সঞ্জিব দাস, গলাচিপা (পটুয়াখালী) প্রতিনিধিঃ
গলাচিপার আমখোলা ইউনিয়নের ২৭ জন সেদিনের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণ হারান। এখনও ঝড়ের সেই ক্ষত ঘুচেনি। আমখোলা ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য কাঞ্চন বাড়িয়া গ্রামের আলী হোসেন ফকির জানান, প্রতি বছর ১৫ নভেম্বর এলে এ গ্রামের মানুষের মনে অজানা এক আতঙ্ক দেখা দেয়। তবুও তারা জীবীকার প্রয়োজনে সাগরে ছুটে যান। ভয়াবহ পরিণতির কথা জেনেও জীবন বাজি রেখে মাছ ধরা পেশাকে বেছে নিয়েছিল গলাচিপার আমখোলা ইউনিয়নের কাঞ্চনবাড়িয়ার শতাধিক পরিবার। প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডর গলাচিপা উপজেলার আমখোলা ইউনিয়নের কাঞ্চনবাড়িয়া গ্রামের ২৭ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল। এখনও সেই ক্ষত ঘুচেনি।
পুরনো স্মৃতি ভুলে নতুন করে সংসার শুরু করেছে অনেকেই। কিন্তু এত কিছুর পরেও কি স্মৃতি ভুলে থাকা যায়? সব হারিয়ে আবার নতুন করে বাঁচার উপায় খুঁজছে তারা। অনেকে বিয়ে করে সংসার করছেন। সরেজমিনে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। কাঞ্চনবাড়িয়ার ষাটোর্ধ আবদুস সোবাহান স্ত্রী-কন্যা ও নাতিকে হারিয়ে এখন নির্বাক হয়ে আছেন। সন্ধ্যা হলে ডুকরে কেঁদে ওঠেন। তিনিও বিয়ে করে সংসারি হয়েছেন। কিন্তু সুখ নেই তাতে। স্ত্রী হালিমা বেগম, মেয়ে বিউটি, নাতি কুলসুম, মাহফুজা সিডরের জলোচ্ছ¡াসে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। বিউটি ও মাজফুজাকে আর খুজে পাওয়া যায়নি। সোবাহনের ছেলে নাসির। তার এক মাত্র পুত্র রাশেদ হারিয়েছে মাকে। তাকে নিয়ে এখন ঢাকায় দিন মজুরের কাজ করেন নাসির। রাশেদ তার মাকে হারিয়েছে আট বছরের বয়সে। তারাও আর সবার মতো মাছ ধরতে গিয়েছিল চরকলাগাছিয়ায়। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় সিডরে মাকে হারিয়ে অসহায় হয়ে গেছে। অমাবস্যা দেখলেই শিওরে ওঠে রাশেদ।
সেই ভয়াবহ স্মৃতি ভুলতে পারে না কিছুতেই। দুই সন্তানের জননী রেনু স্বামী-পুত্র সব হারিয়েছে সর্বনাশা ঘূর্ণিঝড় সিডরে। চরকলাগাছিয়ায় সবা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে বাড়ি ফিরে আসেন। দুই বছর পর পাশের গ্রামের দিন মজুর জসিমের সাথে বিয়ে হয়। এখন স্বামী সংসার নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটছে তার। আমখোলা ইউনিয়নের কাঞ্চন বাড়িয়া গ্রামের দেলোয়ার পন্ডিত (৬২) ও স্ত্রী সোনাভান বিবি (৪৬) বাড়তি আয়ের জন্য নিঃসন্তান এ দম্পতি ছুটে গিয়েছিল বঙ্গোপসাগরের মোহনা চরকলাগাছিয়ায়। গত ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় এ দম্পতির সব সুখ কেড়ে নেয় সাগরের উত্তাল ঢেউ। এক ঝাপটায় হাতে ধরে থাকা সোনাবান ভানুকে নিয়ে যায় সাগরের বিশাল এক ঢেউয়ে। নিজে কোন মতে বেঁচে গেলেও খুঁজে পাননি প্রাণ প্রিয়া স্ত্রীকে। সকালে নিজেকে একটি বড় কেওড়া গাছ থেকে উদ্ধার কর্মীরা তাকে উদ্ধার করে। ততক্ষণে তার সামনে দুপাটি দাঁত খুলে গেছে ও শরীরের বিভিন্ন অংশ হয়েছে রক্তাক্ত জখম। জ্ঞান ফেরার পর মনে পড়ে সোনাভানের কথা। দুই দিন খোঁজার পর প্রায় ১৫ কিলোমিটার উত্তরে চরমোন্তাজের মন্ডলের ঢোসের খালে লাশ পাওয়া যায় সোনভানের। স্ত্রীকে দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন দেলোয়ার পন্ডিত। গ্রামের বাড়ি কাঞ্চনবাড়িয়া এনে দাফন করা হয় সোনভানকে। পরে আত্মীয়-স্বজনদের অনুরোধে সংসার করার জন্য বিয়ে করেন প্রতিবেশি বেগমকে। এ ঘরে রয়েছে পাঁচ বছরের একটি কন্যা সন্তান মিতু ও তিন বছরের পুত্র সন্তান মুসা। সুখের সংসারে এখনও প্রতি বছর নভেম্বর মাস এলে নিজেকে সামলে রাখতে পারেন না দোলেয়ার। কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি।
কবরস্থানে গিয়ে মোনাজাত করে স্ত্রী সোনাভানের জন্য দোয়া করেন। নতুন সংসার করলেও পুরনো স্মৃতি ফিরে ফিরে আসে।
সম্পাদক ও প্রকাশক : মামুনুর রশীদ নোমানী ।
যোগাযোগ: আদালত পাড়া সদর রোড,বরিশাল। ইমেইল: [email protected] মোবাইল: 01713799669
কপিরাইট © সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত 2008-2023 BarisalKhabar24.com