চারদিকে ঘন সবুজ ঝাউবন। পাখির কলকাকলি। বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ। তীরে এসে আছড়ে পড়া সাগরের ঢেউ। এমন অপরূপ দৃশ্য আর মনোরম পরিবেশ টেনে নিয়ে আসছে পর্যটকদের।
প্রকৃতির এই দৃষ্টিনন্দন লীলাভূমিটির নাম ‘শুভসন্ধ্যা সমুদ্রসৈকত’। এর অবস্থান বরগুনা জেলার তালতলী উপজেলার সোনাকাটা ইকোপার্ক-সংলগ্ন নলবুনিয়ার চরে। প্রতিদিন হাজারো পর্যটকের আগমনে মুখর হয় এ সৈকত।
সৈকতের নামকরণ: কিছুদিন আগেও স্থানীয়দের কাছে এ স্থানের পরিচয় ছিল বালুর চর ও শুঁটকি পল্লি হিসেবে। এটিকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত করেন তালতলীর সাবেক ইউএনও বদরুদ্দোজা শুভ। পর্যটক আকৃষ্ট করতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতায় স্থানটি সুসজ্জিত করেন তিনি। এ কারণে তাঁর নাম অনুসারে স্থানীয়রা এ সৈকতের নাম দিয়েছেন ‘শুভসন্ধ্যা সমুদ্রসৈকত’। এই সমুদ্রসৈকতের পরিচিতি ছড়িয়ে দিতে সেখানে ২০১৯ সালের ২৩ নভেম্বর দেশের বৃহৎ জ্যোৎস্না উৎসবের আয়োজন করে বরগুনা জেলা প্রশাসন। এর পর থেকেই প্রতিদিন ভ্রমণপিপাসু মানুষ আসছেন এখানে। দেশি-বিদেশি পর্যটক আকৃষ্ট করতে প্রতি বছরই জ্যোৎস্না উৎসবের আয়োজন করা হয়।
অবস্থান ও সুযোগ-সুবিধা: তালতলী উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে নিশানবাড়িয়া ইউনিয়নের নলবুনিয়া এলাকায় বঙ্গোপসাগর-সংলগ্ন পায়রা নদীর মোহনায় প্রায় চার কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিশাল ঝাউবনের মধ্যে এ সৈকতের অবস্থান। পরিবার কিংবা বন্ধুদের নিয়ে ভ্রমণ বা পিকনিক করার জন্য রয়েছে সুন্দর ও মনোরম পরিবেশে যাবতীয় সুব্যবস্থা। অন্যদিকে সমুদ্রসৈকতে দাঁড়িয়ে দেখা যায় সূর্যাস্তের দৃশ্য। ঝাউবনেও ঘুরে বেড়ানোর ব্যবস্থা রয়েছে। স্থানীয়রা জানান, সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখতে শুভসন্ধ্যা সৈকতে প্রতিদিন পর্যটকদের আগমন দিন দিন বেড়েই চলেছে। পর্যটকরা এখানে এসে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হন। তাঁদের মাধ্যমে এই সৈকতের খবর ছড়িয়ে পড়েছে। তাই নতুন নতুন পর্যটকের আগমনে মুখর হচ্ছে এ সৈকত। জলতরুণী ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলসের পরিচালক আরিফুর রহমান জানান, নতুন এ সৈকতে তাঁদের ব্যবস্থাপনায় বসার সিট ও মনোমুগ্ধকর ছাতার ব্যবস্থা রয়েছে। স্বল্প খরচে তাঁবুতে রাতে থাকার ব্যবস্থাও রয়েছে। এ ছাড়া নৌভ্রমণের জন্য রয়েছে বোট সার্ভিস।
এটি স্থানীয়ভাবে ফাতরার বন হিসেবে পরিচিত। সরকার ১৯৬০ সালে একে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণা করে। ১৯৬৭ সালে এর নাম হয় টেংরাগিরি বন নামে। সরকার বন বিভাগের মাধ্যমে টেংরাগিরি সংরক্ষিত বনাঞ্চলকে ২০১০-১১ সালে প্রায় পৌনে ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে আরও আকর্ষণীয়ভাবে গড়ে তুলে ‘সোনাকাটা ইকোপার্ক’ হিসেবে ঘোষণা করে। এটির অবস্থান বরগুনার তালতলী উপজেলা সদর থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সোনাকাটা ইউনিয়নে।
বন-সৈকত-বন্যপ্রাণী: সুন্দরবনের পর এটিই সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। সমুদ্রের কোল ঘেঁষে বনটির অবস্থান। বানর, শূকর, বনমোরগ, মদনটাক, কাঠবিড়ালি, মেছোবাঘ, লাল কাঁকড়া, বকসহ বিভিন্ন প্রজাতির পশুপাখি আর সাপের অবাধ বিচরণ সোনাকাটা বনে।
বনের দক্ষিণ কোল ঘেঁষে যে সমুদ্রসৈকত তার নামই সোনাকাটা সৈকত। এই বন পূর্ব-পশ্চিমে ৯ কিলোমিটার এবং উত্তর-দক্ষিণে ৪ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। সৈকতের তটরেখায় লাল কাঁকড়াদের ছুটোছুটি। শেষ বিকেলে দিগন্তরেখায় সূর্যাস্তের দৃশ্য। সকাল-দুপুর-বিকেল পাখিদের কলকাকলিতে মুখর হয়ে ওঠে গোটা পার্ক ও চর।
এ ইকোপার্কে রয়েছে ছোট-বড় ১২টি কিল্লা ও সাতটি মিঠাপানির পুকুর। রয়েছে সুন্দরী, গেওয়া, কেওরা, সিংরা, হেতাল, সেগুনসহ কাঁটা গুল্মজাতীয় বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। বনের ভেতর দিয়ে কয়েকটি ছোট ছোট খাল বয়ে গেছে। ট্রলারে করে এইসব খাল দিয়ে ঘুরে দেখা যায় গহিন বন আর জীববৈচিত্র্যের অপূর্ব রূপ। সোনাকাটা ইকোপার্কের ভিতর দিয়ে রয়েছে পর্যটকদের চলাচলের জন্য ২ কিলোমিটার ইটের সড়ক। সড়কগুলো আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য রয়েছে ছোট ছোট সেতু। ঘন জঙ্গল আর সেতু পার হয়ে যেতে যেতে জেগে ওঠে রোমাঞ্চ। নিরিবিলি পরিবেশটাও মুগ্ধকর।
সমুদ্রসৈকতে দাঁড়িয়ে উপভোগ করা যাবে সূর্যাস্ত কিংবা সূর্যোদয়ের পাশাপাশি ছোট ছোট ট্রলারে জেলেদের জাল ফেলে ইলিশ ধরার দৃশ্য। নাগরিক কোলাহল থেকে দূরে প্রশান্তির ছোঁয়া পেতে পর্যটকদের হাতছানি দিচ্ছে শুভসন্ধ্যা সমুদ্রসৈকত ও সোনাকাটা ইকোপর্ক।
যেভাবে যেতে হয়: ঢাকা থেকে সড়ক কিংবা নৌপথে যাওয়া যায়। তবে নৌপথের যাত্রা অনেক আরামদায়ক। ভ্রমণপিয়াসীদের জন্য এটা হতে পারে নতুন অভিজ্ঞতা। প্রতিদিন ঢাকার সদরঘাট থেকে বিকেলে একে একে নৌযান যাত্রা করে পটুয়াখালীর-আমতলীর উদ্দেশে। ডেক ভাড়া জনপ্রতি ৪০০ টাকা। কেবিন সিঙ্গেল ১২০০-১৪০০ আর ডাবল ২৪০০-২৮০০ টাকা। ফ্যামিলি কেবিন ৩৫০০-৪৫০০ টাকা। পরিবারের সাত-আটজন মিলে যেতে চাইলে নিতে হবে ভিআইপি কেবিন, এর ভাড়া ৪০০০-৫০০০ টাকা।
লঞ্চ থেকে নেমেই আমতলীর বাসে উঠে পড়া। এ ছাড়া ভাড়ায় চালিত মোটরবাইক রয়েছে। আমতলী এলে মোটরবাইক, ইজিবাইকে করে যাওয়া যাবে সোনাকাটা। সড়কপথে গাবতলী কিংবা সায়েদাবাদ থেকে তালতলীর বাস রয়েছে। রাতে বাস ছাড়ে। সময় লাগবে স্বাভাবিকভাবে ৫ ঘণ্টা। নন-এসি সাকুরা, গ্রামীণ, ব্যাপারী বাসে ভাড়া পড়বে ৭০০ টাকা, এসি গ্রীন লাইন, ইউরো বাসে আমতলী পর্যন্ত ভাড়া ১৪০০ টাকা। এ ছাড়া কুয়াকাটা পর্যটন কেন্দ্র থেকে ট্রলারযোগেও যাওয়া যায়।
থাকার ব্যবস্থা: সোনাকাটা ইকোপার্ক ও শুভসন্ধ্যা সমুদ্রসৈকতের কাছেই তালতলী উপজেলা। এখানে আবাসিক হোটেল এবং কারিতাসের একটি বাংলো রয়েছে। পার্শ্ববর্তী আমতলী উপজেলা শহরে এনএসএসের বেশ উন্নত ও ভালো মানের একটি গেস্টহাউস রয়েছে।