অনলাইন ডেস্কঃ
দেশের ৮৪ শতাংশ কৃষক মূলধন সংকটে আছেন। এদের প্রায় সবাই ভূমিহীন, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষী। অভাবের কারণে স্থানীয় পর্যায়ে চালকল মালিক, চাল ব্যবসায়ীসহ মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছ থেকে নানাবিধ শর্তে ঋণ নিয়ে কৃষি কাজ করে থাকেন। ফসল উঠার সঙ্গে সঙ্গে মধ্যস্বত্বভোগীদের বেঁধে দেয়া দামে তা বিক্রি করে ঋণ শোধ দিতে হয়। এতে তাদের কোনো মুনাফা থাকে না। ফলে কৃষকের মূলধন সংকট বাড়ছেই।করোনা মহামারীতে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে উঠতে বাংলাদেশ এ কৃষকের ওপরই বিশেষ নজর দিয়েছে। সরকার কৃষি খাতকে চাঙ্গা করতে নানামুখী পদক্ষেপ নিচ্ছে। কৃষকদের জন্য ৪ পার্সেন্ট সুদে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা ঋণের ব্যবস্থা হয়েছে। এর মধ্যে ১০ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা। বাকি ১০ হাজার কোটি টাকা কৃষি ও পল্লী ঋণ কর্মসূচির আওতায় বিতরণ করা হবে।
এরই মধ্যে প্রণোদনার ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়ও করা হয়েছে। বাজেটেও বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে গত বছরের তুলনায়। কৃষি খাতে ভর্তুকির কথা বলা হয়েছে সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা।বিশেষজ্ঞরা বলছেন স্বল্প সুদের এ ঋণ সুবিধা কৃষকের কাছে পৌঁছাবে কিনা তা নিয়ে শঙ্কা আছে। ঋণ সুবিধা প্রকৃত কৃষক পাবেন নাকি মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে যাবে সেটাও দেখার বিষয়। এছাড়া নানা কারণে কৃষকদের মাঝে রয়েছে আস্থার সংকট। অবিশ্বাস পদে পদে প্রতারিত হওয়ার কারণে তারা কাউকে বিশ্বাস করতে চান না। মিল মালিকসহ মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে তারা বছরের পর বছর ঠকে আসছেন। মোটা ধানের দাম সরকার নির্ধারণ করে দেয় এক রকম, তাদের কাছ থেকে মিল মালিক ও মধ্যস্বত্বভোগীরা কি নেয় কম দামে। নিয়মের মারপ্যাঁচে তাদের কম দাম দিয়ে ঠকান হয়।পরে মিল মালিকরা সেই ধান বেশি দামে বিক্রি করে। এর সঙ্গে স্থানীয় অসাধু রাজনীতিবিদ এবং খাদ্য বিভাগসহ সরকারি বিভিন্ন দফতরের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জড়িত। এদের কারণে কৃষক বরাবরই বঞ্চিতদের দলে থাকে। তথ্য বলছে, এ বছর ধানের সংগ্রহ মূল্য যেখানে ১ হাজার ২৪ টাকা মণ, সেখানে হাওর অঞ্চলের কৃষকদের ৬০০-৭০০ টাকা মণ দরে ধান বিক্রি করতে হচ্ছে। যদিও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বলছে লটারি করে কৃষকদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করা হবে। কিন্তু বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন।এ বাস্তবতায় কৃষকদের কাছ থেকে কিভাবে ভালো কিছু আশা করা যায়, সরকার কিভাবে তাদের পাশে থেকে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পারে- এমন প্রশ্নে কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক এমপি যুগান্তরকে বলেন, আমরা বেশ কিছু পরিকল্পনা নিয়ে ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন শুরু করে দিয়েছি। আমন ধানের বীজের দাম ছিল ৪০ টাকা। আমরা তা ২০ টাকা করে দিয়েছি। ভারত থেকে বীজ আমদানি করে বিনামূল্যে বীজ ও সার সরবরাহ করেছি। যাতে করে আউশের ফলন বাড়ে। আমরা কৃষিকে বাণিজ্যিকরণ করতে চাই। যাতে করে কৃষকদের হাতে টাকা থাকে।তিনি জানান, রংপুরের বিভাগীয় কৃষি কর্মকর্তা (পরিচালক) তাকে জানিয়েছেন, সেখানে আউশের টর্গেটের চেয়ে ৩৪ ভাগ ফলন বেশি হয়েছে। পরে রবিশস্যের জন্য একইভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানান তিনি।এদিকে যুগান্তরের অনুসন্ধান ও বিভিন্ন দফতরের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লষণ করে দেখা গেছে, দেশের কৃষক মাত্র ১ দশমিক ৩৪ শতাংশ সরকার নির্ধারিত সংগ্রহ মূল্যে ধান বিক্রয় করতে পারেন। ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউট, বাংলাদেশের গবেষণায়ও এটি উল্লেখ রয়েছে।বিগত বোরো মৌসুমের ওপর পরিচালিত তাদের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রায় ৮৪ শতাংশ ভূমিহীন, প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষক। ফলে তাদের মূলধন খুবই কম থাকে। আর কৃষিতে যতই আধুনিকতার ছোঁয়া লাগছে কৃষকের জন্য কৃষি কাজ ততই ব্যয়বহুল হচ্ছে। শ্রমনির্ভর কৃষি থেকে মূলধন নির্ভর কৃষিতে রূপান্তর হচ্ছে। এতে মূলধনের অভাব তীব্রতর হচ্ছে।এ বিষয়ে সরেজমিন অনুসন্ধান চালানো হয়। এতে কৃষক আবীর আলীর ঘটনা থেকে কিছুটা হলেও ধারণা পাওয়া যাবে। একজন চালকল মালিকের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে কৃষি কাজ করেছেন তিনি। শর্ত হচ্ছে, ধান কাটার পর বাজার মূল্যেই চালকল মালিকের কাছে ধান বিক্রি করতে হবে।
আবীর আলীর সাধ্য নেই এর ব্যতিক্রম করার। কারণ তিনি ওই মিল মালিকের কাছে জিম্মি। ফলে ধান সংগ্রহের পরেই স্বল্প দামে সেই ধান মিল মালিকের কাছে বিক্রয় করে দিতে হচ্ছে। এতে অনেক সময় তার খরচও উঠে আসে না।বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক প্রফেসর ড. কামরুজ্জামান উদাহরণ টেনে বলেন, মন্ত্রণালয়ের বিদ্যমান সংগ্রহ নীতিমালা অনুযায়ী লটারিতে আবীর আলীর নাম উঠল। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আবীর আলীর কাছে ধানই নেই। তিনি কিভাবে ধান সরবরাহ করবেন? ফলে তার মতো দেশের ৮৪ শতাংশ ক্ষুদ্র কৃষকের নাম লটারিতে উঠলেও সরবরাহ করার মতো ধান তাদের গোলায় থাকে না। তাদের ধান চলে গেছে ৭০০ টাকা মণ দরে চালকল মালিক কিংবা চাল ব্যবসায়ীর কাছে। আর তারা মনের সুখে ১ হাজার ২৪ টাকা মণ দরে বিক্রি করে। সংগ্রহ করা ধান থেকে উৎপাদিত চাল বিক্রয় করছেন ১৪৪০ টাকা মণ দরে। মন্ত্রণালয়ের ধান বা চাল সংগ্রহের যে লক্ষ্যমাত্রা আছে তা পূরণ করতে গিয়ে আবীর আলীদের মতো কৃষকদেরই অগত্যা ক্ষতির বোঝা মাথায় নিয়ে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দেশের মানুষের খাদ্য জোগান দেয়ার জন্য ধান উৎপাদন করতে হচ্ছে।অপর একজন কৃষি অর্থনীতিবিদ বলেন, আমাদের কৃষকরা সংগ্রহ মৌসুমে যেমন ধান বিক্রয় করছেন ৭০০ টাকা মণ দরে। আবার পরের মৌসুমের ঠিক অব্যবহিত পূর্বে তাদের চাল কিনতে হচ্ছে প্রায় ১৮০০-২০০০ টাকা মণ দরে। এ যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। আবার জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত তো রয়েছেই। আম্পান, ফনীসহ নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত দেশের কৃষকদের। এ নানামুখী চাপ নিয়েই কৃষকদের কৃষি কাজ করতে হচ্ছে। দেশের অর্থনীতির প্রাণভোমরা কৃষিকে রক্ষা করতে এখন পর্যন্ত কার্যকর বাস্তবমুখী কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তেমনটি শোনা যায়নি। অথচ ধান উৎপাদনের গুরুদায়িত্ব সেই কৃষকদের ওপরই। তিনি বলেন, সময় এসেছে কৃষকদের পাশে দাঁড়ানোর।
মিল মালিক ও কৃষকদের মধ্যে বর্তমান অবস্থা আগের মতো নেই উল্লেখ করে কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক রাজ্জাক যুগান্তরকে বলেন, আমার কাছে যতটুকু খবর রয়েছে, এখন ধানের দাম একটু বেশি। সারা বিশ্বে খাদ্য সংকট হতে পারে- এমন আভাস রয়েছে। এ অবস্থায় এখন মিল মালিকরাই উল্টো ধান পাচ্ছেন না বলে জানান তিনি।কৃষিমন্ত্রী বলেন, এ বছর মিল মালিকদের বিরুদ্ধে কৃষকদের ঠকানোর তথ্য সঠিক নয়। রাজশাহীর গোদাগাড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান মো. জাহাঙ্গীর ধানের বাজারে দাঁড়িয়ে আমাকে ফোন করে জানান, ১০৮০ টাকা মূল্যে কৃষকরা বাজারে ধান বিক্রি করছেন। এর আগের দিনও দাম ছিল ৯০০ টাকা মণ। পাইকাররা ধান কিনতে পারছেন। তবে মিলাররা আগের মতো তেমন সুবিধা করতে পারছেন না। তাই তারা ধানও পাচ্ছেন না।
তিনি জানান, বিআর-২৮ যেটা সেটাই নাজিরশাল বলে বিক্রি হচ্ছে। ধানের মণ এখন ১০০০ টাকা।
করোনার প্রভাব মোকাবেলায় কৃষি খাতে ১০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে সরকার। এর মধ্যে কৃষিভিত্তিক ডেইরি, ফুল, ফল ও মৎস্য চাষ খাতে ঋণ দেয়ার জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব খাতে ব্যাংকগুলো ঋণ দিলে বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের সমপরিমাণ অর্থ পরিশোধ করে দেবে। তহবিলের বিপরীতে ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের কাছ থেকে ৪ শতাংশ হারে সুদ আদায় করতে পারবে।প্রান্তিক কৃষকসহ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে ঋণ দেয়ার জন্য ৩ হাজার কোটি টাকার অপর একটি তহবিল গঠন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ তহবিল থেকে ক্ষুদ্রঋণ দানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে মাঠপর্যায়ে ঋণ দেয়া হবে। তহবিল থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ঋণ দেয়া হবে ১ শতাংশ সুদে। ব্যাংক সেগুলো থেকে সাড়ে ৩ শতাংশ সুদে ঋণ দেবে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে। ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান মাঠপর্যায়ে ঋণ দেবে ৯ শতাংশ সুদে। এ খাতের ঋণের বড় অংশই যাবে কৃষি খাতে।সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে প্রান্তিক কৃষি ও ক্ষুদ্র শিল্পে ঋণ দেয়ার জন্য সরকার থেকে আরও ২ হাজার কোটি টাকা দেয়া হয়েছে চারটি সংস্থাকে। এর মধ্যে পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনকে (পিকেএসএফ) ৫০০ কোটি টাকা, কর্মসংস্থান ব্যাংককে ৫০০ কোটি টাকা, পল্লী সঞ্চয় ব্যাংককে ৫০০ কোটি টাকা এবং প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংককে ৫০০ কোটি টাকা।
এর মধ্যে পিকেএসএফ ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে মাঠপর্যায়ের কৃষক ও ক্ষুদ্রোদ্যোক্তাদের ঋণ দেবে। পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক ৫ শতাংশ সুদে কৃষকদের ঋণ দিচ্ছে। কর্মসংস্থান ব্যাংক কৃষিসহ বিভিন্ন খাতে ঋণ দিচ্ছে।
এর বাইরে কৃষি ও পল্লী ঋণ কর্মসূচির আওতায় চলতি অর্থবছরে ২৪ হাজার কোটি টাকা বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এর মধ্যে ১৪ হাজার কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে। বাকি ১০ হাজার কোটি টাকা বিতরণ করা হচ্ছে। এর সুদের হার আগে ৯ শতাংশ ছিল। করোনার প্রভাব কৃষিতে পড়ায় এর সুদের হার কমিয়ে ৪ শতাংশ করা হয়েছে। আগামী অর্থবছরে (২০২০-২১) কৃষি খাতে ভর্তুকি বাবদ সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে (২০১৯-২০) বরাদ্দ ছিল ৯ হাজার কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ৮ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে।
সম্পাদক ও প্রকাশক : মামুনুর রশীদ নোমানী ।
যোগাযোগ: আদালত পাড়া সদর রোড,বরিশাল। ইমেইল: [email protected] মোবাইল: 01713799669
কপিরাইট © সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত 2008-2023 BarisalKhabar24.com