দেওবন্দের অনুসরণে কওমি শিক্ষা ব্যবস্থায় সংস্কারের আহ্বান
প্রকাশ: ২৭ ডিসেম্বর, ২০২২, ১:০২ পূর্বাহ্ণ |
অনলাইন সংস্করণ
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কওমি মাদ্রাসার সিলেবাসে পরামর্শ সাপেক্ষে কিছু সংস্কার হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দের উচ্চতর হাদিস বিভাগের প্রধান আল্লামা আবদুল্লাহ মারুফী।
তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মাদ্রাসার সিলেবাসে পরামর্শ সাপেক্ষে কিছুটা সংস্কার হতে পারে। বিভিন্ন কিতাব উর্দু ফার্সির পরিবর্তে বাংলা ভাষায়ও পড়ানো যেতে পারে। মাতৃভাষায় সহজ করে লিখে ছাত্রদের পড়ালে বড় একটি সময় বেঁচে যাবে। এছাড়া আরবির পাশাপাশি ইংরেজি ভাষা শেখার প্রতিও গুরুত্ব দিতে হবে।
রোববার রাতে ঢাকায় আন্তর্জাতিক একটি শিক্ষা সেমিনারে অংশ নিয়ে ভারতের এই শীর্ষ আলেম এসব কথা বলেন।
‘পরিবর্তিত চলমান বিশ্ব শিক্ষা ব্যবস্থায় কওমি মাদরাসা: পরিপ্রেক্ষিত বাংলাদেশ’ শিরোনামে রাজধানীর তোপখানা রোডের হোটেল রয়েল প্যালেসে বাংলাদেশ কওমি ছাত্র ফোরাম এ শিক্ষা সেমিনারের আয়োজন করে। এতে দেশের গবেষক আলেম, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক ও প্রতিনিধিত্বশীল তরুণ আলেমরা উপস্থিত ছিলেন।
আল্লামা আবদুল্লাহ মারুফী বলেন, শৈশবে মানুষের অন্তরে যা বদ্ধমূল হয়, তার প্রতিক্রিয়া পুরো জীবনে থাকে। সন্তান বড় হয়ে স্কুলে পড়ুক বা মাদরাসায় সেটি পরের কথা, শৈশবেই যেন তার প্রাথমিক কিছু ধর্মীয় জ্ঞানার্জন হয় সেটির গুরুত্ব দিতে হবে। এজন্য মাদরাসা, স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বিত শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা গেলে সেটি সবার জন্য উপকারী হবে। দ্বীনিয়াতের মাধ্যমে সর্বস্তরের মুসলমানকে ধর্মীয় শিক্ষার আওতায় আনতে হবে।
তিনি আরও বলেন, যদি তাকওয়া-আত্মমর্যাদা বাকি রেখে একজন দাঈ হিসেবে আমাদের শিক্ষাসমাপনকারী ছাত্ররা সাধারণ ভার্সিটিগুলোতে এই নিয়তে পড়াশোনা করার জন্য যায় যে, নিজের তাকওয়া-আত্মমর্যাদাবোধ বাকি রেখে অন্যের ওপর প্রভাব বিস্তারকারী হবে, তাহলে ভার্সিটিগুলোতে পড়াশোনা করতে কোনো সমস্যা নেই; বরং এটি একটি বিরাট অর্জন হবে। আমি বলবো আমাদের এ দিকটাতেও চিন্তা করা উচিত।
উপমহাদেশের বিশিষ্ট হাদিস এই বিশারদ বলেন, কিন্তু অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে হয় যে, আমাদের শিক্ষা সমাপনকারীরা যখন ভার্সিটিতে ভর্তি হয় অধিকাংশই ভুল পথে চলে যায়। আপনাদের এই দেশের ভার্সিটিগুলোর অবস্থা তো মাশাল্লাহ আমাদের দেশের তুলনায় অনেক ভালো। তো আপনারা নিজেদের তাকওয়া-আত্মমর্যাদাবোধ নিজেদের ঈমান আমল আকিদা ঠিক রেখে এসব ভার্সিটিগুলোতে দাওয়াতের নিয়তে পড়াশোনা করতে পারেন, এতে কোনো সমস্যা নেই।
অনুষ্ঠানে আলোচকরা বলেন, উপ-মহাদেশের কওমি মাদরাসাগুলো পরিচালিত হয় ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দের আদর্শে। দারুল উলুম প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য ছিল- ইসলামী শিক্ষার পাশাপাশি নিত্য নতুন সৃষ্ট ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, ফিতনা ইত্যাদি থেকে জাতিকে সতর্ক করা এবং মুসলিম জাতিকে বিশ্বে মাথা উঁচু করে আধুনিক সভ্যতার নামে আগ্রাসনকে রুখে দিয়ে ইসলাম বা শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। তাই যুগ চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে কওমি মাদরাসার সিলেবাসে আগেও পরিবর্তন এসেছে, ভবিষ্যতেও সংযোজন-বিয়োজন হতে পারে।
আলোচকরা বলেন, শিক্ষা ব্যবস্থার বিভিন্নতার কারণে উপমহাদেশের মুসলিম সমাজে চরম বিশৃঙ্খলা ও বিভক্তি দেখা দেয় সূচনালগ্ন থেকেই। বিদগ্ধজনরা এই বিভক্তি থেকে বেরিয়ে আসার উপায় খোঁজার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বিগত একশ বছরেও এর কোনো বিহিত হয়নি। তবে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রস্তাব সামনে এসেছে। সেসব প্রস্তাব সামনে রেখে নিয়মিত আলোচনা পর্যালোচনা হওয়া আবশ্যক।
দেশের কওমি মাদরাসাগুলোতে কয়েকটি সিলেবাস প্রচলিত রয়েছে উল্লেখ করে এগুলোর সমন্বয়েরও দাবি ওঠে আলোচনা সভায়।
বক্তারা বলেন, ভারত ও পাকিস্তানের কওমি মাদরাসাগুলোতে পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগলেও বাংলাদেশে একেবারেই থেমে আছে। আমাদের মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে পারলে বিদেশি ছাত্ররাও বাংলাদেশে পড়তে আসবে। যেটি আমাদের দেশের জন্যও সুনাম বয়ে আনবে।
আলেমরা বলেন, সম্প্রতি দারুল উলুম দেওবন্দ তাদের সিলেবাসে বেশ কয়েকটি পরিবর্তন এনেছে। শিক্ষার্থীদের এসএসসি লেভেল পর্যন্ত জেনারেল সিলেবাস পাঠদান এবং এসএসসি লেভেলের পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সার্টিফিকেট নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদরাসা। বাংলাদেশের কওমি মাদরাসাগুলো যেহেতু সবক্ষেত্রেই দেওবন্দের অনুসরণ করে থাকে, তাই এই ক্ষেত্রেও তাদের দেওবন্দের অনুসরণ করার আহ্বান জানানো হয়।
বাংলাদেশ কওমি ছাত্র ফোরামের আহ্বায়ক তানজিল আমিরের সভাপতিত্বে ও সদস্য সচিব জামিল সিদ্দিকীর পরিচালনায় এতে বক্তৃতা করেন- মাদরাসা দারুর রাশাদ মিরপুরের মুহতামিম মাওলানা মুহাম্মাদ সালমান, জাতীয় দ্বীনি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের মহাসচিব মুফতি মোহাম্মদ আলী, নয়া দিগন্তের সিনিয়র সহসম্পাদক ও গবেষক মাওলানা লিয়াকত আলী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়ার সাবেক অধ্যাপক ড. হাফেজ এবিএম হিজবুল্লাহ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের মুহাদ্দিস মাওলানা ওলিউর রহমান খান আজহারী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মাওলানা হুসাইনুল বান্না, জামিয়া মাদানিয়া বারিধারার মুহতামিম মাওলানা মাসউদুর রহমান ও দ্বীনিয়াত বাংলাদেশের পরিচালক মুফতি সালমান আহমাদ, কাতার ধর্ম মন্ত্রণালয়ের খতিব ও আরবি ভাষা প্রশিক্ষক মাওলানা ইউসুফ নূর প্রমুখ।
আরও বক্তব্য রাখেন- কাতার ধর্ম মন্ত্রণালয়ের খতিব ও আরবি ভাষা প্রশিক্ষক মাওলানা ইউসুফ নূর, জামিয়া সাঈদিয়া কারীমিয়ার মুহতামিম মাওলানা শেখ ফজলে বারী মাসউদ, এশিয়ার ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. এমদাদুল হক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী, দারুল আরকাম উত্তরার প্রিন্সিপাল মাওলানা সানাউল্লাহ আজহারী, জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগের সহকারী মুফতি মাওলানা আব্দুল্লাহ মাসুম।
উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ কওমি ছাত্র ফোরামের যুগ্ম আহ্বায়ক মাওলানা বান্দা মুহাম্মাদ ইমদাদুল্লাহ, সিনিয়র সদস্য মাওলানা সানাউল্লাহ, দপ্তরে দায়িত্বপ্রাপ্ত মাওলানা সাজিদ আব্দুল্লাহ প্রমুখ।
এছাড়া দেশের শীর্ষ আলেম, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক ও প্রতিনিধিত্বশীল তরুণ আলেমরা উপস্থিত ছিলেন।