ডুবোচরে আটকে যাওয়ার ভয়ে তিন ঘণ্টা আগেই ছেড়ে যায় লঞ্চ
প্রকাশ: ১৮ নভেম্বর, ২০১৯, ১:৩৭ পূর্বাহ্ণ |
অনলাইন সংস্করণ
গলাচিপা (পটুয়াখালী) প্রতিনিধিঃ
পটুয়াখালী জেলার উপকূলীয় উপজেলা গলাচিপায় জালের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য খাল, নদ-নদী। সঠিক নজরদারি ও যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এগুলোর অধিকাংশেই নাব্যতা সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে এ এলাকায় চলাচলরত নৌযান ও যাত্রীদের নানা দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এদিকে, নদীবন্দর কর্মকর্তাদের দাবি দ্রুত সময়ের মধ্যে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। ভুক্তভোগী ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, কৃষিনির্ভর এ উপজেলায় প্রধান পাঁচটি নদী।
এর মধ্যে তেঁতুলিয়া ও রামনাবাদ ছাড়া বাকিগুলো বড় ধরনের নৌযান চলাচলের জন্য প্রায় অনুপযোগী হয়ে যাচ্ছে। নদীর নব্যতা ফিরিয়ে আনতে মাঝেমধ্যে ড্রেজিং করা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।গলাচিপা দোতলা লঞ্চের এক মাস্টার নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, কয়েক মাস আগে গলাচিপা-পটুয়াখালী নদীর কলাগাছিয়া পয়েন্টে ড্রেজিং করা হয়। সেখানে দুই-তিন দিন ড্রেজিং করা হয়। কিন্তু দুই মাস ধরে ড্রেজিং মেশিন রাখা হয়েছে শুধু লোকদেখানোর জন্য। উপজেলার বুড়াগৌরাঙ্গ, দাড়ছিড়া, রামনাবাদ, আগুমুখা, ডিগ্রিসহ সব নদী ও মোহনায় সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য ডুবোচর।
এককালের রুদ্র রূপী আগুনমুখা নদী কালের আবর্তনে মৃতপ্রায় নদীতে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের একমাত্র পাঁটি নদীর মিলন স্থান আগুনমুখা বর্তমানে বিরাজ করছে বিশাল চর ও বনভূমি। ইতিহাসখ্যাত সেই আগুনমুখার প্রমত্তা এখন আর নেই। এ নদীরগুলোর মোহনায় এখন জেগে উঠেছে বিশাল চর। নদীর মাঝ বরাবর ছোট্ট একটি চ্যানেল দিয়ে কোনো মতে চলাচল করছে লঞ্চ ও ট্রলার। এ চ্যানেল দিয়ে শুধু জোয়ারের সময় নৌযান চলাচল করতে পারে। ভাটির সময় নাব্যতা সংকটের কারণে এ চ্যানেল দিয়ে লঞ্চ-ট্রলার কিছুই চলাচল করতে পারে না। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আজ পর্যন্ত এসব ডুবোচরের সীমানা চিহ্নিত করার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এ কারণে প্রায়ই নৌযানগুলো ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিভিন্ন চরে আটকে থাকে। এতে যাত্রীদের পোহাতে হয় সীমাহীন দুর্ভোগ। গলাচিপা লঞ্চঘাট ইজারাদার ও দোতলা লঞ্চ সুপারভাইজার মো. আবুল কালাম দফাদার বলেন, ‘গলাচিপার বিভিন্ন নদীতে নাব্যতা সংকট এখন তীব্র আকার নিয়েছে।
নদ-নদীগুলোতে অসংখ্য ডুবোচর জন্ম নেওয়ায় এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। গলাচিপা থেকে দোতলা লঞ্চ ঘাট থেকে ছেড়ে যাওয়ার তিন-চার ঘণ্টা আগেই পল্টুন থেকে ছেড়ে গিয়ে বাউফলের বগা লঞ্চঘাট গলাচিপার যাত্রীদের অপেক্ষো করতে হয়। একদিকে লঞ্চ কর্তৃপক্ষ যেমন বিব্রত, তেমনি যাত্রীদেরও অতিরিক্ত টাকা খরচ করতে হচ্ছে। তিনি বলেন, গলাচিপা লঞ্চঘাট থেকে ছেড়ে যেতে রামনাবাদ নদীর পটুয়াখালী অংশের শেহাকাঠী থেকে কলাগাছিয়া পর্যন্ত প্রায় দেড় কিলোমিটার নদী ডুবো চরে আটকে রয়েছে। দোতলা লঞ্চ যাত্রীদের একতলা লঞ্চ বা ট্রলার দিয়ে প্রায় ২০ কিলোমিটার নদীপথে গিয়ে লঞ্চে উঠতে হয়।
গলাচিপা লঞ্চঘাটের গিয়ে দেখা হয় লঞ্চযাত্রী ইঞ্জিনিয়ার সমিরের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘দেড়টায় লঞ্চ ছাড়ার কথা। আমি সাড়ে ১২টায় ঘাটে এসে জানতে পারলাম ডুবোচরে লঞ্চ আটকে যায়, তাই ১১টার আগেই এমভি আসাযাওয়া-২ লঞ্চটি ছেড়ে গেছে। এখন একতলা একটি লঞ্চে করে বাউফরের বগা ঘাটে যেতে হবে। তাতেও অতিরিক্ত টাকা খরচ করতে হবে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, উপকূলীয় এ এলাকার চরকাজল এলাকার জিনতলা চ্যানেলটি পলিমাটি জমে ইতিমধ্যে সিলড হয়ে গেছে। কাউখালী বুড়াগৌরাঙ্গ নদীর অপর চ্যানেলটিও বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এতে গলাচিপা-চরমোন্তাজ ও উলানিয়া-চরমোন্তাজ রুটের নৌচলাচল পুরোপুরি অচল হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
দাড়ছিড়া নদীর চর পড়ার কারণে রাঙ্গাবালী রুটে ডুবো চরে আটকে তলা ফেটে গিয়েছিল কোকা-৪ দোতলা লঞ্চটির। ওই সময় লঞ্চটিতে কোন হতাহত না হলে বিভিন্ন মালামালের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বলে লঞ্চ কর্তৃপক্ষ জানায়। এরকম প্রতিদিন ওই এলকায় ছোট-বড় লঞ্চ, ট্রলার ডুবোচরে আটকে প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা। অন্যান্য রুটেও কমবেশি নাব্যতা বিরাজ করলেও পানি মেপে মেপে নদী অতিক্রম করছে ট্রলার বা লঞ্চ চালকরা। এর ফলে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে নৌচলাচল। এ সমস্যা সমাধানে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত প্রয়োজনীয় কোনো পদক্ষেপ নেই বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক লঞ্চ চালকরা জানান।
১২টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায় তিন লাখ লোক বসবাস করে। এর মধ্যে পাঁচটি ইউনিয়ন মূল ভূখণ্ড থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। বিচ্ছিন্ন এসব ইউনিয়নের আওতায় অর্ধ শতাধিক চরে গত তিন দশক মানব বসতি গড়ে উঠেছে। এসব চরে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম নৌপথ। দুর্গম এসকল চরে জরুরি প্রয়োজনে ট্রলারের জন্য অপেক্ষা করতে হয় পরের দিন পর্যন্ত। শুধু দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে অনন্যোপায় হয়ে সময়ক্ষেপণে অনেক রোগীর মৃত্যুবরণ করতে হয়। নদ-নদীতে চর জেগে ওঠার কারণে নদীর স্রোতের গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে ভাঙছে জনপথ। চিরতরে হারিয়ে যাচ্ছে জমি, বাড়ি, বাগান, বাজার ও পুকুরসহ সহায়-সম্পদ। এসব সম্পদ হারিয়ে অনেক পরিবার হয়েছেন ভূমিহীন।
এ ব্যাপারে মৌডুবি গলাচিপা ডিগ্রি কলেজের বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মো. সোহরাব আলী বলেন, ‘নদী ড্রেজিং ও স্রোতের গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করা হলে এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেত অনেক মানুষ। ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা যেত সহায়-সম্পদ। ‘