গভীর রাতে বোট ক্লাবে চিত্রনায়িকা পরীমনিকে নিয়ে ঘটনার রেশ ধরে এখন তার পেছনের অনেক ঘটনাই চলচ্চিত্রাঙ্গণে আলোচিত হচ্ছে। একে একে বের হয়ে আসছে তার জীবনের নানা কাহিনী। কে এই পরীমনি এবং কিভাবে শো বিজে তার আগমণ ও অল্প সময়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এলেন, ফ্লপ সিনেমার নায়িকা হয়েও কিভাবে কোটি টাকার মালিক হলেন? এসব প্রশ্ন এখন চলচ্চিত্রাঙ্গণের লোকজনের মধ্যে আলোচিত হচ্ছে।
রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় থাকায় এতদিন পরীমনিকে নিয়ে কেউ তেমন উচ্চবাচ্য করেনি। তার অতীত ও বর্তমানের নানা কাহিনী জানা থাকলেও কেউ মুখ খোলেনি। তবে তাদের সবার এক কথা, পরীমনি যতটা না নায়িকা হতে পেরেছেন, তার চেয়ে বেশি প্রভাবশালী মহলে বিচরণ করতে সক্ষম হয়েছেন। তাদের কথা অনুযায়ী, আজকের পরীমনি হয়ে উঠার পেছনের নানা চমকপ্রদ ঘটনা এখন প্রকাশিত হচ্ছে।
পরীমনির বাবার ছিল রিকন্ডিশন গাড়ির ব্যবসা। তার বাড়ি যশোর হলেও ব্যবসায়িক কারণে তাকে দেশের বিভিন্ন স্থানে বাসাভাড়া করে বসবাস করতে হতো। ২০০৭-০৮ সালের দিকে পরীমনির মা অগুনে দ্বগ্ধ হয়ে মারা যান। তার মৃত্যুর বিষয়টি অনেকটা রহস্যাবৃত। এরপর থেকে পরীমনিকে তার বাবা সঙ্গে রাখতেন। পরী মাঝে মাঝে বরিশালে তার নানা বাড়ি গিয়ে থাকতেন। ২০১১ সালের দিকে পরীমনিকে নিয়ে সাভারের ব্যাংক টাউনে এক সাবেক নামকরা পুরুষ মডেলের বাসায় ভাড়া থাকতেন। এ বাড়ির দোতালায় তারা বসবাস করতেন। এ সময় পরীমনি সাভার কলেজেও ভর্তি হয়েছিলেন। তবে নিয়মিত ক্লাস করতেন না।
২০১২ সালের ২১ জানুয়ারি সিলেটে তার বাবার গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায় বলে পরীমনির ঘনিষ্ট সূত্রে জানা যায়। ধারণা করা হয়, ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বে প্রতিপক্ষ তাকে খুন করেছিল। এরপর থেকে পরীমনি একা হয়ে পড়েন। সাভারে তার এক খালার বাসায় থাকতেন। এ সময় উক্ত মডেল পরীমনিকে মিডিয়ায় কাজ করার সুযোগ করে দেয়ার জন্য চেষ্টা চালান। ২০১৪ সালে এক নাট্যপরিচালকের একটি নাটকে অভিনয়ের সুযোগ করে দেয়া হয়। নাটকটি এসএ টিভিতে প্রচার হয়েছিল।
সেই থেকে পরী মিডিয়ার নানা প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় চলে যান। নাটক থেকে চলচ্চিত্রে গিয়ে প্রভাবশালীদের ছায়ায় থেকে একের পর এক সিনেমা শুরু করেন। কোনো নতুন নায়িকার পক্ষে একসঙ্গে বিশ-পঁচিশটি সিনেমায় চুক্তিবদ্ধ হওয়া নিয়ে তখন চলচ্চিত্রাঙ্গণে বেশ তোলপাড় শুরু হয়। যদিও এসব চলচ্চিত্রের সিংহভাগই নির্মিত কিংবা মুক্তি পায়নি। এ পর্যন্ত পরীমনি অভিনীত চার-পাঁচটির বেশি সিনেমা মুক্তি পায়নি। মুক্তিপ্রাপ্ত এসব সিনেমা ব্যবসা সফল হয়নি। তারপরও পরীমনি ব্যাপক প্রভাবশালী হয়ে উঠেন।
চলচ্চিত্রের এক সময়ের বড় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান জাজ মাল্টিমিডিয়া কর্ণধার তাকে বিএমডব্লিও গাড়ি উপহার দেন বলে জানা যায়। যদিও শেষ পর্যন্ত তার প্রতিষ্ঠান থেকে পরীমনিকে নিয়ে সিনেমা নির্মিত হয়নি। চলচ্চিত্রে অভিনয় করাকালেই তার সাথে ক্ষমতাসীন দলের এক শীর্ষ স্থানীয় জনপ্রতিনিধির সাথে ঘনিষ্ট যোগাযোগ হয়। বছর কয়েক আগে ঢাকার বাইরে একটি সিনেমার শুটিং চলাকালে পরীমনিকে শুটিং স্পট থেকে হেলিকপ্টারে করে তার এলাকায় নিয়ে যান। এ নিয়ে তখন চলচ্চিত্র পাড়ায় বেশ গুঞ্জণ ছড়ায়।
এছাড়া বরিশালে আরেকটি সিনেমার শুটিং চলাকালে সেখানে পরীমনির নিরাপত্তার জন্য উক্ত জনপ্রতিনিধির অনুসারীরা দায়িত্ব পালন করে। পরবর্তীতে নানা ঘটনার পরম্পরায় উক্ত জনপ্রতিনিধির সাথে পরীমনির দূরত্ব বৃদ্ধি পায়। ইতোমধ্যে ক্ষমতাসীন দল, প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে বিভিন্ন শিল্পপতিদের সাথে তার সখ্য গড়ে উঠে।
এক বিনোদন সাংবাদিকের সাথে তার প্রেম এবং বাগদান হলেও শেষ পর্যন্ত পরিণতি লাভ করেনি। পরবর্তীতে রনি নামে এক নাট্যাভিনেতার সাথে বিয়ে হয় এবং সে বিয়েও টিকেনি। সে সময় মিডিয়ায় আসার আগে তার আরও বেশ কয়েকজনের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে বলে খবর ছড়ায়। বোট ক্লাবের ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত নাসির উদ্দিন আহমেদের সাথে তার পূর্ব পরিচয় ছিল বলে পরীমনির ঘনিষ্টজনরা জানায়। এছাড়া একটি বৃহৎ শিল্প গোষ্ঠীর ঊর্ধ্বতন ব্যক্তির সাথেও তার সম্পর্কের কথা শোনা যায়।
মাস দুয়েক আগে পরীমনি দুবাই বেড়াতে গিয়েছিলেন। সূত্রের তথ্যমতে, সে সময় তার সঙ্গে এক শিল্পপতি ছিলেন। দুবাই গিয়ে তারা বুর্জ আল খলিফার প্রেসিডেন্ট স্যুটে গিয়ে উঠেন। পরীমনি বেশ জাঁকজমকের সাথে তার গত জন্মদিনের আয়োজন করেন হোটেল সোনারগাঁওয়ে। এসব ঘটনায় চলচ্চিত্রাঙ্গণে প্রশ্ন উঠে, পরীমনির এই শানশওকতে চলার অর্থ কোথা থেকে পান। যার কোনো সিনেমা হিট হয়নি, হাতেও তেমন কাজ নেই-এ অবস্থায় অল্প সময়ে এত টাকার মালিক হলেন কিভাবে?
যেখানে অনেক নামকরা ও সুপারহিট সিনেমা উপহার দেয়া চিত্রনায়িকা যুগের পর যুগ অভিনয় করেও এত অর্থবিত্তের মালিক হতে পারেননি, সেখানে পরীমনির মতো নায়িকা যার উল্লেখ করার মতো চলচ্চিত্র ক্যারিয়ার নেই, মাত্র অল্প কয়েক বছরে অর্থবিত্তের মালিক হওয়া অস্বাভাবিক ঘটনা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চলচ্চিত্রাঙ্গণের বেশ কয়েকজন শিল্পী বলেন, শোবিজে পরীমনি তার অভিনয় দিয়ে যতটা না পরিচিতি পেয়েছেন, তার চেয়ে বেশি পরিচিতি পেয়েছেন ক্ষমতাশালী ও প্রভাবশালী মহলে তার ঘনিষ্ট চলাফেরা দিয়ে।
ক্যারিয়ারে সাফল্যহীন একজন নায়িকার পক্ষে বনানীর মতো অভিজাত এলাকায় ফ্ল্যাটে বসবাস এবং দামী গাড়ি কেনাসহ অল্প সময়ে অর্থবিত্তের মালিক হওয়া অসম্ভব। তারা বলছেন, পরীমনির আয়ের উৎসের খোঁজ নিলে তিনি তার সঠিক হিসাব দিতে পারবেন কিনা সন্দেহ আছে। কারণ, নায়িকার তকমা লাগিয়ে একজন ‘কমফোর্ট গার্ল’ হিসেবে প্রভাবশালী মহলে তিনি ঘুরে বেড়ান। তাদের দ্বারা বিভিন্নভাবে ব্যবহৃত হয়ে অর্থ-বিত্তের মালিক হয়েছেন, চলচ্চিত্র দিয়ে নয়।
চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, পরীমনির ঘটনায় চলচ্চিত্রের শিল্পী সমিতি থেকে শুরু করে অন্য সমিতিগুলোও খুব একটা সরব নয়। কারণ, তারা পরীমনির যাবতীয় ঘটনা সম্পর্কে অবগত। বিতর্কিত একজন নায়িকার পক্ষ নিয়ে সমিতিগুলো বিতর্কিত হতে ইচ্ছুক নয়। এখন গুঞ্জণ উঠেছে, শুরুতে পরীমনির ঘটনায় পুলিশ ব্যাপক তৎপর হয়ে উঠলেও সময় গড়ানোর সাথে সাথে তা তার দিকে বুমেরাং হয়ে ফিরে আসছে।