পশ্চিমা বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর কাছে ট্যাংক চেয়েছিল ইউক্রেন, তা পাওয়ার নিশ্চয়তা মিলেছে। এবার মিত্রদের কাছ থেকে চতুর্থ জেনারেশনের যুদ্ধবিমান চাচ্ছেন ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি। সম্প্রতি যুক্তরাজ্য সফরে গিয়ে তিনি জোরেশোরে এই দাবি তুলেছেন। তিনি এই যুদ্ধবিমানকে আখ্যা দিয়েছেন মুক্তির ডানা হিসেবে। ইউক্রেন মনে করছে, যুদ্ধবিমানের ডানায় ভর করে আসবে চূড়ান্ত বিজয়।
জেলেনস্কির উপদেষ্টা মিখাইলো পডলয়েকের ভাষ্য, রাশিয়ার আক্রমণের মুখে এসব যুদ্ধবিমান ইউক্রেনের আকাশ ঢেকে দেবে। ইউক্রেনের বিমান বাহিনীর যুক্তি হলো, অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান আকাশ ও মাটির ওপরের সুনির্দিষ্ট যে কোনো লক্ষ্যবস্তু গুঁড়িয়ে দিতে সক্ষম। এ বিমান হাতে পেলে যুদ্ধের গতিপথ পালটানো সম্ভব। অভিন্ন মত দিয়েছেন ইউরোপে আমেরিকার সেনাবাহিনীর সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তা বেন হেজেস। সম্প্রতি তিনি বলেছেন, আধুনিক যুদ্ধবিমান পেলে ইউক্রেন দ্রুত যুদ্ধে জিতে যাবে। পশ্চিমারা এখন যে ধরনের সহায়তা করছে, তাতে রাশিয়াকে হারাতে ইউক্রেনের আরো বছর চারেক সময় লেগে যেতে পারে। কিন্তু যুদ্ধের ফলাফল আসন্ন করতে যুদ্ধবিমান অপরিহার্য।
পশ্চিমা মিত্ররা ইউক্রেনকে মূলত প্রতিরক্ষামূলক অস্ত্রসহায়তা দিয়েছে। ইউক্রেন এখন যুদ্ধের কৌশলে পরিবর্তন আনতে চাচ্ছে। রাশিয়াকে পালটা হামলা করতে চাচ্ছে। ফিরে পেতে চাচ্ছে দখলকৃত এলাকা।
আমেরিকা, যুক্তরাজ্যসহ অন্য মিত্ররা জেলেনস্কিকে এখনো চূড়ান্ত কিছু বলেনি, তবে তাদের কিছু পদক্ষেপে মনে হচ্ছে, আজ না হোক, যুদ্ধবিমান পাচ্ছে ইউক্রেন। মনে হচ্ছে, এতদিন হিসাব করে, কিছুটা রাখডাক রেখে, ক্ষেত্রবিশেষে গোপনে পশ্চিমারা ইউক্রেনে অস্ত্র, গোলাবারুদ ও যুদ্ধসরঞ্জাম সহায়তা দিত। কিন্তু ইউক্রেন যদি যুদ্ধবিমান পায়, অর্থাৎ পশ্চিমারা যদি আধুনিক যুদ্ধবিমান সরবরাহ করে, তাহলে দেশগুলো যে ইউক্রেন যুদ্ধে পরোক্ষ নয়, বরং প্রত্যক্ষভাবে জড়িত তা জানান দেওয়া হবে।
অবশ্য কয়েক দিন আগে ট্যাংক সরবরাহের ঘোষণা দেওয়ার সময়ই পশ্চিমারা আভাস দিয়েছিল, ইউক্রেনের যুদ্ধ তাদেরও যুদ্ধ। কিন্তু এর আগ পর্যন্ত কেউই প্রকাশ্যে সহায়তার কথা জানান দিত না। গত জানুয়ারি পর্যন্ত জার্মানির চ্যান্সেলর গড়িমসি করছিলেন ট্যাংক দিতে। তিনি চাচ্ছিলেন এ ক্ষেত্রে আগে আমেরিকা এগিয়ে আসুক। আমেরিকা ইউএস এমওয়ান আব্রাহাম ট্যাংক দেওয়ার ঘোষণা দিলে জার্মানি লিওপার্ড ট্যাংক যোগানের ঘোষণা দেয়। এরপর যুক্তরাজ্যও চ্যালেঞ্জার-২ সরবরাহের ঘোষণা দেয়।
যুদ্ধবিমানের প্রাসঙ্গিকতা এ কারণে যে, সম্মুখ যুদ্ধে বা কোনো ভূখণ্ডে পদাতিক যোদ্ধাকে সহায়তা দেয় ট্যাংক। ইউক্রেন ট্যাংক পাচ্ছে, এবার দরকার আকাশ পথে আক্রমণের সুযোগ।
আরেকটি ব্যাপার হলো, না রাশিয়া, না ইউক্রেন— কোনো রাষ্ট্রই ইউক্রেনের আকাশের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেনি। যদিও রাশিয়ার বিশাল সুসজ্জিত ও আধুনিক যুদ্ধবিমান বহর রয়েছে। যে বিমান দিয়ে ইউক্রেনে হামলা করা হচ্ছে, সেগুলো মূলত সোভিয়েত আমলের মিগ ২৯ ও সু ২৭ ফাইটার বিমান। ইউক্রেনের হাতেও রয়েছে একই প্রযুক্তি বিমান। রাশিয়ার আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কাছে মার খাচ্ছে এই বিমান।
এজন্যই মূলত জেলেনস্কি যুক্তরাজ্যের কাছে ইউরো ফাইটার টাইফুন জেট চেয়েছেন। যুক্তরাজ্য সরাসরি তাকে না করেনি। বরং এই বলেছে, সর্বাধুনিক প্রযুক্তির এসব যুদ্ধবিমান চালানোর প্রশিক্ষণ নিতেই কয়েক বছর লাগে। তবে ইউক্রেনকে সাহায্যের প্রথম ধাপ হিসেবে, সামনের বসন্তে ইউক্রেনীয় পাইলটদের প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করা হবে। এ ক্ষেত্রে কোর্স সংক্ষেপ করে দেশটির অভিজ্ঞ পাইলটদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে আগে। কারণ হিসেবে যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেন ওয়ালেস বলেন, একটা বিমানকে টেনে সীমান্ত পার করে দিলাম, এমন সরল নয় ব্যাপারটি। তিনি এ বিষয়টি সহজ করতে ফর্মুলা ওয়ান রেস কারের সঙ্গে তুলনা দেন। তিনি বলেন, রেসে যেমন একটি দক্ষ কর্মীবাহিনী দরকার, নইলে একটু দূরে গিয়েই কার থমকে পড়বে, ঠিক তেমনি একটি অত্যাধুনিক বিমান পরিচালনাও চাট্টিখানি ব্যাপার না। বিমান পরিচালনার জন্য শক্তিশালী ও সমন্বিত একটি অভিজ্ঞ ও দক্ষ টিম প্রয়োজন।
ইউরো ফাইটার জেটের প্রযুক্তি কয়েকটি দেশের প্রযুক্তিবিদদের সমন্বয়ে গড়া। এই দেশগুলোর ঐকমত্য ছাড়া অন্যকোনো দেশ যুদ্ধবিমান পেতে পারে না। তাই যুক্তরাজ্য বিমান দিতে চাইলেও নির্মাতা অন্যান্য দেশ জার্মানি, ইটালি ও স্পেনের সম্মতি লাগবে।
যুক্তরাজ্যের গবেষণা প্রতিষ্ঠান রয়েল ইউনাইটেড সার্ভিস ইনস্টিটিউটেড গবেষক জাস্টিন ব্রংক-এর মতে, যদি টাইফুন যুদ্ধবিমান ইউক্রেনকে দেওয়া হয় তাহলে তা হবে খুবই ব্যয়বহুল প্রতিকী মনোভাব। তবে রাশিয়ার আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার চোখ ফাঁকি দিতে যুদ্ধবিমানগুলোকে খুব নিচ দিয়ে উড়তে হবে। কিন্তু টাইফুনের প্রযুক্তি এমন যে, এর মিসাইলের সীমা বিস্তারের জন্য অনেক উঁচুতে উড়তে হয়। রাশিয়ার দীর্ঘ লক্ষ্যবস্তুতে হামলার সামর্থ্য রয়েছে। তাই এই যুদ্ধবিমানের সুবিধা কাজে আসবে না। এফ ১৬ ও টাইফুন শ্রেণির যুদ্ধবিমানের জন্য মসৃণ রানওয়ে ও কেন্দ্রীভূত বিমান ঘাঁটি প্রয়োজন। অন্যদিকে সুইডেনের গ্রিপেন বিমান অনেক নিচ দিয়ে উড়তে পারে। এসব বিমানের জন্য ছোট ও অমসৃণ রানওয়েও কোনো সমস্যা নয়।
ইউক্রেন যুদ্ধ ক্রমেই কঠিন ও ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে রাশিয়ার জন্য। দিতে হচ্ছে চড়া মাশুল। অবরোধের কারণে এক ইরানের ড্রোনসহায়তা ছাড়া তেমন কোনো যুদ্ধ সরঞ্জাম পায়নি অন্য কোনো দেশ থেকে। বলা যায়, একাই লড়ছে পশ্চিমা দেশগুলোর বিরুদ্ধে। এ ক্ষেত্রে রাশিয়া ইউক্রেনের যুদ্ধবিমান, রানওয়ে, অবকাঠামো ও বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে দেওয়ার জোর চেষ্টা চালাচ্ছে। উভয় পক্ষের অবস্থানে মনে হচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসার আপাত কোনো সম্ভাবনা নেই; বরং যুদ্ধ পরিস্থিতি আরো জটিল হচ্ছে সামনে।
সম্পাদক ও প্রকাশক : মামুনুর রশীদ নোমানী ।
যোগাযোগ: আদালত পাড়া সদর রোড,বরিশাল। ইমেইল: [email protected] মোবাইল: 01713799669
কপিরাইট © সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত 2008-2023 BarisalKhabar24.com