নিজস্বপ্রতিবেদক : ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে ঢাকা থেকে বরগুনাগামী এমভি অভিযান-১০ নামক লঞ্চের ইঞ্জিন থেকে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৩৬ জনে। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক নাজমুল আলম নবীন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
ঝালকাঠি ফায়ার সার্ভিসের দায়িত্বে থাকা বরিশাল ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক মো. কামাল উদ্দিন ভূঁইয়া গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, এখনও উদ্ধার কাজ চলছে। উদ্ধার কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত বিস্তারিত কিছুই বলা যাচ্ছে না।
বৃহস্পতিবার (২৩ ডিসেম্বর) দিবাগত রাত তিনটার দিকে লঞ্চটিতে আগুন লাগে বলে যাত্রীরা জানিয়েছেন।
লঞ্চটি ঢাকা থেকে বরগুনা যাওয়ার পথে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীর দপদপিয়া এলাকায় আসলে বৃহস্পতিবার দিবারগত রাত ৩টার দিকে ইঞ্জিন কক্ষ থেকে আগুন লাগে। পরে লঞ্চটি সদর উপজেলার দিয়াকুল এলাকায় গিয়ে নদীর তীরে নোঙর করে। খবর পেয়ে ঝালকাঠির ফায়ার সার্ভিসকর্মীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে দুই ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। দগ্ধ যাত্রীদের উদ্ধার করে ঝালকাঠি ও বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। ঘটনাস্থলে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তারা উপস্থিত হয়ে উদ্ধার কাজে সহযোগিতা করছেন।
পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা লঞ্চ কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে জানান, ঢাকা থেকে দুই শতাধিক যাত্রী নিয়ে বরগুনা যাচ্ছিল এমভি অভিযান নামে একটি যাত্রীবাহী লঞ্চ। রাতে ইঞ্জিন কক্ষ থেকে আগুন লেগে ৬০ জনেরও বেশি যাত্রী দগ্ধ হয়।
দগ্ধ৭২জনশেবাচিমেভর্তি
ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে ঢাকা থেকে বরগুনাগামী ‘এমভি অভিযান-১০’ লঞ্চের আগুনে দগ্ধ ৭২ জনকে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ (শেবাচিম) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এসব রোগী ও তাদের স্বজনদের কান্না আর আর্তনাদে ভারি হয়ে উঠেছে হাসপাতাল প্রঙ্গন। চিকিৎসকদের দাবি, দুর্ঘটনায় বেশির ভাগ রোগীর শরীরের ৫০ ভাগ পুড়ে গেছে।
এদিকে শরীরের প্রায় ৭০ ভাগ পুড়ে যাওয়া তিন শিশুসহ ৫ জনকে ঢাকা বার্ণ হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়েছে। গুরুতর দগ্ধ আরো কয়েকজন রোগীর জরুরি ভিত্তিতে রক্তের প্রয়োজন রয়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। শেবাচিম হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টার আবুল কালাম আজাদ এতথ্য জানান।
শেবাচিম হাসপাতালের পরিচালক ডা. এইচ এম সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘জরুরি বিভাগে সব রোগীকে ভর্তি করা হয়েছে। তাদের জন্য পর্যাপ্ত ঔষধ, স্যালাইন, অক্সিজেন, বালিশ, বিছানা, কম্বল সরবরাহ করা হয়েছে। এছাড়া ব্লাড ডোনেশন ক্লাবগুলোকে রক্ত সরবরাহের জন্য বলা হয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘চিকিৎসক না থাকায় দীর্ঘদিন ধরে আমাদের বার্ণ ইউনিট বন্ধ রয়েছে। তবে সার্জারি ওয়ার্ডে দগ্ধ রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। হাসপাতালের সব চিকিৎসক, নার্স এবং স্টাফদের সাপ্তাহিক ছুটি বাতিলের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।’
শেবাচিম হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টার আবুল কালাম বলেন, ‘বর্তমানে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৭২ জন দগ্ধ রোগী ভর্তি আছেন। তাদের মধ্যে ৫০ জনের অবস্থা গুরুত্বর। তবে এখন পর্যন্ত (সকাল সাড়ে ১০টা) কেউ মারা যায়নি। শরীরের ৭০ ভাগ দগ্ধ হওয়ায় চিকিৎসা নিতে আসা তিন শিশুসহ ৫ জনকে ঢাকা বার্ণ হাসপাতালে রেফার্ড করেছেন মেডিক্যাল কলেজটির সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফেরদাউস আহম্মেদ ও শিশু সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. তৈহিদুল ইসলাম।’
সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফেরদাউস আহম্মেদ বলেন, ‘লঞ্চে আগুনের ঘটনায় অধিকাংশ যাত্রীর শরীরের ৫০ শতাংশের বেশি দগ্ধ হয়েছে। এর মধ্যে গুরুতর দুই রোগীকে ঢাকা বার্ণ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়েছে। এছাড়া অশংকাজনক অবস্থায় রয়েছেন আরো কয়েকজন রোগী।’
শিশু সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. তৈহিদুল ইসলাম বলেন, ‘৭টি শিশুকে দগ্ধ অবস্থায় ভর্তি করা হয়েছে। ৩ জনের অবস্থা খুবই খারাপ। তাদের ঢাকায় রেফার্ড করা হয়েছে। রেফার্ড করা তিন শিশু হল তাইফা, তামিম ও মাহিনুর। ওদের প্রত্যেকের বয়স ৫ থেকে ৭ বছরের মধ্যে।
এর আগে শুক্রবার ভোর ৫ টার পর থেকে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে লঞ্চ দুর্ঘটনায় দগ্ধ রোগীদের আনা শুরু হয়। সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত ৭২ জন রোগী এই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে পুরুষ সার্জারী ওয়ার্ডের ৩ ও ৪ নম্বর ইউনিটে ৪০ জন, মহিলা সার্জারী ওয়ার্ডে ২০ জন, শিশু সার্জারী ওয়ার্ডে ৭ জন এবং অর্থপেডিক্স ওয়ার্ডে ৫ জন ভর্তি আছেন।
ছেলেরজন্যপাগলপ্রায়মা
আদরের সন্তানকে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে খুঁজে ফিরছেন মা গিতা রানী
রাতে লঞ্চের টয়লেটে যায় আমার বড় বাবা। এরপরই লঞ্চে আগুন লাগার কথা জানতে পারি। এ সময় ছোট ছেলেকে রেখে দৌঁড়ে লঞ্চের নিচ তলায় যাওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু লোকজনের ভিড়ে কহন যে লঞ্চ হইতে বাইরে নামি নিজেই কইতে পারি না। কয়েক ঘণ্টা পর ছোট বাবাকে পাইছি। কিন্তু আমার বড় বাবারে আর পাইলাম না। আপনারা আমার বড় বাবারে দেখছেন?
এইভাবেই কান্না জড়ানো কণ্ঠে ১৪ বছর বয়সী ছেলে স্বপ্ননিলকে খুঁজে না পেয়ে শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বারান্দতে বসে আর্তনাদ করতে দেখা গেছে গিতা রানী নামের এক মাকে।
বরগুনা বামনা উপজেলার বুকাবুনিয়া গ্রামের বাসিন্দা গিতা রানী। তার স্বামী সঞ্জিব চন্দ্র হালদার ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। থাকেন ঢাকার উত্তরায়। গিতা রানী তার দুই সন্তান স্বপ্ননিল চন্দ্র হালদার ও ৬ বছর বয়সী প্রত্যায়কে নিয়ে ঢাকা থেকে ‘এমভি অভিযান-১০’ লঞ্চে করে গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছিলেন। তার বড় ছেলে স্বপ্ননিল ঢাকা উত্তরা স্কুল এ্যান্ড কলেজের ৯ শ্রেণির ছাত্র।
গিতা রানী বলেন, ‘রাতে আমার বড় ছেলে স্বপ্ননিল লঞ্চের টয়লেটে যায়। এর ৫ মিনিট পরই লঞ্চে আগুন লাগার খবর জানতে পারি। এ সময় যাত্রীরা আত্মরক্ষায় এদিক সেদিক ছুটতে থাকে। আমি আমার বড় ছেলের ফেরার অপেক্ষায় ছিলাম। বড় ছেলের চিন্তায় ছোট ছেলেকে ভুলে দৌঁড়ে লঞ্চের নিচ তলায় যাওয়ার চেষ্টা করি। যাত্রীদের ধাক্কা-ধাক্কিতে কখন যে লঞ্চ থেকে তীরে নেমে যাই তা বলতে পারবো না। তখন মনে পরে আমার ছোট ছেলে প্রত্যয় সঙ্গে নেই। অনেক খোঁজা খুঁজির পর ছোট ছেলেকে পেলেও বড় ছেলে স্বপ্ননিলকে এখনো খুঁজে পাইনি।’
তিনি বলেন, ‘ভোর থেকেই সুগন্ধা নদীর আশপাশে অনেক খোঁজাখুঁজি করেছি। সেখানে না পেয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ছুটেছি। কিন্তু কোথাও ওকে (স্বপ্ননিল) খুঁজে পাইনি। পরে শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাপসাতালে এসেছি। ’
বরগুনাগামী ‘এমভি অভিযান-১০’ লঞ্চের আগুনের ঘটনায় শুধু স্বপ্ননিলই নয় এখনো নিখোঁজ রয়েছে অগণিত মানুষ। নিখোঁজদের আত্মীয় স্বজনরা ঘটনাস্থলে তাদের স্বজনদের খুঁজে না পেয়ে এভাবেই এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অনেকেই আবার নিজের প্রিয়জনকে খুঁজতে শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভিড় করছেন। তাদের আর্তনাদে হাসপাতালটিতে এক হৃদয় বিদারক পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (২৩ ডিসেম্বর) দিবাগত রাত ৩টার দিকে ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলায় সুগন্ধা নদীর পোনাবালীয়া ইউনিয়নের দেউরী এলাকায় বরগুনাগামী ‘এমভি অভিযান-১০’ লঞ্চে আগুন লাগে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৩৬ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এখনো নিখোঁজ রয়েছে অসংখ্য যাত্রী। এছাড়া অগ্মিদগ্ধ হয়ে ঝালকাঠী ও শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার্ধীন রয়েছেন শতাধিক রোগী।