্র ২৫টি পেঁপে গাছ লাগায় এবং যত্ন করে তাহলে সেই গাছ থেকে মৌসুমে এক লাখ টাকা আয় করা সম্ভব। এ ধরণের উদ্যোক্তা থাকলে আমি নিজে সময় ও শ্রম দিয়ে সফলতা অর্জনে সহযোগিতা করবো। তবে বাগান করার আগে অবশ্যই জাত নির্বাচন ও সঠিক জাতের চারা রোপন করে পরিচর্যা করলেই সফলতা অনিবার্য।
জানা যায়, ১৯৯৩ সালে আবু বকর সিদ্দিকী সুমন সাউথ আফ্রিকায় হুন্দাই কম্পানিতে একজন পেইন্টার হিসাবে যোগদান করেন। কাজের সুবাদে তিনি ২২টি দেশ ভ্রমণ করেন। জিম্বাবুয়ে ও মালাইও ভ্রমন করতে গিয়ে সেখানে কৃষকদের পেঁপে চাষ দেখে আগ্রহী হন। তার উপার্জিত টাকায় দেশে জমি ক্রয় করেন এবং সাউথ আফ্রিকায় একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলেন। ২০১৪ সালে তার ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে (ডাকাতি) রবারি হয়। তখন তিনি আর্থিক ভাবে ভেঙে পড়েন। এক পর্যায়ে শুভাকাক্ষীদের সহযোগিতা নিয়ে আবারো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করান এবং সকল দেনা পাওনা পরিশোধ করেন। স্ত্রীর কিডনি রোগের কারণে ২০২০ সালে দেশে চলে এসে চিকিৎসা করাতে থাকেন। ওই সময় আবারো তিনি অর্থনৈতিক সংকটে পরেন। ২০২১ সালে আবু বকর সিদ্দিকী সুমন মাছ চাষের উপর ঋণের জন্য বাবুগঞ্জ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়ে যান এবং ঋনের জন্য আবেদন করেন। তৎকালীন সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা সাইদুজ্জামান আবু বকরের কথা শুনে মাছ চাষ ও পাশাপাশি সবজি চাষের পরামর্শ দেন। তখন মৎস্য অফিস থেকে একটি প্রকল্প বাবদ ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। ওই টাকায় নিজের জমিতে ঘের করে মাছ চাষ ও পেঁপে চাষ শুরু করেন। প্রথম বার জাত নির্বাচনে ভুল হওয়ায় পেঁপে চাষে সফলতা আসেনি। এরই মধ্যে ২১ সালের শেষের দিকে তার স্ত্রী কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। ২১ সালের ডিসেম্বরে তিনি স্ত্রীর একটি গহনা ৬৬ হাজার টাকায় বিক্রি করে গাজীপুর থেকে পেঁপের ভালো বীজ সংগ্রহ করেন। বীজ থেকে চারা উৎপাদন করেন। উৎপাদিত চারা নিজের ঘেরের পারে লাগিয়ে সফল হন। ২০২২ সালে শুধু চারা বিক্রি করে তিনি ৬ লাখ টাকা আয় করতে সক্ষম হন।
আবু বকর সিদ্দিকী সুমন আরো বলেন, আমার আজকের সফলতার বীজ বপন করেছিলেন তৎকালীন সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা সাইদুজ্জামান স্যার। তার পরামর্শে ও অনুপ্রেরণায় আমি হাল ছাড়িনি। এছাড়া উপজেলা কৃষি অফিস থেকে আমাকে বিভিন্ন সময় পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করা হয়েছে। আমি এখন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পেঁপে চাষের উপর বক্তৃতা করার আমন্ত্রণ পেয়ে থাকি। মাকড়সা ও ছত্রাক ছাড়া পেঁপে বাগানে তেমন কোনো সমস্যা দেখা যায় না। প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে পুষ্টিমানসমৃদ্ধ পেঁপে চাষে ভাগ্য বদলে ফেলা যায়। পেঁপে চাষে অর্থনৈতিকভাবে সরকারি সহযোগিতা পেলে দেশের বেকার সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।
তিনি মনে করেন, শিক্ষিত বেকার যুবকরা যদি চাষে অগ্রসর হয় তাহলে তারাও লাভবান হবে।উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা শাহ মোঃ আরিফুল ইসলাম বলেন, আমি পেঁপে বাগানটি পরিদর্শন করেছি। আমাদের কৃষি অফিসার নাসির উদ্দিন স্যার ও জেলার কর্মকর্তারাও বাগানটি পরিদর্শন করে প্রশংসা করেছেন। আবু বকর সিদ্দিকী সুমন একজন কর্মঠ মানুষ। তিনি বরিশালে পেঁপে চাষে চমক দেখিয়েছেন। কৃষকদের প্রতারণা থেকে বাঁচাতে তিনি নিজেই এখন উন্নত জাতের পেঁপে চারা উৎপাদন করে বিক্রি করছেন। আমরা তার মঙ্গল কামনা করি।