বরগুনায় শিক্ষক বদলিতে ঘুষ, অফিসে তালা দিয়ে লাপাত্তা শিক্ষা কর্মকর্তা
প্রকাশ: ৩০ জানুয়ারি, ২০২৩, ১:১৬ পূর্বাহ্ণ |
অনলাইন সংস্করণ
বরগুনা প্রতিনিধি : বরগুনায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নতুন শিক্ষক পোস্টিংয়ে কোটি টাকার ঘুষবাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। মেধাক্রম অনুযায়ী প্রথম ৫০ জন শিক্ষককে তাদের পছন্দের বিদ্যালয়ে পোস্টিং দেওয়ার কথা, অথচ তিনি তালিকায় থাকা শতাধিক শিক্ষকের কাছ থেকে ২০ থেকে ৮০ হাজার টাকা নিয়ে তাদের পছন্দে পোস্টিং দিয়েছেন। ঘটনা চাউর হলে তিনি অফিসে তালা দিয়ে চলে যান। বন্ধ করে দেন মোবাইল ফোন। ঘুষবাণিজ্যে অফিসের কেরানি নাসিরও জড়িত বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। একই সময় নাসিরসহ অন্য স্টাফরাও পালিয়ে যান।
জানা যায়, ২০ ডিসেম্বর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত স্বাক্ষরিত এক পরিপত্রে বলা হয়, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মেধাক্রম অনুযায়ী প্রথম ৫০ জন শিক্ষককে তাদের পছন্দের বিদ্যালয়ে পোস্টিং দেবেন। কিন্তু সেই পরিপত্র অমান্য করেন বগুনার প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আবদুর রাজ্জাক। ২২ জানুয়ারি ৬০২ জন নতুন শিক্ষকের পোস্টিং দেন তিনি। এর মধ্যে প্রায় পাঁচশ শিক্ষকের কাছ থেকে ঘুষবাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে তার ও কেরানি নাসিরের বিরুদ্ধে। এতে তালিকায় ৫০ এর মধ্যে থেকেও পছন্দের বিদ্যালয় পাননি অনেক শিক্ষক। ভুক্তভোগী অন্তত ২০ শিক্ষকের সঙ্গে কথা হয়েছে প্রতিবেদকের। এর মধ্যে নারী শিক্ষকরা জানিয়েছেন, তাদের ১৫-২৫ কিলোমিটার দূরের বিদ্যালয়ে পোস্টিং দেওয়া হয়েছে। এত দূরে কীভাবে আসা-যাওয়া করবেন সেই চিন্তায় দিশেহারা তারা।
এদিকে শিক্ষকদের পোস্টিং দেওয়ার পরপরই ঘুষবাণিজ্যের বিষয়টি চাউর হয়ে যায়। খবর পেয়ে স্থানীয় সংবাদকর্মী ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে গিয়ে দেখেন তালা ঝুলছে। কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক ও কেরানি নাসিরের মোবাইল ফোনও বন্ধ পাওয়া যায়। জানা যায়, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস থেকে পোস্টিং দেওয়ার আগে নির্ধারিত একটি ফরমে শিক্ষকদের কাছ থেকে পছন্দের ৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু যারা ঘুষ দিতে পারেনি তাদের ক্ষেত্রে পছন্দের তালিকা কোনো কাজে আসেনি। নাম প্রকাশ না করে একাধিক নারী শিক্ষক বলেছেন, এ অবস্থায় হয়তো তাদের পক্ষে চাকরি করা সম্ভব না-ও হতে পারে। তবে অনেকে বাধ্য হয়ে যোগদান করেছেন।
বরগুনা সদর উপজেলার ঢলুয়া ইউনিয়নের লেমুয়া খাজুরা গ্রামের মেয়ে শারমিন জাহান সেতুকে পোস্টিং দেওয়া হয়েছে ২০ কিলোমিটার দূরে পাকুরগাছিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বুড়িরচর ইউনিয়নের রাবেয়া আক্তারকে পোস্টিং দেওয়া হয়েছে দক্ষিণ ইটবাড়ীয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। পশ্চিম বুড়িরচর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে গাবতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পোস্টিং হয়েছে আঞ্জুমান আরা বৃষ্টির। কেওড়াবুনিয়া ইউনিয়নের আয়লা পাতাকাটা ইউনিয়নে পোস্টিং হয়েছে ছবি আক্তারের।
মরিয়ম রহমান লাবণীর বাবা মজিবর রহমান হাওলাদার বলেন, আমার মেয়ের কাছ থেকে তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পছন্দ নিলেও তাকে ১৫ কিলোমিটার দূরে বধূঠাকুরানী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পোস্টিং দিয়েছে। আমি টাকা দিতে পারলে আমার মেয়ের পছন্দের স্কুলে পোস্টিং হতো। ভালো রাস্তা নেই। বাড়ি থেকে বর্ষা মৌসুমে ক্লাস করা কোনো ক্রমেই সম্ভব নয়। যারা হাজার হাজার টাকা দিয়েছেন, তাদের পছন্দমতো পোস্টিং হয়েছে।
একাধিক বঞ্চিত শিক্ষক বলেছেন, যারা বেশি টাকা দিয়েছেন তাদের পোস্টিং পৌরসভায় বাসার পাশের স্কুলেও হয়েছে। রাবেয়া বসরী মুনার বাসা বরগুনা পৌরসভার ডিকেপি সড়কে। তার মেধাক্রম ১২১ হলেও বাসার কাছে বরগুনা সরকারি কলেজ সংলগ্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পোস্টিং পেয়েছেন। একইভাবে বরগুনা চরকলোনি সড়কে ইসরাত জাহানের বাসা। মেধাক্রম ১২৫ হলেও তাকে পোস্টিং দেওয়া হয়েছে পৌরসভার দক্ষিণ বরগুনা এ লথিফ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক শিক্ষক বলেন, কেরানি নাসির ও শিক্ষা কর্মকর্তা কোটি টাকার উপরে ঘুষ নিয়েছেন। পাঁচশ শিক্ষকের কাছ থেকে গড়ে ২০ হাজার টাকা করে নিলেও ১ কোটি টাকা হয়। এর সঙ্গে কয়েকজন প্রাইমারি প্রধান শিক্ষকও জড়িত।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আবদুর রাজ্জাক বলেন, কাজ করতে গেলে কিছু ভুল-ত্রুটি হতে পারে। তবে ঘুষের সঙ্গে আমি জড়িত নই। আমি ৩ মাস আগে বরগুনায় যোগদান করেছি।
দুদিন ধরে ফোন ও অফিস বন্ধ করে কোথায় ছিলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, লোকজন ঝামেলা করে, যার কারণে মফস্বলে ছিলাম। তবে এদিনও অভিযুক্ত কেরানি নাসিরের মোবাইল ফোন বন্ধ ছিল।