রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের পরিচালক (যুগ্মসচিব) এনামুল হক নিজের পাতা ফাঁদেই পড়তে যাচ্ছেন। তিনি একদিকে ভূমি অফিসের কর্মচারী সুলতানা জেসমিনকে শায়েস্তা করতে গিয়ে তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছেন। অপরদিকে নওগাঁয় উপস্থিত থেকে জেসমিনকে র্যাবের হাতে তুলে দেওয়ার ঘটনা অস্বীকার করে বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে পড়েছেন।
সূত্র জানায়, জেসমিনের ঘটনায় পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিতে গিয়ে নিজেই ফেঁসে যাচ্ছেন তিনি। তদন্ত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে এমন ধারণাই পাওয়া গেছে। রাজশাহীর বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয় থেকে ৭ এপ্রিল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে এ সংক্রান্ত তদন্ত রিপোর্ট দাখিল করেছে বলে জানা যায়। আর তাতে এনামুলের বিষয়ে বেশ কিছু অসঙ্গতি উঠে আসে। পরে তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে আইনত ব্যবস্থা নিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে গঠিত তদন্ত কমিটির কাছে দেয়া জবানবন্দিতে এনামুল হক ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে জেসমিনকে র্যাবের হাতে তুলে দেওয়ার ঘটনা অস্বীকার করেন। অথচ জেসমিনের বিরুদ্ধে তার দায়ের করা মামলায় স্পষ্ট বলা আছে, তিনি ২২ মার্চ অফিসের কাজে নওগাঁ যাওয়ার পথে নওগাঁ বাসস্ট্যান্ডে র্যাবের একটি টহল দলকে দেখতে পান। টহল দলের ইনচার্জ ডিএডি মাসুদের কাছে প্রতারণার বিস্তারিত বিবরণ দেন। এরপরই আটক করা হয় জেসমিনকে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এনামুল হক নিজেই একটি ফাঁদ তৈরি করেছিলেন। এখন তিনি সেই গর্তে পড়তে যাচ্ছেন। তদন্ত কমিটির কাছে দেওয়া বক্তব্য ও মামলার এজাহারে গরমিলের বিষয়টি তদন্ত কমিটির কাছে ধরা পড়েছে। সুলতানা জেসমিনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা মামলার এজাহারে তিনি বলেছেন, তাকে (সুলতানা জেসমিন) গ্রেফতারের সময় তিনি নওগাঁ সদরে উপস্থিতি ছিলেন। অথচ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশে গঠিত অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার ইমতিয়াজ হোসেনের তদন্ত কমিটির কাছে দেওয়া বক্তব্যে তিনি ওইদিন নওগাঁ যাননি বলে দাবি করায় কমিটি তার বক্তব্য বিশ্বাস করতে পারছে না।
এদিকে সুলতানা জেসমিনের বিষয়ে তদন্ত করতে গিয়ে কমিটির কাছে আরও কিছু তথ্য এসেছে বলে জানা গেছে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, এনামুল হকের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত যতগুলো অভিযোগ পাওয়া গেছে, সবগুলোই নারীঘটিত এবং প্রতারণার। এসব অভিযোগের ধরন এক ও অভিন্ন। নারী এবং অর্থ-এ দুটিই হচ্ছে অভিযোগের ভিত্তি। নওগাঁও ভূমি অফিসের কর্মচারী সুলতানা জেসমিনের বিরুদ্ধে তিনি অভিযোগ করেছেন, জেসমিন তার নাম-পদবি ব্যবহার করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তার আগে মোহাম্মদপুর থানায় গত ডিসেম্বর মাসে ছন্দা জোয়ার্দার নামে একজন নারীও এনামুল হকের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগে মামলা দায়ের করেন এবং সে মামলায় তিনি বর্তমানে জামিনে আছেন।
সূত্র জানায়, দীর্ঘ চাকরি জীবনে তার বিরুদ্ধে জনপ্রশাসনে আসা অধিকাংশ অভিযোগই নারীঘটিত ও অর্থসংশ্লিষ্ট। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওই কর্মকর্তা আরও জানান, খোঁজখবর নিয়ে দেখেছি ছন্দা জোয়ার্দার এনামুল হকের পূর্বপরিচিত। অর্থাৎ মামলার বিষয় যাই হোক, ছন্দা জোয়ার্দারের সঙ্গে এনামুল হকের পরিচয় ও সম্পর্ক ছিল তা সত্য। তিনি আরও বলেন, সব অফিসারের অভ্যাস, স্বভাব চরিত্র এক নয়। একেকজনের একেক ধরনের অভ্যাস। কারও কারও টাকার নেশা, আবার কারও নেশা হচ্ছে মানুষের উপকার করা, জনগণকে সেবা দেওয়া। এনামুল হকের মধ্যে কমপক্ষে দুটি বদঅভ্যাসের কথা তদন্তে উঠে এসেছে। তিনি আরও জানান, এনামুল হক ও সুলতানা জেসমিনের মধ্যে মোবাইলে চ্যাটিংয়ের বেশ কিছু স্ক্রীনশর্ট প্রিন্ট করে তদন্ত প্রতিবেদনের সঙ্গে পাঠানো হয়েছে। তাছাড়া কিছু মোবাইল ফোন নম্বর পাঠানো হয়েছে। তদন্তে যা এসেছে তা এজাহারের সঙ্গে মিলছে না।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা মামলার এজাহারে এনামুল হক বলেছেন, তিনি ২২ মার্চ অফিসের কাজে নওগাঁ যাওয়ার পথে নওগাঁ বাসস্ট্যান্ডে র্যাবের একটি টহল দলকে দেখতে পান। টহল দলের ইনচার্জ ডিএডি মাসুদের কাছে প্রতারণার বিস্তারিত বিবরণ দেন। র্যাব সদস্যরা ঘটনা শুনে ইহা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ধর্তব্য একটি অপরাধ বলে আমাকে অবহিত করে। এ সময় র্যাব সদস্যরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে তথ্য ও প্রযুক্তির সাহায্যে মামলার ২ নম্বর আসামি সুলতানা জেসমিনের অবস্থান শনাক্ত করে। এরপর আমাকে সঙ্গে নিয়ে নওগাঁ জেলার শহরের মুক্তির মোড় নামক স্থানে গিয়ে তাকে আটক করে।
এনামুল হক প্রকৃত সত্য প্রকাশ করছেন না বলে মনে করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। সেক্ষেত্রে তাকে স্বপদে বহাল রেখে তদন্ত কতটা যৌক্তিক-এমন প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মকর্তা বলেন, অপরাধ যদি তার দায়িত্বের সঙ্গে মিলে যায় এবং তার পক্ষ থেকে যদি তদন্তকাজে প্রভাব বিস্তারের সম্ভাবনা থাকে, সেক্ষেত্রে তাকে পদে বহাল রাখা যাবে না। এখানে তার ঘটনাটি রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। এটি তার ব্যক্তিগত সমস্যা। সেক্ষেত্রে এনামুল হক স্বপদে বহাল থাকলেও তদন্তে কোনো সমস্যা নেই।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, এনামুল হক পদে পদে সত্য গোপন করছেন। সুলতানা জেসমিন ও আল আমীন নামে দুই ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রতারণার মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ করলেও যারা টাকা দিয়ে প্রতারিত হলেন তারা কেউ অভিযোগ করেননি। এখানে অন্য কোনো রহস্য আছে।
র্যাব হেফাজতে সুলতানা জেসমিনকে তুলে নিয়ে যাওয়া ও র্যাবের হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনায় উচ্চ আদালত থেকে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটিকে দিয়ে তদন্ত করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। উচ্চ আদালতের আদেশের সার্টিফাইড কপি হাতে পাওয়ার পর তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে বলে জানা যায়। সেই কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে এনামুল হকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এখন কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
গত ২২ মার্চ বুধবার সকাল ১০টার দিকে শহরের মুক্তির মোড় এলাকা থেকে রাজশাহী র্যাব-৫ এর একটি দল মৌখিক অভিযোগের ভিত্তিতে সুলতানা জেসমিনকে (৪৫) আটক করে। পরে শুক্রবার সকাল ৯টার দিকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ওই নারীর মৃত্যু হয়। সুলতানা জেসমিন সদর উপজেলার চণ্ডীপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিসে অফিস সহকারী পদে চাকরি করতেন। জেসমিনকে র্যাব আটকের পরদিন রাজশাহীর রাজপাড়া থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তার বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়। প্রতারণার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলাটি করেন রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের পরিচালক (যুগ্মসচিব) এনামুল হক।