দ্রব্যমূল্য আকাশচুম্বী। কষ্টে আছে সাধারণ মানুষ। এমন সময়ে বাড়ানো হলো বিদ্যুতের দাম। শতভাগ বাড়িতে এখন বিদ্যুৎ আছে। ফলে এই মূল্যবৃদ্ধি সবার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে সীমিত আয় ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আর্থিক অনটন আরও বাড়বে বলে বিশ্নেষকরা মনে করছেন।
গণশুনানির চার দিন পর অনেকটা তাড়াহুড়া করে ১৬ বছর পর ভোক্তা পর্যায়ে নির্বাহী আদেশে বাড়ানো হলো বিদ্যুতের দাম। প্রতি ইউনিটে (কিলোওয়াট-ঘণ্টা) ৭ টাকা ১৩ পয়সা থেকে গড়ে ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ৭ টাকা ৪৮ পয়সা করার ঘোষণা দিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। ইউনিটপ্রতি গড়ে ৩৫ পয়সার কিছু বেশি দাম বাড়ানো হয়েছে। এই মূল্যবৃদ্ধি জানুয়ারি মাস থেকেই কার্যকর হবে। গ্রাহককে ফেব্রুয়ারি মাসেই বর্ধিত বিল দিতে হবে। প্রান্তিক, গরিব, ধনী, শিল্প, কৃষি, বাণিজ্যিকসহ সব গ্রাহকের বিদ্যুতের দাম সমান হারে বাড়ানো হয়েছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে বিদ্যুৎ বিভাগের এক প্রজ্ঞাপনে মূল্যবৃদ্ধির এই ঘোষণা দেওয়া হয়। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) আইন সংশোধন করে নির্বাহী ক্ষমতাবলে মূল্য বৃদ্ধি করল সরকার। সূত্রমতে, আগামীতে প্রতি মাসেই বিদ্যুতের দাম সমন্বয় করতে চাইছে সরকার। সর্বশেষ ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয় ৫ দশমিক ৭৭ শতাংশ। ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১৪ বছরে খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ১০০ দশমিক ৫৪ শতাংশ। নতুন মূল্যবৃদ্ধির ফলে বছরে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা বাড়তি আয় হবে সরকারের।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র বলছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ পেতে ভর্তুকি হ্রাসের অংশ হিসেবে দ্রুত মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণা দেওয়া হলো। কারণ, আগামী রোববার সংস্থাটির ডিএমডি আন্তোয়েনেট মনসিও সায়েহের বাংলাদেশ সফরের কথা রয়েছে। এ সময়ের মধ্যে নির্বাহী আদেশে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিরও একটি ঘোষণা আসতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিইআরসি ২০০৮ সাল থেকে গণশুনানির মাধ্যমে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম ঘোষণা করে আসছে। এর আগে ২০০৭ সালের মার্চে সর্বশেষ নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছিল।
বৈশ্বিক মন্দা পরিস্থিতির মধ্যে গত বছরের ৫ আগস্ট জ্বালানি তেলের দাম ৫২ শতাংশ বাড়ানো হয়। এর আগে ৫ জুন গ্যাসের দাম ২২ শতাংশের বেশি বাড়ানো হয়। ফলে দ্রব্যমূল্য, পরিবহন ভাড়াসহ সবকিছুর দাম হুহু করে বাড়ে। বর্তমানে অনেক নিত্যপণ্যের দাম দ্বিগুণ-তিন গুণ। নিদারুণ আর্থিক কষ্টে রয়েছে সাধারণ মানুষ। এর মধ্যে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোয় সীমিত আয়ের মানুষের কষ্ট আরও বাড়বে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, মানসম্পন্ন বিদ্যুৎ না দিয়ে দাম বাড়ানো যৌক্তিক নয়। শিল্পোদ্যোক্তারা বলছেন, জ্বালানি ও ডলার সংকটে শিল্প উৎপাদনে ধস নেমেছে। এর মধ্যে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলো। এই ভার বহনের সক্ষমতা শিল্পের নেই। ভোক্তা অধিকার প্রতিনিধিরা জানান, সিস্টেম লস না কমিয়ে; ভুল নীতি-পরিকল্পনা সংশোধন এবং দুর্নীতি রোধ না করে মূল্যবৃদ্ধি জনগণের সঙ্গে প্রতারণার শামিল। বিইআরসি ঘোষিত মূল্য আদেশে ৬ বিতরণ কোম্পানির কিছু খাতে দাম ভিন্ন ভিন্ন হতো। এবার সব বিতরণ কোম্পানির জন্য একই হারে মূল্যহার ঘোষণা করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ।
এ বিষয়ে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে ভর্তুকি কমাতে বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ সমন্বয় করা হয়েছে। তিনি বলেন, পাইকারি বিদ্যুতের দাম বিইআরসি ২০ শতাংশ বাড়িয়েছে। তবে দেশের সার্বিক আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় ভোক্তা পর্যায়ে দাম ৫ শতাংশ সমন্বয় করা হয়েছে।
পাইকারি দাম বাড়ার পর গ্রাহক পর্যায়ে দাম বাড়ানোর আবেদন করে ৬ বিতরণ কোম্পানি। তাদের প্রস্তাবের ওপর গত রোববার গণশুনানির আয়োজন করে বিইআরসি। শুনানিতে বিইআরসি চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল বলেন, চলতি মাসেই বিদ্যুতের নতুন দামের আদেশ দেওয়া হবে। কিন্তু কমিশনের আদেশের আগেই সরকার প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আব্দুল জলিল সমকালকে বলেন, সরকারের সম্মতি নিয়েই শুনানি করা হয়েছিল। যেহেতু প্রজ্ঞাপন হয়ে গেছে, তাই আগামী রোববার কমিশন বৈঠকে পরবর্তী করণীয় ঠিক করা হবে।
কত বেড়েছে: গৃহস্থালির খুচরা বিদ্যুতের মূল্যহার লাইফ লাইনে (০-৫০ ইউনিট) ৩ টাকা ৭৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩ টাকা ৯৪ পয়সা করা হয়েছে। সাধারণ গ্রাহকের ক্ষেত্রে প্রথম ধাপে (০-৭৫ ইউনিট) ৪ টাকা ১৯ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৪ টাকা ৪০ পয়সা, দ্বিতীয় ধাপে (৭৬-২০০ ইউনিট) ৫ টাকা ৭২ পয়সা থেকে ৬ টাকা ১ পয়সা, তৃতীয় ধাপে (২০১-৩০০ ইউনিট) ৬ টাকা থেকে ৬ টাকা ৩০ পয়সা, চতুর্থ ধাপে (৩০১-৪০০ ইউনিট) ৬ টাকা ৩৪ পয়সা থেকে ৬ টাকা ৬৬ পয়সা, পঞ্চম ধাপে (৪০১ থেকে ৬০০ ইউনিট) ৯ টাকা ৯৪ পয়সা থেকে ১০ টাকা ৪৪ পয়সা এবং ষষ্ঠ ধাপে ৬০০ ইউনিটের ঊর্ধ্বে ১১ টাকা ৪৬ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১২ টাকা ৩ পয়সা করা হয়েছে। গৃহস্থালির পাশাপাশি দাম বেড়েছে কৃষি সেচ, শিল্প এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানেও। নতুন দাম অনুযায়ী কৃষিতে ইউনিটপ্রতি ৭ টাকা ১৬ পয়সা থেকে বেড়ে ৭ টাকা ৩৭ পয়সা হয়েছে।
ক্ষুদ্র শিল্পের জন্য ৮ টাকা ৫৩ পয়সা বেড়ে ৮ টাকা ৯৬ পয়সা, অফপিকে ৭ টাকা ৬৮ পয়সা থেকে বেড়ে ৮ টাকা ৬ পয়সা এবং পিক আওয়ারে ১০ টাকা ২৪ পয়সা থেকে বেড়ে ১০ টাকা ৭৫ পয়সা হয়েছে। নির্মাণে ১২ টাকা থেকে বেড়ে নতুন দাম ইউনিটপ্রতি ১২ টাকা ৬০ পয়সা; ধর্মীয়, শিক্ষা এবং দাতব্য প্রতিষ্ঠানে দাম ৬ টাকা ২ পয়সা থেকে বেড়ে ৬ টাকা ৩২ পয়সা, রাস্তার বাতি ও পানির পাম্প ৭ টাকা ৭০ পয়সা থেকে বেড়ে ৮ টাকা ৯ পয়সা, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে ফ্ল্যাট রেট ইউনিটপ্রতি ১০ টাকা ৩০ পয়সা থেকে ১০ টাকা ৮২ পয়সা, অফপিকে ৯ টাকা ২৭ পয়সা থেকে ৯ টাকা ৭৩ পয়সা এবং পিকে ১২ টাকা ৩৬ পয়সা থেকে ১২ টাকা ৯৮ পয়সা হয়েছে।
এ ছাড়া ইলেকট্রিক যানের ব্যাটারি চার্জ দিতে ফ্ল্যাট রেট ৮ টাকা ২ পয়সা, অফপিক ৭ টাকা ২২ পয়সা, সুপার অফপিক ৬ টাকা ৪২ পয়সা এবং পিকে ১০ টাকা ৩ পয়সা দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। এভাবে মাঝারি, বড়, ভারী শিল্প, বাণিজ্যিকসহ সব খাতে গড়ে ৫ শতাংশ হারে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে ডিমান্ড চার্জ বেড়েছে প্রায় সব খাতে।
প্রান্তিক ভোক্তারাও ছাড় পাননি: দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে অন্যান্য সময় সাধারণত শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সুবিধাবঞ্চিতদের বিশেষ সুবিধা দেওয়া হতো। এই পর্যায়ে গ্রাহক ৫০ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহার করলে বিল দিতেন শুধু বিদ্যুৎ বাবদ ১৮৭ টাকা ৫০ পয়সা। এখন বিদ্যুৎ কেনা বাবদ দিতে হবে ১৯৭ টাকা। এর সঙ্গে ভ্যাট (৫ শতাংশ) এবং ডিমান্ড চার্জ ৩৫ টাকা মিলিয়ে এখন ৫০ ইউনিট ব্যবহারকারীকে দিতে হবে ২৪২ টাকা।
খরচ বাড়বে জনগণের, শিল্প খাতে ব্যয় বাড়বে :বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, গত বছর জানুয়ারিতে দেশে মূল্যস্ম্ফীতি ছিল ৬ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। চলতি বছর এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৭১ শতাংশে। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোয় মূল্যস্ম্ফীতি আরও বাড়বে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সিনিয়র সহসভাপতি অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, সারাবিশ্বে ২০২৩ সালকে মূল্যস্ম্ফীতি চ্যালেঞ্জের বছর মনে করা হচ্ছে। এ রকম একটি সময়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোয় চরম নেতিবাচক অবস্থা তৈরি করা হলো। গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে, কিন্তু জনগণ গ্যাস পাচ্ছে না। বিদ্যুতের দাম বাড়ালেও নিরবচ্ছিন্ন সেবা পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই। তিনি বলেন, অভ্যন্তরীণ অপচয় ও দুর্নীতির লাগাম টানা গেলে দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হতো না।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের ফেলো ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিজনিত কৃষি এবং শিল্পের বাড়তি ব্যয় ভোক্তার ওপর চাপবে। তবে সরকারের ভর্তুকি সংক্রান্ত চাপ কমবে। তিনি বলেন, সরকার আইএমএফের চাপে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে।
জানা গেছে, বেসরকারি খাতের বিদ্যুতের খরচ মেটাতে গিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে পিডিবি ২৯ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা লোকসান করে। এর মধ্যে ১২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দেয় সরকার। চলতি অর্থবছরে ৪০ হাজার কোটি টাকার মতো ভর্তুকি প্রাক্কলন করেছে পিডিবি। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোয় আড়াই হাজার কোটি টাকা বাড়তি আয় হবে কোম্পানিগুলোর। ফলে ভর্তুকি খুব বেশি কমবে না। গত ১২ বছরে বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকার ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়েছে পিডিবি।
জানতে চাইলে নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, যে কোনো মূল্যবৃদ্ধিতে শিল্পের উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পায়। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিতে তাদেরও ব্যয় বাড়বে। তিনি সরকারের কাছে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের দাবি জানান।
খরচ কৃষকের: সার ও ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধিতে এমনিতেই চতুর্মুখী চাপে দেশের কৃষি, পোলট্রি ও ডেইরি খাত। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে আমদানিনির্ভর সব উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি। এবার মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে বিদ্যুতের দাম। এতে কৃষি উদ্যোক্তা ও চাষিরা পড়বেন বিপদে। বাড়বে উৎপাদন ব্যয়।
গবেষক আলতাফ পারভেজ বলেন, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির চাপ সামলাতে কৃষকরা সেচের ব্যবহার কমিয়ে দেবে। এতে শস্য উৎপাদনও কমে যাবে। এই বিপদ থেকে কৃষককে রক্ষার একটা উপায় ভর্তুকি দেওয়া।
কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিতে উৎপাদন ব্যাহত হবে না। ব্যয় খুবই সামান্য বাড়তে পারে।