কথায় বলে- “স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন”। ইতিহাসের পাতায় এমন অনেক জাতি আছে স্বাধীনতা অর্জনে যাদের আত্মত্যাগের গল্প স্মরণে রেখেছে সারাবিশ্ব, তেমনি স্বাধীনতা হারানোর মত হৃদয়বিদারক ঘটনাও নেহায়েত কম নয়। তবে নিজ দেশেই যদি মীফজাফরের মত কেউ থাকে তবে সিরাজউদ্দৌলার মতো পরিণতি অবধারিত। তেমনিই এক দূর্ভোগের শিকার হওয়া একটি দেশ সিকিম।
বৃটিশরা যখন ভারতবর্ষ ছেড়ে যাচ্ছিল, তখন তারা সিকিমকে দিয়েছিল স্বাধীন হওয়ার সূবর্ণ সুযোগ। সিকিমবাসীও শুরু থেকেই চেয়েছিলো ভারত থেকে পৃথক হয়ে স্বতন্ত্রতা অর্জন করতে। কিন্তু ১৯৭৫ সালে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হারিয়ে সিকিম হয়ে উঠে ভারতের একটি প্রদেশ।
সিকিম পরিচিতি
পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘার পাদদেশে অবস্থিত ভারতের দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম রাজ্য সিকিম সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৬ হাজার ফুট উঁচুতে অবস্থিত। মাত্র ৭,০৯৬ বর্গ কিলোমিটারের ছোট্ট দেশটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপার লীলাভূমি। চানক্য বংশ, গুপ্ত বংশ, মৌর্য্য বংশ, সুলতানি আমল, মুঘল কিংবা ব্রিটিশ আমলও সিকিমের স্বতন্ত্রতা খর্ব করতে পারেননি। যার অন্যতম কারণ ছিলো এই অঞ্চলের দুর্ভেদ্য ও দুর্গম পাহাড়ি পথ, রহস্যময় অরণ্য, বরফশীতল ঠাণ্ডা পরিবেশ এবং স্বাধীনচেতা ও শক্তিশালী সুঠাম দেহের যোদ্ধা জনগোষ্ঠী। সিকিম জয় করতে এসে স্বয়ং বাংলা বিজেতা ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খলজির হয়েছিল লেজেগোবরে অবস্থা। সিকিম অঞ্চলের অধিবাসীদের আক্রমণে সর্বস্ব হারাতে হয়েছিলো তাকে।
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এ রাজ্যের উত্তরে চীন, পশ্চিমে নেপাল, পূর্বে ভূটান, দক্ষিণে দার্জিলিং। এমন ভৌগলিক অবস্থানের কারণে সিকিম ভারতের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। সিকিমে কর্তৃত্ব স্থাপন করে পাশ্ববর্তী দেশের উপর নজরদারি রাখা অনেকটাই সহজ ছিল ভারতের জন্য। তাই ভারতের কাছে সিকিম ছিল সোনার ডিম পাড়া এক হাঁস। যার উপর কর্তৃত্ব স্থাপনের এক বিরাট ষড়যন্ত্র তৈরি হয়েছিল অনেকটা চুপিসারেই।
সিকিমের স্বাধীন পর্ব
ভারতে ব্রিটিশ শাসন শুরুর আগে সিকিম তার পার্শ্ববর্তী দেশ ভূটান এবং নেপালের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে নিজেদের স্বাধীনতা টিকিয়ে রেখেছিলো। উনবিংশ শতকের শুরুতে নেপালের গোর্খা রাজ্যের অতর্কিত আক্রমণ নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল সিকিম এবং বৃটিশ ভারত সংলগ্ন রাজ্যগুলো। এর প্রেক্ষিতে ব্রিটিশ-ভারত এবং সিকিম হাতে হাত মিলিয়ে গোর্খা রাজ্যের বিরুদ্ধে একত্রিত হয়।
১৮১৪ সালে বৃটিশ-নেপাল যুদ্ধে নেপালিরা পরাজিত হয়। এবং বৃটিশদের সাথে তারা চুক্তিবদ্ধ হয়। সেই চুক্তি অনুসারে নেপাল অধিকৃত অংশগুলো ফিরে পায় সিকিম। বৃটিশরা অবশ্য বিনা স্বার্থে সিকিমের সাথে হাত মেলায়নি। বরং সাহায্যের বিনিময়ে সিকিমের উপর নিজেদের কর্তৃত্ব স্থাপন শুরু করে দেয়।
সে সময় সিকিমের রাজা ছিলেন নামগয়াল। তাঁর উপর চাপ প্রয়োগ করে দার্জিলিং-এর দখল নিজেদের হাতে নেয় বৃটিশরা। দার্জিলিং এর পাহাড়ি এলাকায় অবকাশ যাপন কেন্দ্র তৈরির পাশাপাশি তিব্বতের সাথে বাণিজ্যিক পথ স্থাপন করে তারা। তবে সিকিমের সাথে বৃটিশদের চুক্তিতে উল্লেখ ছিল যে, তারা দার্জিলিংয়ের জন্য সিকিমকে নির্দিষ্ট পরিমাণ কর প্রদান করবে। কিন্তু এ করকে কেন্দ্র করেই ফাটল ধরে বৃটিশ-সিকিমের রাজনৈতিক সম্পর্কে। এক পর্যায়ে সিকিমে বৃটিশ সৈন্যের আগমন ঘটে। তারা দখল করে নেয় দার্জিলিং সহ সিকিমের অধিকাংশ এলাকা। ১৮৮৬ সালে নতুন করে আবার চুক্তি হয় তাদের মাঝে। এতে সিকিম হয় বৃটিশ ভারতের আশ্রিত রাজ্য।
১৮৮৮ সালে রাজা নামগয়াল আলোচনার জন্য কলকাতা গেলে তাকে বন্দী করা হয়। ১৮৯২ সালে তাকে মুক্ত করা হয় এবং বৃটিশরা মেনে নেয় সিকিমের স্বাধীনতাকে। তবে এ চুক্তি কার্যকর থাকার পরও সিকিম এবং বৃটিশ ভারতের সম্পর্কে টানাপোড়ন লেগেই ছিলো। বলে রাখা দরকার, সিকিমের স্বাধীন রাজাদের বলা হত চোগিয়াল।
প্রিন্স চার্লস ১৯০৫ সালে ভারত সফরে আসলে সিকিমের চোগিয়ালকে রাজার সম্মান দেয়া হয়। চোগিয়ালপুত্র সিডকং টুলকুকে অক্সফোর্ডে লেখাপড়া করতে পাঠানো হয়। টুলকু নামগয়াল ক্ষমতায় বসে সিকিমের ব্যাপক উন্নতি সাধন করেন।
ভারতের সাথে সংযুক্তি
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে যাওয়ার পূর্বে স্বাধীন রাজতন্ত্র হিসেবে সিকিমের স্বীকৃতি দিয়ে গিয়েছিল। তবে পরপরই ভারতে যোগ দেওয়ার প্রসঙ্গে সিকিমে অনুষ্ঠিত হয় গণভোট। যেখানে ভারতের বিরুদ্ধে ভোট পড়ে সবচেয়ে বেশী। ‘সিকিম স্টেট কংগ্রেস’ নামক একটি দলের বিরোধিতায় চাপে পড়ে ১৯৫০ সালে সিকিমের ১১তম চোগিয়াল থাসি নামগয়াল ভারতের সাথে একটি চুক্তি করতে বাধ্য হন। চুক্তি অনুসারে সিকিম ভারতের আশ্রিত রাজ্য হিসেবে ঘোষিত হয়।
সিকিম দখলের দীর্ঘ পরিকল্পনা ছিলো ভারতের। পঞ্চাশের দশকের শুরুতে যার আঁচ পাওয়া যায়। আশ্চর্যজনক বিষয় হলো পরিকল্পনার পিছনে শুধু ভারত নয়, ছিল পৃথিবীর দুই সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আমেরিকা এবং ইংল্যান্ড। শুধুমাত্র চীনকে নাস্তানাবুদ করতে তারা হাত মেলায় ভারতের সাথে। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ আমেরিকার ‘সিআইএ’ এবং ব্রিটিশদের ‘এমআই সিক্স’, তারা সিকিম প্রজেক্ট বাস্তবায়নের জন্য একসাথে দিল্লি, কলকাতা, দার্জিলিং ও শিলিগুড়িতে অফিস খোলে এবং সেখান থেকে যৌথভাবে অপারেশন পরিচালনা করতে থাকে।
এর ফলে ভারতের হাতে সিকিমের নিরাপত্তা, পররাষ্ট্র ও যোগাযোগ সম্পর্কিত বিষয়গুলোর নিয়ন্ত্রণ চলে আসে, তবে অভ্যন্তরীণ বিষয়তে সিকিম ছিল স্বাধীন। ১৯৬২ সালের ভারত-চীন যুদ্ধের পর সিকিমের গুরুত্ব বেড়ে যায়। ১৯৬৪ সালে নেহরু মারা গেলে পরিস্থিতি মোড় নেয় অন্যদিকে। চোগিয়াল হন পানডেল নামগয়াল। এ সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সর্বশক্তি নিয়োগ করেন সিকিমকে দখল করার জন্য। আর তখনই দৃশ্যপটে প্রবেশ ঘটে সিকিম ইতিহাসের খলনায়ক লেন্দুপ দর্জির।
লেন্দুপ দর্জির বিশ্বাসঘাতকতা
লেন্দুপ দর্জির ও সিকিমের রাজপরিবারের মধ্যে বংশগত শত্রুতা ছিল পুরানো। লেন্দুপ রাজতন্ত্রের বিরোধী ছিলেন। ১৯৪৫ সালে লেন্দুপ ‘সিকিম প্রজামন্ডল’ নামক একটি দল গঠন করেন, যার সভাপতি ছিলেন তিনি। ১৯৫৩-১৯৫৮ সাল পর্যন্ত সিকিম স্টেট কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬২ সালে সিকিমের আরো কয়েকটি দলকে একীভূত করে গঠন করেন ‘সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেস’। যার মূল লক্ষ্য ছিল রাজতন্ত্রের অবসান করে গণতন্ত্রের প্রচলন করা।
ভারতের ভয় ছিল সিকিম হয়তো স্বাধীনতার জন্য জাতিসংঘের কাছে আবেদন করতে পারে বা চীনের সাহায্য চাইতে পারে। এজন্য ইন্দিরা গান্ধী নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে আসেন লেন্দুপ দর্জিকে। ভারতীয় ইন্টেলিজেন্স থেকে সব রকমের সহায়তা দেয়া হতো লেন্দুপকে।
পিঠপিছনে ভারত ষড়যন্ত্রের জাল বিছিয়ে রাখছে তা ঘুণাক্ষরেও টের পাননি তৎকালীন চোগিয়াল পালডেন। যাদেরকে তিনি গুরু মানতেন সেই মহাত্মা গান্ধী ও পন্ডিত নেহেরুর উত্তরসূরীরাই যে তার রাজ্যে হানা দেবে, তা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেননি তিনি। অবশ্য ভারত এখানে বড় ধরণের চাল চেলেছিলো। একদিকে তারা পালডেনকে আশ্বস্ত করেছে, অন্যদিকে লেন্দুপ দর্জিকে কাজে লাগিয়েছে। চীন ভারতের বিষয়ে বারবার সতর্ক করেছিলো পালডেনকে। কিন্তু তিনি তা গুরুত্ব দেননি।
সিকিমে ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফলে অসন্তুষ্ট হয়ে ভোট কারচুপির অভিযোগ আনে লেন্দুপের নেতৃত্বাধীন সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেস। দেশব্যাপী তীব্র আন্দোলন শুরু হয়। যা একসময় মোড় নেয় রাজতন্ত্রের পতন আন্দোলনে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চোগিয়াল ভারত সরকারের সাহায্য চায়। ভারত সাহায্য তো করেইনি বরং তারা নতুন সংবিধান প্রণয়ন করে। এ সংবিধান অনুসারে প্রায় সব ক্ষমতাই চলে যায় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে। ১৯৭৪ সালের নির্বাচনে লেন্দুপ দর্জি অস্বাভাবিক ব্যবধানে বিজয় লাভ করে। ৩২টি আসনের মধ্যে ৩১টি আসনেই তার দল জয়ী হয়েছিল। এতে সিকিমের প্রধানমন্ত্রী হন লেন্দুপ দর্জি। আর চোগিয়াল সাংবিধানিক প্রধান হিসেবে রয়ে যান।
১৯৭৫ সালের ২৭ মার্চ লেন্দুপ দর্জি কেবিনেট মিটিংয়ে রাজতন্ত্র বিলোপের প্রশ্নে একটি সাজানো গণভোটের আয়োজন করেন। যার ফলাফলস্বরূপ অবসান ঘটে চোগিয়াল পদের। সেই বছরের ৬ এপ্রিল ভরতীয় সেনাবাহিনী বন্দী করে পানডেলকে। সেই সাথে সিকিমের স্বাধীনতার সূর্য আজীবনের জন্য অস্তমিত হয়। এরপর সবকিছু ঘটে ভারতের ছক কষে। ভারতের নির্দেশ মতো লেন্দুপ দর্জি জাতীয় পার্লামেন্টে সিকিমকে পুরোপুরি ভারতের প্রদেশ করার অনুরোধ করেন। ২৬ এপ্রিল ১৯৭৫ ভারতের ২২তম প্রদেশ হিসেবে স্বীকৃতি পায় সিকিম।
লেন্দুপ দর্জির শেষ পরিণতি
বিশ্বাসঘাতকতার ফল সবসময়ই নির্মম হয়। লেন্দুপ দর্জির বেলায়ও ভিন্ন কিছু ছিল না। ভারত তাদের স্বার্থে পুতুলের মতো ব্যবহার করেছিলো লেন্দুপকে। আর যখন প্রয়োজন মিটে গিয়েছিল তখন আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিলো লেন্দুপকে। চার বছর লেন্দুপকে মুখ্যমন্ত্রী পদে বসিয়ে রেখে ১৯৭৯ সালে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। পরবর্তী দুই বছর লেন্দুপের কেটেছে দিল্লি প্রশাসনের পেছন ঘুরে। কিন্তু লাভ হয়নি। যার জন্য স্বজাতির সাথে গাদ্দারি করলেন সেই ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎ আর মিলেনি।
অবহেলা-অযত্ন এবং নানা রকম বিড়ম্বনা ভোগ করে ১০২ বছর বয়সে কলকতায় মারা যান তিনি। সিকিমের মাটিতে শেষ আশ্রয়টুকুও আর হয়নি তাঁর৷
লেখক- ঐশ্বর্য মীম
সম্পাদক ও প্রকাশক : মামুনুর রশীদ নোমানী ।
যোগাযোগ: আদালত পাড়া সদর রোড,বরিশাল। ইমেইল: [email protected] মোবাইল: 01713799669
কপিরাইট © সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত 2008-2023 BarisalKhabar24.com