রাজধানীর গুলশানের অভিজাত ফ্ল্যাটে কলেজছাত্রী মোসারাত জাহান মুনিয়ার (২১) রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনায় ডাক্তারি পরীক্ষায় চাঞ্চল্যকর তথ্য মিলেছে। বীর মুক্তিযোদ্ধাকন্যা মুনিয়া তিন-থেকে চার সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা (গর্ভবতী) ছিলেন বলে ফরেনসিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। কিছুদিন আগে ওই ডিএনএ প্রতিবেদন গুলশান থানায় আসে। হাসপাতাল ও পুলিশের একটি সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে।
গেল মার্চ মাস থেকে মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত গুলশানের ফ্ল্যাটে একা থাকতেন ওই কলেজছাত্রী। সেখানে তার প্রেমিক বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভীর যাতায়াত করতেন বলে নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ।
স্বজনরাও জানিয়েছেন, বিয়ের প্রলোভন দেখিয়েই মুনিয়াকে লাখ টাকার ফ্ল্যাটে রেখেছিলেন আনভীর। দীর্ঘদিন ওই তরুণীকে ভোগ করার পর দূরে সরে যেতে টাকা চুরি ও আত্মহত্যার নাটক সাজায় প্রতারক প্রেমিক বসুন্ধরা এমডি। তবে ডাক্তারি পরীক্ষায় মুনিয়ার অন্তঃসত্ত্বা থাকার বিষয়টি উঠে আসার তথ্য সত্য কি না এ বিষয়ে তদন্ত সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা কথা বলতে রাজি হননি।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) সুদীপ কুমার চক্রবর্তী মানবকণ্ঠকে বলেন, হাসপাতাল থেকে ফরেনসিক পরীক্ষার কোনো প্রতিবেদন এলে সেটি তদন্ত কর্মকর্তার কাছে আসার কথা। তিনি ভালো বলতে পারবেন। তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন ডিসি।
পরে তদন্ত কর্মকর্তা গুলশান থানার ওসি মো. আবুল হাসানের কাছে জানতে চাইলে তিনি মানবকণ্ঠকে বলেন, এমন কিছু তিনি এখনো পাননি। ডিএনএ রিপোর্টও আসেনি। তবে ময়নাতদন্তের প্রাথমিক প্রতিবেদনে মুনিয়ার অন্তঃসত্ত্বা থাকার বিষয়টি ধারণা করেছেন চিকিৎসকরা। চূড়ান্ত ফরেনসিক প্রতিবেদনে সব বিষয় পরিষ্কার হয়ে যাবে।
এদিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল ও পুলিশের অপর একটি সূত্র জানায়, গত ২৬ এপ্রিল কলেজছাত্রী মুনিয়ার রহস্যজনক মৃত্যুর পরেরদিন প্রকৃত কারণ জানতে ময়নাতদন্তের পাশাপাশি ডিএনএ ও ভিসেরা পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে নমুনা পাঠায় গুলশান থানা পুলিশ। মে মাসের প্রথম দিকে ময়নাতদন্তের প্রাথমিক প্রতিবেদন ও গেল জুন মাসের মধ্যভাগে ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদন থানায় পাঠায় ঢামেকের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ।
সূত্র জানায়, ওই প্রতিবেদনে তরুণী মোসারাত জাহান মুনিয়া মৃত্যুর আগে তিন থেকে চার সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন বলে উল্লেখ করা হয়। বিষয়টি ধামাচাপা দিতে জোর লবিং চালায় আসামিপক্ষ। বসুন্ধরা এমডি আনভীরের প্রেমিকা মুনিয়ার অন্তঃসত্ত্বা থাকার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক ও পুলিশ কর্মকর্তারা ইঙ্গিতে বুঝিয়েছেন বলে স্বীকার করেছেন মামলার বাদী নুসরাত জাহান তানিয়া ও তার স্বামী মিজানুর রহমান সানি।
মুনিয়ার বড় বোন ও ভগ্নিপতির অভিযোগ, মুনিয়াকে হত্যা ও অন্তঃসত্ত্বা থাকাসহ পুরো বিষয়গুলো ধামাচাপা দিতে সবধরনের অপচেষ্টায় লিপ্ত মূল আসামি বসুন্ধরা এমডি সায়েম সোবহান আনভীর। মনে হচ্ছে, তার আর্থিক প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে প্রশাসনও মুখ খুলছে না। গ্রেফতার তো দূরের কথা প্রায় দুই মাসেও প্রতারক প্রেমিক আনভীরকে জিজ্ঞাসাবাদ করেনি পুলিশ।
এক প্রশ্নের জবাবে মুনিয়ার বোন নুসরাত ও মিজান দাবি করেন, মার্চ মাসের শুরু থেকে এপ্রিলের ২৬ তারিখ পর্যন্ত মুনিয়া ফ্ল্যাটে একা থাকাকালে সেখানে নিয়মিত যাতায়াত ও স্বামী-স্ত্রীর মতো বসবাস করতেন প্রেমিক আনভীর। ফলে তার দ্বারা মুনিয়া অন্তঃসত্ত্বা হওয়াটাই স্বাভাবিক। ধারণা করছি, এমন নানা কারণে শেষ পর্যন্ত বিয়ে করতে রাজি না থাকায় মুনিয়াকে মুত্যুর দিকে ঠেলে দেয় আনভীর। পরবর্তীতে হত্যার পর আত্মহত্যার নাটক সাজানো হয়। এতে আনভীরের পরিবারের লোকজনও জড়িত থাকতে পারে।
অন্যদিকে সূত্র বলছে, বড় অঙ্কের টাকার বিনিময়ে মুনিয়ার পরিবারের সঙ্গে সমঝোতায় যাওয়ার অপচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন প্রধান আসামি বসুন্ধরা এমডি আনভীর। মামলা তুলে নিতে বিভিন্নজনের মাধ্যম প্রস্তাব পাঠানো হচ্ছে। এমনকি পদ্মা ব্যাংকের উচ্চপর্যায়ের লোকজনকে দিয়েও ওই ব্যাংকের কর্মকর্তা নুসরাতকে থামানোর চেষ্টা চালানো হয়েছে। এর পাশাপাশি চাপে রাখার কৌশল হিসেবে নানা অপপ্রচার চালানোও অব্যাহত রয়েছে বলে নিহতের স্বজনদের দাবি।
জানা গেছে, মুনিয়াদের বাসা কুমিল্লা শহরে। তার বাবা শফিকুর রহমান ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। মা ছিলেন সোনালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার। মা-বাবা দুজনেই কয়েক বছর আগে ইন্তেকাল করেছেন। দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে মুনিয়া ছিল ছোট। মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন মোসারাত জাহান মুনিয়া।
দেশজুড়ে আলোচিত ওই রহস্যজনক মৃত্যুর পর ‘আত্মহত্যার’ প্ররোচনার অভিযোগে বসুন্ধরা এমডি আনভীরের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় মামলা করেন মুনিয়ার বড় বোন নুসরাত। এতে তিনি অভিযোগ করেন, এক বন্ধুর মাধ্যমে পরিচয়ের পর ২০১৯ সালে বসুন্ধরা এমডি আনভীর মুনিয়াকে স্ত্রী পরিচয় দিয়ে বনানীতে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে বসবাস শুরু করেন।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে আনভীরের পরিবার মুনিয়ার সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্কের কথা জানতে পারে। তখন আমার বোনকে (মুনিয়াকে) আনভীরের জীবন থেকে সরে যাওয়ার জন্য হুমকি দেন তার মা। নুসরাত পুলিশকে জানিয়েছেন, এ ঘটনার পর আনভীর মুনিয়াকে কৌশলে কুমিল্লায় পাঠিয়ে দেন। পরবর্তীতে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে গত মার্চ মাসের এক তারিখে গুলশানের বিশালবহুল ফ্ল্যাটে মুনিয়াকে উঠান আনভীর।
প্রসঙ্গত, গত ২৬ এপ্রিল সন্ধ্যায় গুলশানের ১২০ নম্বর সড়কের ১৯ নম্বর বাসার তৃতীয় তলার একটি অভিজাত ফ্ল্যাট থেকে মুনিয়ার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। প্রতিমাসে এক লাখ ১০ হাজার টাকা ভাড়ার বিনিময়ে আনভীর মুনিয়াকে ওই ফ্ল্যাটে রেখেছিলেন। এ ঘটনা প্রকাশ পাওয়ার পর সারাদেশে তোলপাড় শুরু হয়। পরকীয়া ও হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে আনভীরকে বিচারের মুখোমুখি করার দাবি ওঠে বিভিন্ন মহল থেকে।