তিনি মিথ্যা বলছেন, গুজব ছড়াচ্ছেন, এমন অপবাদ দিয়ে তাকে তীব্র ভর্ৎসনা করে জেলের ঢুকানোর কথা বলা হয়েছিল। হুমকি দেয়া হয়েছিল, এমন তথ্য বাইরে প্রচার হলে তাকে এবং তার সঙ্গে যারা কাজ করে তাদের মেরে ফেলা হবে।
তিনি চুপ হয়ে গিয়েছিলেন, তবে তার নিজের জন্য নয়, তার সঙ্গে যেসব সহকর্মী ছিল তাদের জন্য। চিকিৎসা পেশা হল মহৎ পেশা। ডাক্তার লি তার পেশার প্রতি যথেষ্ট সৎ ছিলেন জীবন দিয়ে তা বুঝিয়ে গেছেন।
পরবর্তীতে বিশ্বের সবাই দেখেছে ডাক্তার লি সঠিক ছিলেন। কি কি ঘটেছে চীনের উহানে। ভাইরাস তাণ্ডব চালিয়েছিল। ভাইরাসের রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে ডাক্তার লি থেকে শুরু করে বহু ডাক্তার, নার্স, পুলিশ, হাসপাতাল স্টাফ মারা যান এই ভাইরাসের আক্রমণে।
যারা লি কে নিগৃহীত করেছিল তারা কেউ কিন্তু ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সেবা করেননি। বরং এই লি এবং অন্যান্য ডাক্তাররা নার্সরা জীবন বাজী রেখে রোগীদের বাঁচাতে রীতিমত যুদ্ধ করে গেছেন।
এরপর চীন থেকে ভাইরাস ছড়িয়ে পরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। এ পর্যন্ত প্রায় ২১১টি দেশে ভাইরাস আক্রমণ করেছে। এর মধ্যে, ইরান, স্পেন, আমেরিকা, ইতালিতে মহামারী বলা চলে। ইতালিতে শতকরা ১৩ শতাংশ ডাক্তার নার্স রোগীদের সেবা করতে গিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন।
আমেরিকা ডাক্তার, নার্স অনেকে প্রাইভেট প্র্যাকটিস বন্ধ করে ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন করোনা রোগীদের বাঁচানোর জন্য। বিশেষ করে নিউ ইয়র্কে।
যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চপর্যায় থেকে সর্বোচ্চ ক্ষমতা দেয়া হয়েছে ডাক্তারদের সিদ্ধান্ত নেয়ার।
রোগি দেখতে গিয়ে যারা নিজেরা আক্রান্ত, তারা ভিডিও কলের মাধ্যমে চেষ্টা করছেন রোগীদের পরামর্শ দিতে। এর মধ্যে অনেকে মারাও গেছেন। অনেকে চোখের সামনে অগণিত রোগীদের মৃত্যু দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।
কিন্তু কাউকে দেখিনি নিজের দায়িত্বে অবহেলা করে পিছিয়ে যেতে। এমনও হয়েছে ভেন্টিলেটর যথেষ্ট না থাকার কারণে তাদের সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে কোন রোগীকে তারা রাখবেন, আর অন্যদের বাড়ীতে পাঠিয়ে দিবেন।
নিজের জীবন বাজী রেখে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা করে যাচ্ছেন। অনেকে রোগি দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে হাসপাতালের চেয়ারে ঘুমিয়ে পড়েন। তবু ও বিরাম নেই।
করোনায় আক্রান্ত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন আইসিইউতে, ডাক্তাররা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সামনে কি হবে জানি না। এদিকে, মুম্বাইয়ের এক হাসপাতালের ২৬ নার্স ও ৩ চিকিৎসক কোভিড-১৯ আক্রান্ত।
তারা দায়িত্বকে অবহেলা করেননি বরং চেষ্টা ছিল ভাইরাসের রোগীকে সুস্থ করে তোলার। অন্যদের সেবা দিতে গিয়ে নিজেরাই এখন রোগী। ইংল্যান্ডে একেকজন ডাক্তার এবং নার্স ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। স্পেন, ইরান এমন কোন দেশ নেই যেখানে ডাক্তার, নার্সদের প্রচেষ্টা ছিল না। এখনো করে যাচ্ছেন।
হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়ে পরিবারের লোক চলে আসে। বাকী দায়িত্ব তো ডাক্তাররাই পালন করে। তাদের সহযোগিতা করে নার্স, হাসপাতাল স্টাফ, পুলিশ।
করোনাভাইরাসের কারণে এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে আক্রান্ত হয়েছে- ১৩,৬০,২৩২ জন। মারা গিয়েছে- ৭৫,৯৬১ জন এবং সুস্থ হয়েছে- ২,৯৩,৬১৫ জন। এর মধ্যে শত শত ডাক্তার, নার্স, পুলিশ, হাসপাতাল স্টাফ আছে, যারা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। অনেকে মারাও গেছে। অনেকে হোম কোয়ারেন্টিনে, আইসোলেশনে আছে।
ডাক্তার লি ওয়েনলিয়াং এর মৃত্যুর পর চীনের মানুষ তাকে বীরের মর্যাদা দিয়েছে। অন্তর থেকে শ্রদ্ধাপ্রদর্শন করেছে। লি’র পরিবারের কাছে ক্ষমা চেয়েছে। লিকে যারা নিগৃহীত করেছিল তাদের শাস্তি চেয়েছে চীনের জনগণ। চারদিকে মৃত্যুর মিছিল। পরিবারের আপনজন হারানোর কান্না।
ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীরাই মরে নাই; অনেক শত শত ডাক্তার, নার্স, পুলিশ, হাসপাতাল স্টাফও আক্রান্ত হয়েছে, মারাও গিয়েছে। করোনাভাইরাস রীতিমত বিশ্বে তাণ্ডব চালাচ্ছে। প্রতিনিয়ত আমরা ডাক্তারের পরামর্শ নিচ্ছি। বেশি অসুস্থ হলে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছি। বাঁচার আকুতি নিয়ে বলি বাঁচবো তো?
তারা আশ্বাস দেন, স্বপ্ন দেখান বাঁচার। অনেকে আবার বলেন প্রার্থনা করেন, আমরা সাধ্যমত চেষ্টা করবো। কিন্তু দেখা যায় অনেকে রোগি মারা যাচ্ছে। সেইসঙ্গে রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে ডাক্তার, নার্স ও আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে।
প্রতিটি দেশে এখনো হাসপাতালে বেডে রোগি ভর্তি। এখনো সেবা দিয়ে যাচ্ছে ডাক্তার, নার্সরা। তাদের সহযোগিতা করছে, পুলিশ, হাসপাতাল স্টাফ। এই ঝড় কবে থামবে কে জানে। গবেষকরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ভেক্সিন আবিষ্কারের। এখনো ট্রায়াল চলছে, বাজারে আসতে আরও পাঁচ থেকে ছয় মাস লাগবে ধারনা করা হচ্ছে।
আর ততদিনে পৃথিবীর বুক থেকে বিদায় নেবে অনেক প্রাণ। অনেকে আবার ফিরে আসবে তার আপনজনের কাছে। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের কারণে মানুষ জীবন–মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। আর সেবা দিয়ে যাচ্ছে ডাক্তার ও নার্সরা। তাদের এ অবদানের কথা মানুষ ভুলবে না।