বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের প্রভাবে দেশের সমুদ্র উপকূল প্রচণ্ড উত্তাল রয়েছে। স্বাভাবিকের চেয়ে পাঁচ থেকে ছয় ফুট উঁচু ঢেউ উপকূলে আছড়ে পড়ছে। নদনদীগুলো জোয়ারের পানি ধারণ করতে পারছে না। ফলে পানি ঢুকে পড়ছে লোকালয়ে। এতে পুকুর-ঘেরের মাছ ও বন্যপ্রাণী ভেসে গেছে। বাড়িঘর ডুবে গিয়ে মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। তবে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, আজ শুক্রবার বিকেল ৩টা থেকে ৬টার মধ্যে বৈরী আবহাওয়া কেটে যেতে পারে। আগামীকাল শনিবার থেকে তা স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
চট্টগ্রামে গতকাল বৃহস্পতিবার দিনের প্রায় পুরো ভাগই ছিল রোদ। কিছু সময় আকাশ মেঘলা হলেও বৃষ্টির দেখা মিলেনি। তবুও পানিতে ডুবেছে চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন এলাকার রাস্তাঘাট ও অলিগলি। কয়েক ঘণ্টার জলাবদ্ধতার দুর্ভোগে ছিলেন এসব এলাকার বাসিন্দারা। কর্ণফুলী নদীর জোয়ারে গোড়ালি থেকে হাঁটুপানিতে তলিয়েছে এসব এলাকা। গতকাল দুপুর থেকে পানি ওঠা শুরু হয়। বিকেলে নেমে যায়। বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপ থাকায় পানির উচ্চতা ছিল বেশি। নালা-নর্দমা ও খাল পরিস্কার না থাকার কারণে এ জলাবদ্ধতা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন এলাকাবাসী।
জোয়ারের পানিতে ফেরিঘাট প্লাবিত হয়ে দু’দিন ধরে লক্ষ্মীপুর-ভোলা নৌরুটে ফেরি চলাচল বন্ধ রয়েছে। এতে করে মজুচৌধুরীর হাট ফেরিঘাট এলাকায় শতাধিক পণ্যবাহী গাড়ি আটকা পড়ে আছে। এ ঘাট দিয়ে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষ যাতায়াত করে।
নদী ও সাগরের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ২ থেকে ৩ ফুট বেড়ে পটুয়াখালীসহ দেশের দক্ষিণ উপকূলের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বিশেষ করে পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার চালিতাবুনিয়া এলাকা ও কলাপাড়ার লালুয়া এলাকার বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ দিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকে ওই দুটি এলাকা তলিয়ে গেছে। দেখা দিয়েছে স্থায়ী জলাবদ্ধতা। উত্তাল সাগরের ঢেউয়ের তাণ্ডবে টিকতে না পেরে অন্তত পাঁচ হাজার ট্রলার কলাপাড়ার আলীপুর-মহিপুর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে ও রাঙ্গাবালীর চরমোন্তাজ ও মৌডুবি মৎস্যকেন্দ্রে নিরাপদে আশ্রয় নিয়েছে। গতকাল ভোর থেকে মুষলধারে বৃষ্টিতে পটুয়াখালীর জনজীবন স্থবির হয়ে পড়েছে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘর থেকে বের হয়নি।
পটুয়াখালী জেলা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাহবুবা সুখী জানান, গতকাল দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে পটুয়াখালীর খেপুপাড়ায় ৮৯ মিলিমিটার। ঘণ্টায় ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার বেগে বাতাস বইছে। আগামী কয়েকদিন বৃষ্টি অব্যাহত থাকবে বলেও জানান তিনি।
বরগুনার প্রধান তিনটি নদীতে গতকাল স্বাভাবিকের চেয়ে বিপৎসীসমার ওপর দিয়ে জোয়ারের পানি প্রবাহিত হয়েছে। এতে জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ফেরির গ্যাংওয়ে তলিয়ে যাওয়ায় সড়ক যোগাযোগ ব্যাহত হয়।
বরগুনা পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, বরগুনার বিষখালী অংশে বিপৎসীমার ৪০ সেন্টিমিটার, সাগর মোহনার পাথরঘাটা অংশে বিষখালী নদীতে বিপৎসীমার ৮৭ সেন্টিমিটার এবং পায়রা নদীতে ২৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে জোয়ারের পানি প্রবাহিত হয়।
বরগুনা সদরের মাঝেরচরের বাসিন্দা শিল্পী বেগম বলেন, আমাদের কষ্টের শেষ নেই, জোয়ারের পানিতে চুলা তলিয়ে থাকার কারণে রান্না করা যাচ্ছে না। বাচ্চারা ক্ষুধার যন্ত্রণায় কান্না করছে।
স্বাভাবিকের তুলনায় অতিরিক্ত আড়াই ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে পল্গাবিত হয়েছে মোংলার নিম্নাঞ্চলসহ পুরো সুন্দরবন এলাকা। জোয়ারে তলিয়ে গেছে পশুর নদের পাড়ের বিভিন্ন এলাকার ঘরবাড়ি। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। কানাইনগরের বাসিন্দা মনোনিত্য আদিত্য বলেন, জলোচ্ছ্বাসে থাকার ঘরটি তলিয়ে গেছে। দু’দিন ধরে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে রাস্তায় আছি।
পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের করমজল পর্যটন ও বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আজাদ কবির বলেন, জলোচ্ছ্বাসে সুন্দরবন প্লাবিত হলেও বন্যপ্রাণীর ক্ষতির তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি।
মোংলা আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ অমরেশ চন্দ্র ঢালী বলেন, লঘুচাপটি দুর্বল হয়ে ভারতের মধ্যপ্রদেশে অবস্থান করছে। এর প্রভাব ও বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হওয়া পূর্ণিমার কারণে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে অতিরিক্ত ২ থেকে ৪ ফুট উচ্চতা কিংবা তার চেয়ে বেশি জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত হবে। আজ শুক্রবার বিকেল ৩টা থেকে ৬টার পর এ বৈরী আবহাওয়া কেটে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। শনিবার থেকে আবহাওয়া স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলেও জানান তিনি।
নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার নিঝুমদ্বীপসহ নিম্নাঞ্চল জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে। নলচিড়া ইউনিয়নের তুপানিয়া গ্রামের প্রায় দুই শতাধিক পরিবারের বসতঘরে পানি উঠে গেছে।