বরিশাল শের–ই–বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনাভাইরাসের পরীক্ষার কাজ শুরু হয় গত ২৯ মার্চ থেকে। ওই দিন থেকে নমুনা সংগ্রহের কাজ করছেন টেকনোলজিস্ট বিভূতিভূষণ হালদার (৩০)। সেই থেকে গত শুক্রবার পর্যন্ত প্রায় ৫০ জনের নমুনা সংগ্রহ করেছেন তিনি। বেশির ভাগ মানুষ যখন করোনাভাইরাস নিয়ে আতঙ্কিত, কেউ আক্রান্ত হলেই দূরে সরে যাচ্ছেন, তখন তিনি সেসব মানুষের একেবারে কাছে গিয়ে নিজের কাজটুকু করছেন। বরিশাল স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মীরা তাই তাঁকে ‘সত্যিকারের নায়ক’ বলছেন।
প্রথম যেদিন শুনলেন নমুনা সংগ্রহের কাজ করতে হবে, কী মনে হলো? এমন প্রশ্নের জবাবে বিভূতিভূষণ বললেন, ‘হাসপাতাল থেকে পাঁচজনকে রোস্টার করে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। নমুনা সংগ্রহের কথা শুনে সহকর্মীদের চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ। অনেকে অজুহাত দেখিয়ে দায়িত্ব এড়ালেন। অনেকে চেষ্টা–তদবির করে রোস্টার থেকে নাম কাটিয়ে নিলেন। বুঝলাম, শেষ পর্যন্ত কাজটা আমাকে একাই করতে হবে।
এর সঙ্গে বিভূতিভূষণ যোগ করলেন, ‘২৮ মার্চ রাতে ভালো ঘুম হয়নি। ভয়, শঙ্কা, মৃত্যুর খবরে অজানা আতঙ্ক চেপে বসে মনে। পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়া এমন একটা ভয়াবহ ভাইরাসের নমুনা সংগ্রহের কাজ করতে হবে ভেবে অস্থির লাগছিল। একবার মনে হলো, অজুহাত দেখিয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিই। পরে মনে হলো, দুর্যোগের সময় কাউকে না কাউকে তো এগিয়ে আসতেই হবে।’
২৯ মার্চ সকাল হলো। সকাল আটটায় বিভূতিভূষণের বাড়ি থেকে বের হওয়ার কথা। ওই দিন সকালে পরিবারের সদস্যদের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘নাশতার সময় মা, বাবা, ছোট ভাই—সবাই এগিয়ে এলেন খাবার টেবিলের কাছে। মা রঞ্জা রানীর মুখটা মলিন। মাথায় হাত রেখে মা বললেন—বাবা না গেলে হয় না! পরে বললেন, যাঁরা আক্রান্ত মারা যাচ্ছেন, তাঁরাও তো কোনো না কোনো মায়ের সন্তান। তাঁদের সেবার জন্য তোমাকে পাঠাচ্ছি।’ মায়ের কথা শুনে বাবাও সাহস পেলেন—উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বাবা বললেন, এ দেশে মুক্তিযুদ্ধ একবার হয়েছে। সবার ভাগ্যে এই যুদ্ধে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। করোনাও একটা যুদ্ধ। এই যুদ্ধেও সবার অংশ নেওয়ার সৌভাগ্য হবে না। তুমি যাও, আমাদের আশীর্বাদ রইল।’ বিভূতিভূষণের বাবা সুধাংশু হালদার এই হাসপাতালের সহকারী কোষাধ্যক্ষ হিসেবে ছয় বছর আগে অবসর নিয়েছেন।
প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে বিভূতিভূষণ বলছিলেন, ‘২৯ মার্চ প্রথম নমুনা সংগ্রহের জন্য পিপিই পরি। নমুনা সংগ্রহের সব সরঞ্জাম নিয়ে দুরুদুরু মনে করোনা ইউনিটে ঢুকি। সেদিন দুজনের নমুনা সংগ্রহ করি।’
সেই যে শুরু, এরপর থামার আর অবকাশ মেলেনি বিভূতিভূষণের। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করেন তিনি। বললেন, রাতে ভালো ঘুম হয় না। করোনা ইউনিটে থাকা রোগীদের আতঙ্ক, অস্থিরতা আর সব সময় মৃত্যুভয়ে কাতর মুখগুলো চোখের সামনে ভাসে। ভীষণ কষ্ট লাগে, মনটা বিষন্ন হয়ে ওঠে এসব মানুষের যন্ত্রণা দেখে।
বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক শ্যামল কৃষ্ণ মণ্ডল বলেন, ‘বিভূতিভূষণের সাহসিকতা আমাদের গর্বিত করে। ওর জন্য সবসময় আমরা প্রার্থনা করি। ও যাতে সুস্থ থেকে কাজটা চালিয়ে যেতে পারে।’
বিভূতি বললেন, একটি নমুনা সংগ্রহ করতে অনেক সময় লাগে। প্রতিদিন করোনা ওয়ার্ডে ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা সময় কাজ করতে হয়। ঝঁকিপূর্ণ কাজ করেন বলে ২৯ মার্চের পর আর বাড়িতে যাচ্ছেন না। পরিবারের কাছ থেকে আলাদা আছেন। হাসপাতালের কাছেই একটি কক্ষে থাকছেন। কবে বাড়িতে যেতে পারবেন, তারও ঠিক নেই। পরিবারের সদস্যদের জন্য মনটা কাঁদে।
বরিশাল শের–ই–বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক বাকির হোসেন বলেন, ‘যখন সবাই ভয়ে-আতঙ্কে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন, তখন বিভূতিভূষণ একাই এগিয়ে এসেছেন। দিন-রাত ঝুঁকির মধ্যে কাজ করছেন। তাঁর মতো যুবকই আমাদের সত্যিকারের নায়ক। ভয় উপেক্ষা করে ছেলেটা যেভাবে কাজ করছে, এটা অভাবনীয়। ওর জন্য আমরা গর্বিত।’
সুত্র :প্রথমআলো অনলাইন।