তীব্র ডলার সংকটের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে চিকিৎসার উপকরণ উৎপাদন ও আমদানির ওপর। গত সাত মাস ধরে এসব উপকরণের এলসি খোলা ও আমদানি ব্যাপকভাবে কমে গেছে। ওষুধ আমদানি ও দেশে উৎপাদন কমেছে। এতে আমদানিনির্ভর জীবন রক্ষাকারী ওষুধগুলো বাজারে মিলছে না। এমনকি ক্রনিক ডিজিজ বা ধারাবাহিক রোগের ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে না।
জরুরি অস্ত্রোপচার কক্ষে ব্যবহৃত প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম, হৃৎপিণ্ডের ভাল্ব ও পেসমেকারসহ বিভিন্ন মেডিকেল ডিভাইসের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।
এমনকি রক্ত পরিসঞ্চালনের বিভিন্ন উপকরণও চাহিদা অনুযায়ী আমদানি হচ্ছে না। এতে করে জীবন রক্ষাকারী চিকিৎসা উপকরণের চরম সংকট দেখা দিয়েছে। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। অনেক ক্ষেত্রে বেশি দামেও কাঙ্ক্ষিত পণ্য মিলছে না।
গত বছরের ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে আন্তর্জাতিক বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যায়। একই সঙ্গে দেশে ডলার সংকট শুরু হয়। মে মাসে এ সংকট প্রকট হয়। জুলাই থেকে চিকিৎসা উপকরণের এলসি খোলা কমে যায়। বেড়ে যায় দাম। যার প্রভাব এখন গুরুতর আকার ধারণ করেছে।
গত জানুয়ারিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি দিয়ে বলা হয়, ডলার সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো মেডিকেল ডিভাইস ও জীবনরক্ষাকারী ওষুধ আমদানির এলসি খোলা থেকে দীর্ঘ সময় ধরে বিরত থাকছে। এতে এসব উপকরণের সংকট দেখা দিয়েছে। জরুরি চিকিৎসা কার্যক্রমও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
চিঠিতে এসব উপকরণ আমদানির এলসি খোলার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করা হয়। চিঠির অনুলিপি অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে বাংলাদেশ ব্যাংককে পাঠিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারি ব্যাংকগুলো জীবন রক্ষাকারী ওষুধ ও মেডিকেল ডিভাইস আমদানির এলসি খোলার পরামর্শ দেয়। কিন্তু এখনো পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না।
রাজধানী ও বিভিন্ন জেলা শহরে ফার্মেসি মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত এক বছরে ৯০ শতাংশ ওষুধের দাম বেড়েছে।
তারা জানান-স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের তৈরি ১২টি ট্যাবলেটের একপাতা এন্টিবায়োটিক ওষুধ সেফোটিল প্লাস (৫০০ এমজি) ৫০ থেকে বেড়ে ৬০ টাকা ও মক্সাসিলিন (১০০ মিলি) সিরাপ ৪৭ থেকে ৭০ টাকা হয়েছে। একইভাবে উচ্চ রক্তচাপের প্রতি পিস বিসকোর (২.৫ এমজি) ট্যাবলেট ৬ থেকে ৭ টাকা হয়েছে। এলার্জির প্রতি পিস ফেক্সো (১২০ এমজি) ট্যাবলেট ৮ থেকে ৯ টাকা হয়েছে।
শিশুদের নাকের এন্টাজল ০০. ৫% ড্রপ ১১ থেকে ১৯ টাকা ও প্রাপ্তবয়স্কদের নাকের এন্টাজল ০.১% ড্রপ ১১ থেকে ২০ টাকা করা হয়েছে। আমাশয় রোগীদের পেটের সমস্যায় ব্যবহৃত প্রতি পিস প্রোবায়ো ক্যাপসুল ১৪ থেকে ২৫ টাকা হয়েছে।
ডায়াবেটিসের প্রতিটি কমপ্রিট (৪০ এমজি) ট্যাবলেট ৭ থেকে ৮ টাকা হয়েছে। কাঁশির তুসকা প্লাস (১০০ মিলি) সিরাপ ৮০ থেকে ৮৫ টাকা এবং ফেক্সো (৫০ মিলি) সিরাপ ৫০ থেকে ৫৫ টাকা করা হয়েছে। ক্যালসিয়ামের এক কৌটা নিউরো-বি ট্যাবলেটের দাম ২৭০ থেকে বেড়ে ৩০০ টাকা হয়েছে।
বেক্সিমকোর তৈরি শিশুদের জ্বরের চিকিৎসায় ব্যবহৃত নাপা ড্রপ ১৫ থেকে বাড়িয়ে ২০ টাকা করা হয়েছে। নাপা সিরাপ (৬০ মিলি) ২০ টাকা থেকে ৩৫ টাকা করা হয়েছে।
অপসোনিন ফার্মা লিমিটেডের তৈরি উচ্চ রক্তচাপের প্রতি পিস বিসলল-ম্যাক্স (২.৫ এমজি) ৬ থেকে ৮টা হয়েছে। ১৪টির একপাতা বিসলল (৫ এমজি) ট্যাবলেট ১৩০ থেকে ১৬০টা হয়েছে। এছাড়া গ্যাস্ট্রিকের প্রতিটি ফিনিক্স (২০ এমজি) ট্যাবলেট ৫ থেকে ৭ টাকা হয়েছে।
ইনসেপ্টার তৈরি উচ্চ রক্তচাপের প্রতি পিস ওসারটিল (৫০ এমজি) ৮ থেকে ১০ টাকা করা হয়েছে। গ্যাস্ট্রিকের চিকিৎসায় ব্যবহৃত প্রতি পিস ওমিডন (১০ এমজি) ট্যাবলেট ৩ থেকে ৪ টাকা হয়েছে।
রেনেটার তৈরি এলার্জির প্রতি পিস ফেনাডিন (১২০ এমজি) ট্যাবলেট ৮ থেকে ৯ টাকা করা হয়েছে। এসকেএফের তৈরি শিশুদের জিংক সিরাপ (১০০ মিলি) ৩৫ টাকা থেকে ৫০ টাকা হয়েছে। হামদর্দের তৈরি শিশুদের পেটফাপা ও হজমশক্তির চিকিৎসায় ব্যবহৃত নও-নেহাল সিরাপ ৬০ টাকা ৭৫ টাকা হয়েছে।
একমি কোম্পানির তৈরি শ্বাসকষ্টের চিকিৎসায় মোনাস ১০ ট্যাবলেট ১২ টাকা থেকে ১৬ টাকা হয়েছে। রেডিয়েন্ট ফার্মার তৈরি ব্যথা ও গ্যাস্ট্রিকের চিকিৎসায় ন্যপ্রোসিন প্লাস ২০ এমজি+ ৩৭৫ এমজি ট্যাবলেট ১৬ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ২০ টাকা হয়েছে। এরিস্ট্রোফার্মার তৈরি মাল্টি ভিটামিন ১৫ পিস ট্যাবলেটের কৌটা ১০৫ থেকে বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা করা হয়েছে। ৩
০ পিস ট্যাবলেটের একটি মাল্টি ভিটামিনের কৌটা ২১০ থেকে ২৭০ টাকা হয়েছে। টাইপ-২ ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ৩০টির একবক্স লিনাগ্লিপ (৫ এমজি) ট্যাবলেটের দাম ৬০০ থেকে ৬৬০ টাকা করা হয়েছে। উচ্চ রক্তচাপের জন্য ৩০টির এক বক্স রুভাসটিন (৫ এমজি) ট্যাবলেট ৩০০ থেকে ৩৬০ টাকা করা হয়েছে। এ ছাড়া ৩০টির এক বক্স রুভাসটিন (১০ এমজি) ট্যাবলেট ৬০০ থেকে ৭২০ টাকা করা হয়েছে। ডায়াবেটিকের চিকিৎসায় ৩০ পিসের একপাতা ওসারটিন (৫০ এমজি) ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা।
বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানির চিফ অপারেটিং অফিসার (সিইও) রাব্বুর রেজা যুগান্তরকে বলেন, ওষুধের র’ ম্যাটেরিয়াল, প্যাকেজিং ও বিদ্যুৎ সব কিছুতেই দাম বেড়েছে। এতে কিছু জায়গায় আমাদের সরবরাহ সংকট দেখা দিচ্ছে। ডলারের দাম বাড়ায় টাকার ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ অবমূল্যায়ন হয়েছে। কিন্তু সেভাবে ওষুধের মূল্য সমন্বয় হয়নি। তাই এটাকে দাম বাড়ানো বলা যাবে না, বরং সমন্বয় করা হয়েছে।
ডলারের দাম স্বাভাবিক হলে ওষুধের মূল্যও সমন্বয় করা হবে। আমাদের প্রতিশ্রুতিই হলো সবচেয়ে কম দামে ওষুধ সরবরাহ করা।
নাম না প্রকাশের শর্তে ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের এক আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক যুগান্তরকে বলেন, এলসি ও আমদানি কমায় কোম্পানিগুলোতে চাহিদা অনুযায়ী কাঁচামালের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। চাহিদামতো ওষুধ উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এতে বাজারে ওষুধের দাম বাড়ছে, অন্যদিকে কাঁচামাল সংকটে চাহিদামতো সব ওষুধ উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না। ফলে সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। দেশীয় ওষুধের দাম গড়ে ২০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
সম্পাদক ও প্রকাশক : মামুনুর রশীদ নোমানী ।
যোগাযোগ: আদালত পাড়া সদর রোড,বরিশাল। ইমেইল: [email protected] মোবাইল: 01713799669
কপিরাইট © সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত 2008-2023 BarisalKhabar24.com