শনিবার ২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ ৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
ই-পেপার   শনিবার ২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ



চা যেভাবে জনপ্রিয় পানীয় হয়ে উঠলো বাংলাদেশে
প্রকাশ: ২২ মে, ২০২২, ২:১৮ পূর্বাহ্ণ |
অনলাইন সংস্করণ

চা যেভাবে জনপ্রিয় পানীয় হয়ে উঠলো বাংলাদেশে

সায়েদুল ইসলাম,বিবিসি বাংলা :

বাংলাদেশে প্রতি বছর নয় কোটি কেজির বেশি চা উৎপাদন হয়, যার বেশিরভাগই দেশীয় বাজারে বিক্রি হয়। বলা হয়, বাংলাদেশে চায়ের চাহিদার প্রায় সবটাই নিজস্ব উৎপাদন থেকে মেটানো হচ্ছে।

চায়ের আদি বাড়ি যদিও চীনে ছিল, কিন্তু বাংলাদেশের শহর বা গ্রামে এই পানীয়টি এখন অত্যন্ত জনপ্রিয়। চীনের একটি পানীয় কিভাবে বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জে এরকম জনপ্রিয় হয়ে উঠলো?

বাংলাদেশে চায়ের চাষাবাদ প্রথম শুরু হয় ১৮৪০ সালে। চট্টগ্রামে কুন্ডুদের বাগান নামে সেই চা বাগান অবশ্য সফলতার মুখ দেখেনি।

এরপর ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনিছড়ায় প্রথম বাণিজ্যিক চা বাগান প্রতিষ্ঠা করা হয়। তিন বছর পর সেই বাগান থেকে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে চায়ের উৎপাদন শুরু হয়।

পরের কয়েক বছরে হবিগঞ্জে এবং মৌলভীবাজারে আরও কয়েকটি চা বাগান তৈরি হয়।

ব্রিটিশ শাসনামলে তখন স্থানীয় বাজারে চায়ের খুব বেশি চাহিদা ছিল না। বাগানের উৎপাদিত বেশিরভাগ চা ব্রিটেন রপ্তানি হতো। এছাড়া তখন এই অঞ্চলের থাকা ব্রিটিশ বা ইউরোপীয় লোকজন চা খেতেন, স্থানীয় অভিজাত গোষ্ঠীও চা খেতে শুরু করেছিলেন।

তখনো বাংলাদেশের মানুষের চায়ের জনপ্রিয়তা তৈরি হয়নি।

বাংলাদেশে চায়ের চাহিদা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।
 

চা গবেষক ইসমাইল চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯৪৭ সালে এই অঞ্চলে প্রায় ১৮ মিলিয়ন কেজির মতো চা উৎপাদিত হতো। তার প্রায় ১৫ মিলিয়নই রপ্তানি হতো, তিন মিলিয়ন কেজির মতো এখানে খাওয়া হতো। একাত্তর সালে এসে সেই উৎপাদন এসে দাঁড়ায় ৩১ মিলিয়ন কেজিতে। সুতরাং বোঝা যায়, মানুষের মধ্যে চা খাওয়ার প্রতি আগ্রহ বাড়ছিল, চায়ের উৎপাদনও বাড়ছিল।

চা শিল্পের ইতিহাস নিয়ে বাংলাদেশ চা বোর্ডের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ১৮০০ শতাব্দীর প্রথমভাগে ভারতবর্ষের আসাম ও আশেপাশের এলাকায় চা চাষ শুরু হয়। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলা বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার কর্ণফুলী নদীর তীরে চা আবাদের জন্য ১৮২৮ খ্রিষ্টাব্দে জমি বরাদ্দ হয়। কিন্তু বিভিন্ন কারণে সেখানে চা চাষ বিলম্বিত হয়।

চট্টগ্রাম শহরে ১৮৪০ খ্রিষ্টাব্দে বর্তমান চট্টগ্রাম ক্লাব সংলগ্ন এলাকায় একটি চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যা কুণ্ডুদের বাগান নামে পরিচিত। এই বাগানটিও প্রতিষ্ঠার পরপরই বিলুপ্ত হয়ে যায়। অতঃপর ১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দে মতান্তরে ১৮৪৭ খ্রিষ্টাব্দে সিলেট শহরের এয়ারপোর্ট রোডের কাছে মালনিছড়া চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়। মূলত: মালনিছড়াই বাংলাদেশের প্রথম বাণিজ্যিক চা বাগান।

দেশ স্বাধীনের পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশে শুধুমাত্র দুইটি জেলায় চা আবাদ করা হতো, একটি সিলেট জেলায় যা ‘সুরমা ভ্যালি’ নামে পরিচিত ছিল, আর অপরটি চট্টগ্রাম জেলায় যা ‘হালদা ভ্যালি’ নামে পরিচিত ছিল, যা বর্তমানে চট্টগ্রাম ভ্যালি করা হয়েছে।

খাদ্য বিষয়ক ইতিহাসবিদ এরিকা র‍্যাপোর্ট তার ‘এ থার্স্ট ফর এমপায়ার: হাউ টি শেপড মডার্ন ওয়ার্ল্ড’ বইতে লিখেছেন, ১৮৩০ সালের দিকে ব্রিটিশরা প্রতি বছর প্রায় ৪০ মিলিয়ন পাউন্ড চা পান করতো। এটা আসতো মূলত চীন থেকে।

কিন্তু ব্রিটিশদের চায়ের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়েছিল আরও আগে থেকে। তখন মূলত চীন থেকে ব্রিটেনে চা আমদানি করা হতো।

অ্যাংলো-ডাচ যুদ্ধের কারণে চীন চায়ের রপ্তানি বন্ধ করে দেয়ার পর ব্রিটিশরা বিকল্প উৎস খুঁজতে শুরু করে।

বাংলাদেশে প্রথম চা বাগান প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৮৪০ সালে, প্রথম বাণিজ্যিক বাগান তৈরি হয় ১৮৫৪ সালে
বাংলাদেশে প্রথম চা বাগান প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৮৪০ সালে, প্রথম বাণিজ্যিক বাগান তৈরি হয় ১৮৫৪ সালে

কোন কোন ইতিহাসবিদ লিখেছেন, সেই সময় ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি আফিম চাষ করে, সেগুলো চীনে পাচার করতো, তার বদলে গোপনে চীন থেকে চা আনতো।

কিন্তু চীনের ওপর নির্ভরশীলতা কাটাতে ব্রিটিশরা ভারতবর্ষের ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় চা চায়ের পরিকল্পনা শুরু করে। আসামে চায়ের একটি জাত আবিষ্কার করার পর ওই এলাকায় চা চাষে তারা বিশেষভাবে মনোযোগী হয়ে ওঠে। এভাবে দার্জিলিং, আসাম, সিলেটে তারা কয়েকটি চা বাগান প্রতিষ্ঠা করে।

কিন্তু সেসব বাজারে চা মূলত ব্রিটেনে রপ্তানি করা হতো। এছাড়া ভারতবর্ষে কর্মরত ব্রিটিশ ও ইউরোপীয়রা চা পান করতেন।

 

এরিকা র‍্যাপোর্ট লিখেছেন, উনিশ শতকের শুরুর দিকে ভারতীয়রা ব্রিটিশদের মতো চা পানে আগ্রহী হয়ে ওঠে। বিশেষ করে উনিশ শতকের শুরুর দিকে অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হলে ব্রিটিশ ভারতে উৎপাদিত মিলিয়ন মিলিয়ন পাউন্ড চা রপ্তানি আটকে যায়। তখন এসব চা স্থানীয় বাজারে বিক্রির চেষ্টা করে ব্রিটিশরা।

সেই সময় চায়ের গুণমান, স্বাস্থ্যগত উপকারিতা, স্বাদের নানারকম বিজ্ঞাপন দেয়া শুরু হয়। বড় বড় শহরগুলোয় চা পানের আলাদা দোকান তৈরি হয়ে ওঠে। তবে তখনো সেগুলো সমাজের উচ্চবিত্ত, অভিজাত শ্রেণী, বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক ছিল।

সাধারণ মানুষের মধ্যে তখনো চায়ের জনপ্রিয়তা ততোটা হয়ে ওঠেনি।

পঞ্চগড়ের চা বাগান।
 

১৯৩০ এর মন্দায় যখন ভারতবর্ষে উৎপাদিত চায়ের রপ্তানি প্রায় বন্ধ হয়ে যায়, তখন এগুলো দেশীয় বাজারে বিক্রির আগ্রাসী উদ্যোগ শুরু করে কোম্পানিগুলো। তারা ব্যাপকভাবে বিজ্ঞাপন দিতে শুরু করে। গ্রামে, গঞ্জে, বাজারে চায়ের বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়।

ইতিহাসবিদ লিজ্জি কলিংহাম তার ‘দ্যা টেস্ট অব এমপায়ার: হাউ ব্রিটেন’স কোয়েস্ট ফর ফুড শেপড দ্যা ওয়ার্ল্ড’ বইতে লিখেছেন, সেই সময় ছোট ছোট প্যাকেটে করে বিনামূল্যে চা বিতরণ করা হতো। কীভাবে চা খাওয়া হবে সেটাও তখন শিখিয়ে দেয়া হতো। কোন কোন স্থানে চায়ের সাথে দুধ বা চিনিও বিতরণ করা হতো।

বরগুনার বাসিন্দা নুরজাহান বেগম ব্রিটিশ, পাকিস্তানের আমল দেখেছেন। বিবিসি বাংলাকে বলছেন, আমার ছোট বেলায় দেখেছি, লোকজন বাজারে এসে তাঁবু গেড়ে চা তৈরি করে মানুষজনকে বিনা পয়সায় খাওয়াতো। এরপর তাদের চা তৈরি করা শিখিয়ে দিয়ে বিনা মূল্যে চায়ের প্যাকেট দিয়ে দিতো। ”

এভাবে অনেকে চা খাওয়ার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। কয়েক বছর পর তাদের বাড়িতেও চা খাওয়ার চল শুরু হয়। তবে তখন মূলত বাড়ির মুরুব্বিরা বা মেহমান এলে চা খাওয়া হতো। এভাবেই তার চোখের সামনে আস্তে আস্তে বাড়িতে ও বাজারে চা জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে।

বিশেষ করে ১৯৩০ থেকে ১৯৪০ সাল নাগাদ ভারতের ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব চাঙ্গা হয়ে ওঠে। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ব্রিটিশদের যেসব জিনিস বর্জন করতে আহ্বান জানান, তার মধ্যে চা-ও ছিল। কিন্তু চায়ের কোম্পানিগুলো চা-কে ভারতীয় একটি পানীয় হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে।

স্বাধীনতার পর ভারত ও পাকিস্তানের কোম্পানিগুলো চা বিক্রির জন্য রপ্তানির পাশাপাশি দেশীয় বাজারের ওপর জোর বাড়াতে থাকে।

একই ভাবে জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে বাংলাদেশ অঞ্চলেও।

চা গবেষক ইসমাইল চৌধুরী বলছেন, ১৯৪৭ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ১৮ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদিত হতো। তার মধ্যে ১৫ মিলিয়ন কেজি রপ্তানি হতো, বাকিটা দেশের বাজারে থাকতো।

প্রথম দিকে বিনামূল্যে চা খাওয়ানো হতো কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে
প্রথম দিকে বিনামূল্যে চা খাওয়ানো হতো কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর দেশে উৎপাদনের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৩১ মিলিয়ন কেজিতে। তার বড় একটি অংশ দেশের চাহিদা মেটাতে ব্যবহার করা হতো। আশির দশকে কোষ ক্লোন প্রযুক্তি ব্যবহারের পর নতুন নতুন চা বাগান তৈরি হতে থাকে। চায়ের দাম কমে যাওয়ার কারণে দেশের মানুষের মধ্যেও চায়ের ব্যবহার বেড়ে যায়।

তিনি বলছেন, ”চা তো আসলে একটা নির্দোষ পানীয়। এতে কোন মাদকতা নেই, স্বাস্থ্যের জন্যও অনেক উপকারিতা আছে। ক্লান্তি কাটাতে সাহায্য করে, চাঙ্গা ভাব নিয়ে আসে। মানুষ যখন আস্তে আস্তে এটা উপলব্ধি করতে শুরু করলো, তখন থেকেই চায়ের জনপ্রিয়তা বাড়তে শুরু করে। আর দেশীয় বাজারে উৎপাদিত হওয়ায় দামও বেশি হয় না। এভাবে বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জে জনপ্রিয় একটি পানীয় হিসাবে চা ছড়িয়ে পড়ে।”

বাংলাদেশের চা বোর্ডের তথ্য অনুসারে, ২০২১ সালে বাংলাদেশে ১৬৭টি চা বাগান থেকে রেকর্ড ৯ কোটি ৫ লাখ ৬ হাজার কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে।

এসব চায়ের বেশিরভাগই দেশের বাজারে বিক্রি হয়।

২০২১ সালে রপ্তানি হয়েছে মাত্র তিন লাখ ১৩ হাজার কেজি চা। সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাতে, এক লাখ ৮০ হাজার কেজি চা। এরপরে বেশি রপ্তানি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানে।




এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত

প্রধান উপদেষ্টা : প্রফেসর শাহ্ সাজেদা ।

উপদেষ্টা সম্পাদক : সৈয়দ এহছান আলী রনি ।

সম্পাদক ও প্রকাশক : মামুনুর রশীদ নোমানী ।

যোগাযোগ: আদালত পাড়া সদর রোড,বরিশাল।

ইমেইল: [email protected]

মোবাইল: 01713799669/01711358963

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি।
© বরিশাল খবর সম্পাদক মামুনুর রশীদ নোমানী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

  নলছিটির মগড় ইউনিয়নবাসীর সেবা করতে চান মোঃ সাইফুজ্জামান সুমন তালুকদার   প্রাণ ফিরছে বরিশাল নগরীর ৭ খালে   বেতারের সঙ্গীত শিল্পী (পল্লীগীতি) হিসেবে মনোনীত হলেন অ্যাড: জুয়েল   বরিশালের মাহমুদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্বেচ্ছাচারী প্রধান শিক্ষিকা স্ট্যান্ড-রিলিজ !   বরিশাল ল’ কলেজে দুর্নীতি, উন্নয়নের নামে অর্থ আত্মসাৎ   অনিয়ম দুর্নীতির আতুরঘর বরিশাল বেতার : চলছে জোড়াতালি দিয়ে   বরিশাল ডাকঘরের ক্যাশিয়ার নুরুল কবিরের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ   দেড় লাখ মামলা মাথায় বিএনপির ৫০ লাখ নেতাকর্মীর   আলু শুন্য বরিশালের পাইকারী বাজার   বাংলাদেশে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাধাদানকারীদের ওপর মার্কিন ভিসানীতি শুরু   মাদারীপুরের হিমাগারে ৩০ হাজার বস্তা, বাজারে আলুর কৃত্রিম সংকট   যুদ্ধ স্যাংশন সংঘাতের পথ এড়াতে প্রধানমন্ত্রীর আহবান   Mamunur Rashid Nomani charged with violating Bangladesh’s Digital Security Act   ঝালকাঠিতে রোহিঙ্গা আটক এসেছিলো ভোটার হওয়ার জন্য   সাঈদুর রহমান রিমনকে নিয়ে দিলিপ কুচক্র মহলের ষড়যন্ত্রের জবাব!   বাবুগঞ্জে ইজিবাইক ছিনতাই চক্রের চার সদস্য আটক   নলছিটিতে ৫০তম গ্রীষ্মকালীন ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ   অপরাধ ঘটাতে আগাম ‘রেকি‘ করে গেছেন তারা!   ঝালকাঠি কারাগার: কু-প্রস্তাবের দাম দশ লাখ টাকা! জেলার বহাল তবিয়তে   রাজাপুর সাব-রেজিস্ট্রার অফিস দুর্নীতির আখড়া