‘বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল অধ্যাদেশ-১৯৭৬’ অনুযায়ী নিবন্ধন ও রুট পারমিট ছাড়া স্পিডবোট চলাচলে আইনগত সুযোগ নেই। এটি অপরাধ। অথচ বেশিরভাগ স্পিডবোট এগুলো ছাড়াই বিআইডব্লিউটিএর ঘাট ব্যবহার করছে। ওইসব ঘাট ইজারা দিয়ে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করছে সংস্থাটি। যদিও বন্দর এলাকা থেকে অনিবন্ধিত নৌযান চলাচল বন্ধে বিআইডব্লিউটিএ-কে চিঠি দিয়ে আসছে নৌপরিবহণ অধিদপ্তর। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো এসব তথ্য জানিয়েছে।
সূত্র আরও জানিয়েছে, শিমুলিয়া-বাংলাবাজার রুটে সোমবার স্পিডবোট দুর্ঘটনায় ২৬ জনের মৃত্যু হয়েছে, সেটিরও নিবন্ধন বা রুট পারমিট কোনোটি ছিল না। লকডাউনে স্পিডবোট চলাচলেও নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই এটি যাত্রী বহন করে। যে বালুবাহী (বাল্কহেড) জাহাজের সঙ্গে ধাক্কা লেগেছে, তার নাম এমভি সাফিন সায়হাম। এ জাহাজটিরও নিবন্ধন নেই। নিবন্ধন ছাড়াই বিআইডব্লিউটিএ, নৌপরিবহণ অধিদপ্তর, নৌপুলিশ ও কোস্টগার্ড এবং স্থানীয় প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে এসব নৌযান চলাচল করেছে। অভিযোগ রয়েছে, প্রভাবশালীদের মাধ্যমে সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করেই চলে অবৈধ এসব নৌযান।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নৌপরিবহণ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, লকডাউনে স্পিডবোট চলাচল নিষিদ্ধ। প্রাথমিক তথ্যে যতটুকু জেনেছি, এটি বিআইডব্লিউটিএ ঘাট থেকে ছেড়ে যায়নি। কাছাকাছি কোথাও থেকে যাত্রী নিয়ে যাচ্ছিল। তিনি বলেন, নিবন্ধন ও রুট পারমিট ছাড়া স্পিডবোট চলার কথা নয়। কিন্তু কিছু বাস্তবতাও আছে। সেগুলোও দেখতে হয়। ইতোমধ্যে আমরা সব নৌযানকে নিয়মের আওতায় আনার পদক্ষেপ নিয়েছি।
সংশ্লিষ্টদের নজরদারির অভাবের বিষয়টি প্রকারান্তরে স্বীকার করে বিআইডব্লিউটিএ-র চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদেক যুগান্তরকে বলেন, মাওয়ায় দুর্ঘটনার জন্য স্পিডবোটের চালক দায়ী। সাধারণ মানুষেরও সচেতনতার অভাব রয়েছে। লকডাউনে স্পিডবোট বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবুও এটি কীভাবে যাত্রী নিয়ে মাওয়া থেকে কাঁঠালবাড়ির দিকে গেছে সেটি প্রশ্নের বিষয়। এখানে সংশ্লিষ্টদের নজরদারির অভাব ছিল-তা পরিষ্কার।
বিআইডব্লিউটিএ ও নৌপরিবহণ অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা জানান, মাওয়ায় সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে ২০১৪ সালের ৪ আগস্ট। ওইদিন দিন-দুপুরে এমভি পিনাক-৬ লঞ্চ ডুবে ৪৯ জনের মৃত্যু হয়। নিখোঁজ হয় অর্ধশতাধিক। ওই লঞ্চটি আর উদ্ধার হয়নি। ওই ঘটনার পর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের লঞ্চ ও স্পিডবোট নিয়ন্ত্রণে আনতে পদক্ষেপ নেয় নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়। কিন্তু এক পর্যায়ে তা গতি হারায়। তারা আরও বলেন, ওই দুর্ঘটনার পর মাওয়া রুটে আর লঞ্চ ডোবেনি। তবে প্রায় স্পিডবোট দুর্ঘটনায় মানুষ মারা যাচ্ছে। সর্বশেষ সোমবার স্পিডবোট দুর্ঘটনায় ২৬ জনের মৃত্যু হলো। এর আগে ২০২০ সালে লকডাউনে ট্রলারে যাত্রী পারাপারের সময়ে দুর্ঘটনা ঘটে। এর কারণ হিসাবে তারা বলেন, মূলত দুই পাড়ের (মাওয়া ও কাঁঠালবাড়ি) প্রভাবশালীরা এসব স্পিডবোট নিয়ন্ত্রণ করেন। তাদের ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায়, কোন স্পিডবোট চলবে তা নির্ধারিত হয়। প্রতি ট্রিপ থেকে ইজারাদাররা টাকা পেয়ে থাকেন। এ কারণেই চালকরা বেপরোয়া আচরণ করেন। তারা আইন ও নিয়মকানুন মানতে চান না।
নৌপরিবহণ অধিদপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম গোপন রাখার শর্তে জানান, স্পিডবোট নিবন্ধনের আওতায় আনতে চলতি বছরেও বৈঠক করেন সংস্থাটির কর্মকর্তারা। মাওয়া ঘাট ও স্পিডবোটের নিয়ন্ত্রক মেদিনীমন্ডল ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আশরাফ হোসেন খান তাতে অনেকটা বাধার সৃষ্টি করেন। বর্তমানে মাওয়া স্পিডবোট ঘাটটিও তার শ্যালক মো. সাহ আলমের নামে ইজারা নেওয়া। অপর প্রান্তের ইলিয়াছ আহমেদ চৌধুরী স্পিডবোট ঘাটটি ইজারা নিয়েছেন স্থানীয় মো. ইয়াকুব বেপারি। তারা দুজনই সরকারি দলের নেতা। তাদের সঙ্গে স্থানীয় আরও কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি এসব ঘাট ও স্পিডবোট চলাচল নিয়ন্ত্রণ করেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মেদিনীমন্ডল ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আশরাফ হোসেন খান যুগান্তরকে বলেন, গত বছর থেকে আমি ঘাট ইজারা নিইনি। আর স্পিডবোট নিবন্ধনের বিষয়ে যতবার বৈঠক হয়, জনপ্রতিনিধি হিসাবে আমাকে ডাকে। সবশেষ বৈঠকে আমি বলেছি, স্পিডবোটের মালিকদের ঢাকায় গিয়ে নিবন্ধন বা রুট পারমিট নেওয়া কষ্টকর। সপ্তাহে এক বা দুদিন মাওয়ায় এসে নিবন্ধন করা হলে মালিকরা রাজি হবেন। সরকারি কর্মকর্তারা সেটি মেনে নিয়েছেন। কিন্তু লকডাউনের কারণে সেই কাজ শুরু হয়নি।
সূত্র আরও জানায়, বর্তমানে মাত্র সাতটি রুটে ২০টি স্পিডবোট রুট পারমিট নিয়ে চলাচল করছে। সেগুলো হচ্ছে : পটুয়াখালীর পানপট্টি থেকে বোড়ালিয়া ১০টি, বরগুনার কুড়াকাটা থেকে আমতলী দুটি, লাহারহাট-ভেদুরিয়া ১টি, হাজিরহাট-ঘোষেরহাটে দুটি, চরমোনতাজ-গৈনখালী রুটে চারটি ও গৈনখালী-চরমন্ডল রুটে ১টি। এর বাইরে মাওয়ায় কমবেশি দু’শ পাটুরিয়ায় প্রায় অর্ধশত, নরসিংদী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দুই শতাধিক স্পিডবোট নিয়ম লঙ্ঘন করে চলছে। এ ছাড়া বরিশাল, ভোলা, হাওড়াঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকায় রুট পারমিট ছাড়া স্পিডবোট চলাচল করছে।
দুই পাড়ের ঘাটের ইজারামূল্যের বিস্তর ফারাক : বিআইডব্লিউটিএ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, শিমুলিয়া-ইলিয়াছ আহমেদ চৌধুরী রুটে কমবেশি দু’শ স্পিডবোট চলে। এসব স্পিডবোটই দুটি ঘাটে যাত্রী ওঠানামা করায়। অথচ দুই ঘাটের ইজারামূল্যের বড় ধরনের ব্যবধান রয়েছে। এর নেপথ্যে রয়েছেন স্থানীয় প্রভাবশালী ও বিআইডব্লিউটিএ-র কয়েক কর্মকর্তার সিন্ডিকেট। সূত্র আরও জানায়, শিমুলিয়া স্পিডবোট ঘাট বার্দিং ও কঞ্জারভেন্সি আদায় কেন্দ্রে চলতি বছর ইজারা দেওয়া হয় এক কোটি ৬৯ লাখ ২০ হাজার টাকা। এ ঘাটের ইজারাদার লৌহজং উপজেলার যশলদিয়া গ্রামের মো. শাহ আলম। অপরদিকে ইলিয়াছ আহমেদ চৌধুরী স্পিডবোট ঘাটের ইজারামূল্য ২৫ লাখ ছয় হাজার ৮৫০ টাকা। একই ধরনের নৌযান চলা দুটি ঘাটের ইজারামূল্যের ব্যবধান প্রায় দেড় কোটি টাকা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাওয়া ঘাটে দায়িত্বপ্রাপ্ত বিআইডব্লিউটিএ-র সহকারী পরিচালক মো. শাহাদাত হোসেন বলেন, কাঁঠালবাড়ি ঘাটের ইজারাদাররা নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করে দরপত্রে অংশ নেন। ৬-৮ দফা ইজারা টেন্ডার দেওয়ার পরও কেউ অংশ নেয় না। পরে প্রাক্কলিত মূল্যের অনেক কম দরে টেন্ডার পান। এ কারণে সেখানে ইজারামূল্য কম। অপরদিকে মাওয়া প্রান্তে প্রতিযোগিতার কারণে ইজারামূল্য বেশি।