ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামান শামস গ্রেপ্তার
প্রকাশ: ৩০ মার্চ, ২০২৩, ১:৪২ পূর্বাহ্ণ |
অনলাইন সংস্করণ
সাভারে কর্মরত প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামান শামসের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়েছে। স্বাধীনতা দিবসের দিন মিথ্যা ও মানহানিকর তথ্য প্রচারের অভিযোগ এনে গত মঙ্গলবার রাজধানীর তেজগাঁও থানায় ওই মামলা করেন মো. গোলাম কিবরিয়া (৩৬) নামে এক ব্যক্তি। তিনি নিজেকে ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের ১১ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক বলে পরিচয় দিয়েছেন। রাত সোয়া ২টায় এই মামলা দায়ের করা হয়।
গতকাল ভোর ৪টার দিকে সিআইডির সদস্য পরিচয়ে সাভারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে আমবাগান এলাকার বাসা থেকে শামসকে আটক করা হয়। শামসকে আজ আদালতে তোলা হবে বলে জানা গেছে।
সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা ও আটকের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছে সম্পাদক পরিষদ, এডিটরস গিল্ড বাংলাদেশ, মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন, আইন ও সালিশ কেন্দ্রসহ (আসক) বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা। ২৮ বিশিষ্ট নাগরিক ও লেখক, শিক্ষক, আইনজীবীরাও এক বিবৃতিতে প্রতিবাদ জানান। নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্নাও পৃথক বিবৃতিতে এ ঘটনার নিন্দা জানান। বিবৃতি দিয়েছে গণতন্ত্র মঞ্চও। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীরা আটক শামসের মুক্তি এবং গণমাধ্যমের বাক্স্বাধীনতার দাবি জানান। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে পোস্ট দিয়ে আটক সাংবাদিকের মুক্তি চান।
শামসের গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ায়। ছেলেকে গ্রেপ্তার করার খবর শুনে তাঁর মা করিমন নেসা উৎকণ্ঠায় রয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে কি চুরি করেছে, নাকি ডাকাতি করেছে। আমার ছেলের কী অপরাধ? কেন এভাবে রাতে আমার ছেলেকে তুলে নেওয়া হলো? আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রয়োজনে কথা বলতে চাইলে শামস নিজেই যেত।’
প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ বলেন, ‘২৬ মার্চ প্রথম আলোর অনলাইনে প্রকাশিত একটি খবরে শিরোনাম ও ছবির মধ্যে যে অসংগতি ছিল, তা ৩০ মিনিটের মধ্যে সংশোধন করা হয়। শিরোনামে উদ্ধৃত করা বক্তব্যটি সবুজ মিয়ার ছিল না; সেটি ছিল দিনমজুর জাকিরের। এটি আমাদের দৃষ্টিগোচর হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া পোস্ট সরিয়ে নিই। এর পরও যদি আমাদের কোনো ভুল-ভ্রান্তি থেকে থাকে, তার জন্য প্রেস কাউন্সিল রয়েছে। মধ্যরাতে মামলার পর অতি তৎপরতার মাধ্যমে আমাদের সহকর্মীকে আটক করা হলো। এটা দুঃখজনক। দীর্ঘ সময় আমরা জানতেও পারলাম না, কারা তাকে ধরে নিল।’
সচিবালয়ে দুপুর ২টার দিকে সাংবাদিকরা শামসকে তুলে নেওয়ার বিষয়টি জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘প্রথম আলোর সাংবাদিককে মামলার পরই আটক করা হয়েছে। আইন কিন্তু নিজস্ব গতিতে চলে। কেউ যদি সংক্ষুব্ধ হয়ে বিচার চায়, মামলা রুজু করে, পুলিশ কিন্তু সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতেই পারে। আমি যতটুকু জানি, একটা মামলা রুজু হয়েছে।’
এ সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘তবে প্রথম আলোর সাংবাদিক যিনি উদ্ধৃতিটা করেছেন, সেটি সঠিক ছিল না; যেটা নাকি একাত্তর টিভির মাধ্যমে আপনারাই প্রচার করেছেন। আপনারাই সাংবাদিক ভাইয়েরা সংক্ষুব্ধ হয়ে একাত্তর টিভির মাধ্যমে এই সংবাদটা যে ভিত্তিহীন এবং মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে করা হয়েছে, একাত্তর টিভিতে সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। আমরা মনে করি, স্বাধীনতা দিবসে আমরা এতদূর এগোনোর পরে এই ধরনের একটা ভুয়া নিউজ যদি কেউ দেয়, তাহলে যে কেউ সংক্ষুব্ধ হবে। আপনাদেরও নিশ্চয়ই এই নিউজটা ভালো লাগেনি।’
শামসকে রাতের অন্ধকারে ধরে নিয়ে যেতে হবে কেন– এমন প্রশ্নের জবাবে আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘আমি তো বললাম, আমাকে জানতে হবে।’
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, সাংবাদিক শামসুজ্জামান একজন মানুষের উক্তি, সত্য ঘটনা তুলে ধরেছেন। এটি করে তিনি কী অপরাধটা করেছেন, সেটা বোধগম্য নয়।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘অপরাধটা কী, ২৬ মার্চের দিনেই এটা করাটা? তার মানে, স্বাধীনতাকে অপমান করা হয়েছে, মানহানি করা হয়েছে? একটা মানুষ যদি স্বাধীনতার দিনে ক্ষুধার্ত বোধ করে, সে যদি বঞ্চিত বোধ করে এবং সে যদি ওই কমেন্টটা দেয় যে দেশ স্বাধীন হয়ে আমার কী লাভ হলো; অপরাধটা কোথায়?’
বুধবার সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে আয়োজিত এক মানববন্ধনে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেছেন, সাংবাদিকতায় নৈতিকতা রক্ষা করতে হবে। সাংবাদিকতার সঙ্গে কোনো ষড়যন্ত্র যুক্ত হলে ছাড় দেওয়া হবে না। সেই ষড়যন্ত্রের বিষদাঁত ভেঙে দিতে হবে এবং এ ধরনের অপসাংবাদিকতার বিরুদ্ধে দেশের মানুষ রুখে দাঁড়াবে।
পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার আজিমুল হক বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় কেবল একজনের নাম রয়েছে। আমরা আসামিকে বুঝে পাইনি। মামলা সিআইডিতে হস্তান্তর করা হয়েছে।
শামস গুলশানের হলি আর্টিসানে জঙ্গি হামলায় নিহত পুলিশের সহকারী কমিশনার (এসি) রবিউল করিমের ছোট ভাই। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী।
দুই প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, বুধবার ভোর ৪টার দিকে তিনটি গাড়িতে মোট ১৬ জন সিআইডির সদস্য পরিচয়ে শামসের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়-সংলগ্ন আমবাগানের বাসার সামনে যান। পরে কক্ষ তল্লাশি করে তাঁর ব্যবহৃত একটি ল্যাপটপ, দুটি মোবাইল ফোন ও একটি পোর্টেবল হার্ডডিস্ক নিয়ে যান। বাসায় ১০-১৫ মিনিট অবস্থান করার পর তাঁকে নিয়ে ক্যাম্পাসের বটতলায় যান। সেখানে হোটেলে সেহরি খেয়ে ভোর পৌনে ৫টার দিকে তাঁরা আবার আমবাগানের বাসায় যান। সিআইডির ব্যবহৃত তিনটি গাড়ির একটিতে কোনো নম্বরপ্লেট দেখা যায়নি। তৃতীয়বার বাসায় যাওয়ার সময় আশুলিয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) রাজু মণ্ডল সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
ঘটনার সময় শামসুজ্জামানের বাসায় ছিলেন স্থানীয় সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘দ্বিতীয়বার বাসায় এসে তাঁরা জব্দ করা মালপত্রের তালিকা করেন। শামসুজ্জামানকে জামাকাপড় নিতে বলা হয়। এ সময় কক্ষের মধ্যে দাঁড় করিয়ে তাঁর ছবি তোলা হয়। ৫-৭ মিনিটের মধ্যে আবার তাঁরা বের হয়ে যান। বাসা তল্লাশির সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।’
তুলে নেওয়ার সময় ওই বাসার মালিককে ডাকেন পুলিশের এক কর্মকর্তা। পুলিশ তাঁকে জানায়, শামসুজ্জামানের করা একটি প্রতিবেদনের বিষয়ে রাষ্ট্রের আপত্তি আছে। তাই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাঁকে নেওয়া হচ্ছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা সুদীপ্ত শাহীন বলেন, ‘আমি আগে বিষয়টি জানতাম না। রাত দেড়টার দিকে পুলিশের পক্ষ থেকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। শামসের ভাবি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে শামসুজ্জামানের বাসায় নিয়ে যান।’
মামলায় যা রয়েছে : মো. গোলাম কিবরিয়া নামে কল্যাণপুর নিবাসী এক ব্যক্তি মঙ্গলবার রাত সোয়া ২টার দিকে তেজগাঁও থানায় ওই মামলা করেন। তিনি নিজেকে ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের ১১ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। মামলার বাদী গোলাম কিবরিয়া বলেন, ‘এটি দলীয় কোনো বিষয় নয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে সংক্ষুব্ধ হয়ে মামলা করেছি।’
শামসকে ১ নম্বর আসামি হিসেবে উল্লেখ করে মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, এজাহারনামীয় আসামিসহ অজ্ঞাতনামা আসামিরা অনুমতি ছাড়া মিথ্যা তথ্য-উপাত্তসহ মানহানিকর তথ্য প্রকাশ ও প্রচার করে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানোর উপক্রম ও সহায়তার অপরাধ করেছেন।
গোলাম কিবরিয়া এজাহারে লিখেছেন, ২৯ মার্চ মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১টা ৩২ মিনিটের দিকে ব্যক্তিগত কাজে তেজগাঁও থানার ফার্মগেটে আল রাজী হাসপাতালের সামনে অবস্থানকালে তাঁর ব্যবহৃত মোবাইল ফোনে ফেসবুকসহ বিভিন্ন অনলাইন পোর্টাল ব্রাউজ করেন। তখন দেখেন, ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে প্রথম আলোর ওয়েবসাইটে একটি ছবিসহ সংবাদ প্রকাশ করে। সংবাদটি প্রথম আলো তাদের ফেসবুক পেজে শেয়ার করে। সংবাদটিতে দেখা যায়, একটি শিশু ফুল হাতে জাতীয় স্মৃতিসৌধের ফটকে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিবেদকের দাবি, সেই শিশুটির নাম জাকির হোসেন। প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, শিশু জাকির হোসেন বলেছে– ‘পেটে ভাত না ফুটলে স্বাধীনতা দিয়া কী করুম। বাজারে গেলে ঘাম ছুটে যায়। আমাগো মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগব।’ সামাজিক মাধ্যমে সংবাদটি ভাইরাল হয়। দেশে-বিদেশে হাজার হাজার মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ক্রিনশটসহ শেয়ার করেন। স্বাধীনতা দিবসে দেশের গৌরবোজ্জ্বল ভাবমূর্তি নিয়ে জনগণসহ বহির্বিশ্বে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। পরবর্তী সময়ে একাত্তর টেলিভিশন চ্যানেল ও তাদের অনলাইনে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়– প্রথম আলো উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মিথ্যা পরিচয় ও উদ্ধৃতি দিয়ে সংবাদটি পরিবেশন করেছে।
প্রতিবেদনটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। ক্ষমতাসীন দলের নেতারাও ওই প্রতিবেদনের সমালোচনায় মুখর হন। প্রথম আলো প্রতিবেদনটি সংশোধন করে এবং শিরোনাম বদলে দেয়। পাশাপাশি তাদের সোশ্যাল মিডিয়ায় দেওয়া পোস্ট প্রত্যাহার করা হয়।