শুক্রবার ২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
ই-পেপার   শুক্রবার ২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ



চুরি-দুর্নীতি সমস্যা নয়, প্রকাশ করলে সমস্যা
প্রকাশ: ১৮ মে, ২০২১, ১১:০৯ অপরাহ্ণ |
অনলাইন সংস্করণ

চুরি-দুর্নীতি সমস্যা নয়, প্রকাশ করলে সমস্যা

 গোলাম মোর্তোজা:

একজন সাংবাদিক রোজিনার উপর যে নিপীড়ন চলছে, প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায় তা থেকে আমরা কিছু শিখব না। ওই যে ইতিহাসের সেই নির্মম সত্য, অতীত বা চলমান ঘটনা থেকে আমরা কিছু শিখি না। লেখার পরিধি বহু বিস্তৃত করব না। মূলত সংবাদ মাধ্যম ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং রোজিনা ইসলামের এক-দেড় বছরের সাংবাদিকতার মধ্যে সীমিত থাকার চেষ্টা করব।

১. রোজিনা আসলে কী করেছেন? কিছু ভিডিও ফুটেজ থেকে ধারণা পাওয়া যায়। যে ভিডিও করা হয়েছে রোজিনাকে আটকে রাখার প্রথম পর্যায়ে। ভিডিও তারাই করেছেন যারা রোজিনাকে আটকে রেখেছিলেন। যা দেখে বোঝা যায়, ভিডিও ধারণের আগেই রোজিনার মোবাইল ফোন কেড়ে নেওয়া হয়েছে। আরও মোবাইল ফোন আছে কি না, তা সন্ধান করতে দেখা যায় অতিরিক্ত সচিব কাজী জেবুননেছাকে। তখন রোজিনার ব্যাগে কোনো কাগজ পাওয়া গেছে, এমন চিত্র দেখা যায়নি। তাদের কথাতেও বোঝা যায়নি। মোবাইলে ছবি তুলেছেন বলে সন্দেহ করছেন, সেটাই বোঝা গেছে।

২. আরেকটি সংক্ষিপ্ত ভিডিওতে দেখা যায় অতিরিক্ত সচিব কাজী জেবুননেছা সাংবাদিক রোজিনার বুক-গলা চেপে ধরছেন। ভয়ার্ত রোজিনা কিছু একটা বলছেন, জেবুননেছা হুংকার দিয়ে বলছেন ‘অবশ্যই’।

৩. তারপর রোজিনাকে ছয় ঘণ্টা আটকে রেখে মামলা সাজানো হয়েছে, ৬২ পৃষ্ঠার সরকারি গোপনীয় কাগজ রোজিনা চুরি করেছেন। প্রথম পর্যায়ের ভিডিও চিত্রে যার ইঙ্গিত ছিল না। তার ব্যাগে ৬২ পৃষ্ঠার ফাইল আছে, তা মনেও হয়নি। যদি ব্যাগে এত মোটা ফাইল থাকত, অতিরিক্ত সচিব জেবুননেছা যখন তার মোবাইল খুঁজছিলেন তখনই ফাইলটি ব্যাগ থেকে বের করতেন। তা তাকে করতে দেখা যায়নি।

৪. তাহলে ৬ ঘণ্টা আটকে রাখার তাৎপর্য এই যে, এই সময়ে ফাইলের নাটক সাজানো হয়েছে? ভিডিও করা হয়েছে? রোজিনা বাধা দিয়েছেন বলে তাকে নির্যাতন করা হয়েছে? এ কারণেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন? রোজিনা শাহবাগ থানায় তার বোনকে যা বলেছেন, তা থেকে এমনটা আমরা ধারণা করতে পারি। পুরোটা জানা যাবে যখন রোজিনা মুক্ত হবেন, তখন।

৫. ধারণা করি রোজিনা কোনো ফাইলের ছবি তুলেছিলেন। ‘কেন ছবি তুললেন’ এই প্রশ্নের আগের প্রশ্ন এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, কী ছিল সেই ফাইলে? বলা হচ্ছে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ গোপনীয় তথ্য ছিল। আসলেই কি গোপনীয় তথ্য ছিল না বড় কোনো দুর্নীতির তথ্য ছিল? যে ৬২ পৃষ্ঠার ‘ফাইল চুরি’র অভিযোগ আনা হয়েছে, রোজিনা সেই ফাইলের ছবি তুলেছিলেন? না দুর্নীতি সংক্রান্ত অন্য ফাইলের ছবি তুলেছিলেন? তা প্রমাণ হবে কীভাবে? রোজিনার মোবাইলে তোলা ছবির সঙ্গে ফাইল মিলিয়ে দেখলে সত্য জানা যাবে। রোজিনার মোবাইল কেড়ে নিয়ে নিশ্চয় সেসব ছবি ডিলিট করে দেওয়া হয়নি।

৬. গত এক বছর ধরে রোজিনা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যেসব দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশ করেছেন, সেই তথ্যগুলো কোনো না কোনো কৌশলে সংগ্রহ করেছিলেন। স্বাস্থ্য সচিব বা তার সহকারী নিশ্চয় স্বপ্রণোদিত হয়ে রোজিনাকে তথ্য-প্রমাণ সরবরাহ করেননি। পৃথিবীর সব অনুসন্ধানী সাংবাদিককে তথ্য নানা রকম কৌশলেই সংগ্রহ করতে হয়। বেসিক ব্যাংক, সোনালি ব্যাংক, ফার্মাস ব্যাংক, পিপলস লিজিং…হাজার হাজার কোটি টাকা জালিয়াতি-দুর্নীতির তথ্য নানা কৌশলেই সংগ্রহ করা হয়েছিল।

এই তথ্য সংগ্রহ প্রক্রিয়াকে ‘তথ্য চুরি’ বলে না। তারাই ‘তথ্য চুরি’ বলে যারা এসব চুরি-দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। গত এক-দেড় বছর ধরে রোজিনা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের শত শত কোটি টাকার দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশ করেছেন।

রোজিনাকে কারাগারে পাঠিয়ে প্রতিশোধ নেওয়া হয়েছে। সংবাদ মাধ্যম স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংবাদ সম্মেলন বয়কট করেছে।

৭. এবার সংবাদ মাধ্যম ও সাংবাদিকতা প্রসঙ্গে দুএকটি কথা। আজ রোজিনা নির্যাতিত হচ্ছেন, অতীতে আরও অনেকে নির্যাতিত হয়েছেন। উন্নত বিশ্ব বা ভারতও নয়, দক্ষিণ এশিয়ার ছোট ও দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যেও বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কম কেন? কেন সাংবাদিকরা এখানে এতটা নিপীড়ন, এমন কি হত্যার শিকার হন? একটু ভূমিকার অবতারণা করে প্রশ্নের উত্তরে আসছি।

সংবাদমাধ্যম বা সাংবাদিকদের অন্তর্দৃষ্টি বহুবিস্তৃত থাকে বা থাকতে হয়, এমনটাই আমাদের শেখানো হয়েছে-জানানো হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সাংবাদিক বা সংবাদ মাধ্যমের দেখার সীমা অত্যন্ত সংকুচিত। এই সংকুচিত করার একটা দৃশ্যমান প্রক্রিয়া চলমান। সংবাদমাধ্যম বা সাংবাদিকদের একটা বড় অংশ যে সেই সংকোচন প্রক্রিয়ার অংশীজন, তাও অদৃশ্য কিছু নয়। সেকারণে সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের ঘটনাটিকে আমরা শুধু সচিবালয়ের একটি রুম, সচিব, সচিবের সহকারী, কয়েকজন পুলিশ কনস্টেবলের মধ্যে সীমিত করে আলোচনা করছি। এসব ক্ষেত্রে যে বহু বিস্তৃত সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনই প্রধান বিষয়, তা আমরা দেখছি না বা দেখতে চাইছি না। সেকারণে পুরো বিষয়টিকে আমরা কয়েকজন আমলা বা আমলাতন্ত্রের মধ্যে সীমিত করে ফেলছি।

৮. আমলাতন্ত্র কখনো এমন কোনো কাজ করতে পারে না, যদি না রাজনৈতিক সরকারের সম্মতি থাকে। আর যদি করেও ফেলে, তাৎক্ষণিকভাবে সম্মতি নিয়ে নেয়। এক্ষেত্রে রোজিনার ঘটনাটি নিয়ে কেউ কেউ যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করছেন যে, সরকারের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ শুরুতেই সমাধানের জন্যে আমলাদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। কিন্তু আমলারা সেসব রাজনীতিবিদের কথা বিবেচনায় নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। সরকার নানা কারণে প্রায় সম্পূর্ণরূপে আমলা নির্ভর হয়ে পড়েছে। কারণগুলো কমবেশি আমরা সবাই জানি, আজ আর সেই আলোচনা করছি না।

রাজনৈতিক নেতৃত্ব আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে সরকার পরিচালনা করে, রাজনীতিবিদদের মাধ্যমে নয়। করোনাকালেও জেলাগুলোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সচিবদের, রাজনীতিবিদ বা এমপিদের নয়।

ফলে আমলাতন্ত্র সেই সব রাজনীতিবিদদের কথা ধর্তব্যের মধ্যে আনে না, যাদেরকে দৃশ্যমানভাবে আমরা ‘প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ’ মনে করি। আমলাতন্ত্র জানে রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে এসব রাজনীতিবিদের চেয়ে তাদের গুরুত্ব বহুগুণ বেশি। রাজনীতিবিদরা নীতি-নির্ধারণের অংশ নয়, আমলারা নীতি-নির্ধারণের অংশ। আমলারা যা করে, রোজিনার সঙ্গে যা করেছে, আরও অনেক সংবাদকর্মীদের সঙ্গে যা করেছে, রাজনৈতিক নেতৃত্বের সম্মতি-জ্ঞাতসারেই করেছে।

৯. বিগত জাতীয় নির্বাচন ও বিরোধী রাজনীতি-মত দমন ইস্যুতে সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকদের বড় অংশটি স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকা পালন করেছে। ফলে রাজনৈতিক নেতৃত্ব, আমলাতন্ত্র-আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সব সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকদের স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকায় দেখতে চায়। ব্যতিক্রমী রোজিনা ইসলামদের তারা দেখতে চায় না।

১০. রোজিনাদের নিপীড়ন করা হয় মূলত দুটি কারণে। প্রথমত, রোজিনাদের সংখ্যা খুব কম। তাদের ভয় দেখাতে পারলে, অবাধ দুর্নীতির তথ্য আর প্রকাশ হবে না। এতে দুর্নীতির সাম্রাজ্য বিস্তৃত করা সহজ হবে।

দ্বিতীয়ত, রোজিনাদের নিপীড়ন করলেও স্বেচ্ছাসেবক সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকরা জোরালো কোনো আন্দোলন বা প্রতিবাদ করবেন না। এটা খুব ভালো করে জানে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব-আমলাতন্ত্র-আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

১১. বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সাংবাদিক নিপীড়ন বিষয়ক প্রশ্নের উত্তরের মধ্য দিয়ে লেখা শেষ করি। বিষয়টি আসলে গণতন্ত্র এবং আইনের শাসনের সঙ্গে সম্পর্কিত। আইনের শাসনহীনতায় ঘটে দুর্নীতির বিস্তৃতি।

ভারতে বহু সমস্যা আছে, গণতন্ত্রও আছে। ভারতীয়রা ভোট দেন, দিনের ভোট দিনে দেন। জনগণের ভোটে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার ক্ষমতায় আসে-যায়। শ্রীলংকা, মালদ্বীপ এমন কি নেপালেও জনগণ দিনের ভোট দিনে দিয়ে সরকার ক্ষমতায় আনে, বিদায় করে। জনগণের কাছে সরকারের দায়বদ্ধতা থাকে। কিছুটা হলেও কার্যকর আছে আইনের শাসন।

বাংলাদেশের সঙ্গে সেসব দেশের নির্বাচন ও আইনের শাসনের চিত্র মেলালেই মিলবে প্রশ্নের উত্তর।

[email protected]




এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত

প্রধান উপদেষ্টা : প্রফেসর শাহ্ সাজেদা ।

উপদেষ্টা সম্পাদক : সৈয়দ এহছান আলী রনি ।

সম্পাদক ও প্রকাশক : মামুনুর রশীদ নোমানী ।

যোগাযোগ: আদালত পাড়া সদর রোড,বরিশাল।

ইমেইল: [email protected]

মোবাইল: 01713799669/01711358963

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি।
© বরিশাল খবর সম্পাদক মামুনুর রশীদ নোমানী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

  নলছিটির মগড় ইউনিয়নবাসীর সেবা করতে চান মোঃ সাইফুজ্জামান সুমন তালুকদার   প্রাণ ফিরছে বরিশাল নগরীর ৭ খালে   বেতারের সঙ্গীত শিল্পী (পল্লীগীতি) হিসেবে মনোনীত হলেন অ্যাড: জুয়েল   বরিশালের মাহমুদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্বেচ্ছাচারী প্রধান শিক্ষিকা স্ট্যান্ড-রিলিজ !   বরিশাল ল’ কলেজে দুর্নীতি, উন্নয়নের নামে অর্থ আত্মসাৎ   অনিয়ম দুর্নীতির আতুরঘর বরিশাল বেতার : চলছে জোড়াতালি দিয়ে   বরিশাল ডাকঘরের ক্যাশিয়ার নুরুল কবিরের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ   দেড় লাখ মামলা মাথায় বিএনপির ৫০ লাখ নেতাকর্মীর   আলু শুন্য বরিশালের পাইকারী বাজার   বাংলাদেশে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাধাদানকারীদের ওপর মার্কিন ভিসানীতি শুরু   মাদারীপুরের হিমাগারে ৩০ হাজার বস্তা, বাজারে আলুর কৃত্রিম সংকট   যুদ্ধ স্যাংশন সংঘাতের পথ এড়াতে প্রধানমন্ত্রীর আহবান   Mamunur Rashid Nomani charged with violating Bangladesh’s Digital Security Act   ঝালকাঠিতে রোহিঙ্গা আটক এসেছিলো ভোটার হওয়ার জন্য   সাঈদুর রহমান রিমনকে নিয়ে দিলিপ কুচক্র মহলের ষড়যন্ত্রের জবাব!   বাবুগঞ্জে ইজিবাইক ছিনতাই চক্রের চার সদস্য আটক   নলছিটিতে ৫০তম গ্রীষ্মকালীন ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ   অপরাধ ঘটাতে আগাম ‘রেকি‘ করে গেছেন তারা!   ঝালকাঠি কারাগার: কু-প্রস্তাবের দাম দশ লাখ টাকা! জেলার বহাল তবিয়তে   রাজাপুর সাব-রেজিস্ট্রার অফিস দুর্নীতির আখড়া