অর্থনৈতিক সংকটের সঙ্গে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেওয়ার সম্পর্ক নেই’মাসরুর আরেফিন
প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর, ২০২২, ২:০৯ পূর্বাহ্ণ |
অনলাইন সংস্করণ
মারুফ সরকার, ঢাকা ঃ কোনো সন্দেহ নেই,পৃথিবীর অন্য অনেক দেশের মতো আমাদের এখানেও একটা অর্থনৈতিক সংকট চলছে। তেমনই কোনোসন্দেহ নেই, এই সংকটের সময় কিছু মানুষ খারাপ উদ্দেশ্যে ব্যাংকের টাকা তুলে নেওয়ার বার্তা দিচ্ছে কিংবা হিসাব দিচ্ছে ব্যাংকদেউলিয়া হয়ে গেলে আপনি আপনার আমানতের কতটুকু খোয়াবেন। আমার এ লেখা দেশের অর্থনৈতিক সংকটকে অস্বীকারকরার জন্য নয়। সেই সংকটের সমাধান যদি জানতে চান, তাহলেও এটা পড়ে আপনার লাভ নেই। কিন্তু ব্যাংক থেকে আমানততুলে নেওয়ার মতো কোনো যৌক্তিক পরিস্থিতি মোটেই সৃষ্টি হয়েছে কি না, সে বোঝাবুঝিটা যেন আপনি করে নিতে পারেন, সেইকারণেই এই লেখা।
‘দেশ শ্রীলঙ্কা হচ্ছে’ গুজব ছড়িয়ে যাঁরা দেখলেন কোনো কিছুই শ্রীলঙ্কা হয়নি, তাঁরাই এখন ‘ব্যাংকে টাকা নেই, আমানত তুলেনিন’ বলা শুরু করেছেন। দেশের গভর্নর এ অবস্থায় জানিয়ে দিয়েছেন ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট নেই, বরং অতিরিক্ত তারল্যরয়েছে।
এই সেদিন আমাদের এক জেলা শহরের শাখা ব্যবস্থাপক জানালেন, তাঁর এক গ্রাহক ১৩ লাখটাকা বাসায় নিয়ে গেছেন, কারণ তাঁর ইতালিপ্রবাসী ভাই বলেছেন ব্যাংকে টাকা রাখা নিরাপদনা। দুই সপ্তাহ পরে তিনি ব্যাংকে ফিরে এসেছেন ৯ লাখ টাকা নিয়ে। বাকি ৪ লাখ টাকা তিনিখুঁজে পাচ্ছেন না, সেটা চুরি হয়ে গেছে।
সমস্যা কোথায়? দেশের গভর্নরের দেওয়া তারল্যের হিসাবে মানুষ আশ্বস্ত হতে পারছে না? নাকি ব্যাংকে ডলার নেই কিংবা ব্যাংকএলসি খুলছে না জাতীয় কথার ব্যাখ্যা তারা করেছে যে ব্যাংকে টাকাই নেই? আমার ধারণা, কোনো গুজবের কান এবং চিলদুটোই যখন দৃশ্যমান থাকে না, তখন অসুস্থ আলোচনার মধ্য দিয়ে সাধারণ জনমানসে ছড়ায় শুধু আতঙ্ক। সুস্থ আলোচনায় এমুহূর্তে প্রশ্নটা আসলে আসা উচিত ছিল এমন যে—এই সংকট কি দীর্ঘমেয়াদি। তার বদলে প্রশ্ন আসছে: দেশের অর্থনীতিরঅবস্থা খারাপ, অতএব আমার টাকা কি এখন ব্যাংকে নিরাপদ? ভুল প্রশ্ন নিয়ে আমরা বিচলিত হচ্ছি। প্রশ্নটা ভুল, কারণ এপ্রশ্নের সঙ্গে বর্তমান সংকটের সম্পর্ক অনেক দূরের। আমার এ লেখার তাগিদ সে ভুল ভাঙানোর তাগিদ। দুটো বিষয় যে আসলেসম্পর্কিত নয়, তা আপনাকে জানানোর তাগিদ।
প্রশ্ন হলো, মানুষ ব্যাংকে টাকা কেন রাখে? মোটাদাগে মানুষ কাজটা করে তিন কারণে। এক. ব্যাংকে টাকার নিরাপত্তা মেলে; দুই. চাহিবামাত্র সেই টাকা তোলা যায়; তিন. কিছু মুনাফা বা সুদ পাওয়া যায়।
বুঝলাম দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ কমছে, ডলার মার্কেটের তারল্য কমছে, বুঝলাম টাকা দিয়ে ডলার কিনতেসমস্যা হচ্ছে। কিন্তু টাকার তারল্য কি কমেছে? সোজা উত্তর, না। সে বিষয়ে বিস্তারিত বলার আগে জানাই তারল্য বিষয়টা কী?
এ মুহূর্তে দেশের ব্যাংকগুলোতে জমা থাকা মোট আমানত বা ডিপোজিটের পরিমাণ ১৪ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা।আমানতকারীদের ওই টাকা চাহিবামাত্র ফেরত দেওয়ার সক্ষমতা পরিমাপের অন্য নাম—ব্যাংকের তারল্য। আমাদের এইতারল্যের পরিমাণ বর্তমানে ৪ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু হিসাবমতে, আমাদের এই তারল্য থাকা লাগত আড়াই লাখকোটি টাকার মতো। অন্য কথায়, নিয়মমাফিক দেশের মোট আমানতের ১৭ শতাংশ টাকা নিরাপদে তুলে রাখার জায়গায়আমরা রেখেছি ২৮ শতাংশ টাকা। এ রকম উদ্বৃত্ত তারল্য বিদ্যমান থাকতে আপনি লোকের কথা শুনে ব্যাংক থেকে টাকা তুলেরাখবেন কোথায়? বাসা কি ব্যাংকের চেয়ে নিরাপদ? সত্য একটা ঘটনা বলি। এই সেদিন আমাদের এক জেলা শহরের শাখাব্যবস্থাপক জানালেন, তাঁর এক গ্রাহক ১৩ লাখ টাকা বাসায় নিয়ে গেছেন, কারণ তাঁর ইতালিপ্রবাসী ভাই বলেছেন ব্যাংকে টাকারাখা নিরাপদ না। দুই সপ্তাহ পরে তিনি ব্যাংকে ফিরে এসেছেন ৯ লাখ টাকা নিয়ে। বাকি ৪ লাখ টাকা তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না, সেটা চুরি হয়ে গেছে।
ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপনার একটা বড় তত্ত্ব হলো যে সব আমানতকারীর একসঙ্গে সব টাকা নগদ করার কোনো দিন দরকারপড়ে না। এটা চিরন্তন এক সত্য। গ্রাহকদের ব্যাংকে রাখা সঞ্চয় যদি সবার একসঙ্গে দরকার পড়ত, তাহলে পৃথিবীতে ব্যাংকিংবলে কোনো কিছুর আবিষ্কারই হতো না। ব্যাংক আপনার আমানত নিয়ে অন্যকে দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ দেয় বলেই মানুষ ঋণ নিয়েতার ব্যবসার আকার বড় করে বা বাসস্থানের জন্য দীর্ঘ মেয়াদে গৃহঋণ নেয়। এখন সব আমানতকারী যদি এসে বলেন যে, ‘সবটাকা ফেরত দাও,’ তাহলে ব্যাংকগুলোকে সব ঋণগ্রহীতার কাছে গিয়ে বলতে হবে, আপনার ফ্যাক্টরি বা বাড়ি বিক্রি করে সব টাকাফেরত দিন। সেটা অবাস্তব। এখন প্রশ্ন আসে, পুরো টাকাটা ব্যাংক থেকে মানুষ একযোগে তুলে নিতে চাইলে কতটা নিতে পারে? ইতিহাস এ ব্যাপারে কী বলে? সামগ্রিক অর্থনীতির সমূহ পতন কিংবা বিশ্বযুদ্ধের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি না হলে এমন কোনোউদাহরণ নেই যে ব্যাংক খাত থেকে মোট আমানতের ১০-১২ ভাগের বেশি টাকা একযোগে বা এক মৌসুমে বেরিয়ে গেছে। সেখানেআমরা এ দেশের গ্রাহকদের মোট আমানতের ১৭ ভাগ টাকা রক্ষিত রাখার বদলে রেখেছি ২৮ ভাগ।
মোদ্দা কথা, পৃথিবীর কোনো দেশই তার ব্যাংকিং ব্যবস্থায় জনগণের রাখা মোট আমানত নিয়ে চিন্তিত থাকে না। আমরাও ১৪লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকার মোট আমানত নিয়ে চিন্তিত নই। আমাদের দেশের ‘রিজার্ভ