লঘুচাপের প্রভাবে বঙ্গোপসাগরের উপকূল এখন উত্তাল। এর পাশাপাশি পূর্ণিমার প্রভাবে জোয়ার ও টানা বৃষ্টিপাতের কারণে দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন নদ-নদীতে পানির উচ্চতা অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। সব নদীর পানি এখন বিপদসীমার ওপরে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে উপকূলীয় এলাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পড়েছে। তলিয়ে গেছে আমনের বীজতলাসহ ফসলের জমি। জলাবদ্ধতায় পানিবন্দী নিম্নআয়ের মানুষের দুর্ভোগ চরমে। আবহাওয়া বিভাগ পায়রাসহ সব সমুদ্র বন্দরকে ৩ নম্বর সতর্ক সঙ্কেত দেখিয়ে যেতে বলেছে।
বরগুনায় নদীর পানি বিপদসীমার উপরে, ফেরি বন্ধ
বরগুনা সংবাদদাতা জানান, তিন দিনের টানা বর্ষণে উপকূলের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। ফলে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে জেলার হাজার হাজার মানুষ। অপর দিকে পায়রা, বিষখালী ও বলেশ্বর নদীর পানি বিপদসীমার ৩৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে দু’টি ফেরির গ্যাংওয়ে তলিয়ে যাওয়ায় বরগুনা-পুরাকাটা ও বরগুনা-বড়ইতলার সাথে জেলা শহরের ফেরি যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। কখন এ ফেরি চলাচল স্বাভাবিক হবে তা বলতে পারছে না সড়ক ও জনপথ বিভাগ।
তিন নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় দুই ফেরিঘাট তলিয়ে যাওয়া ছাড়াও বরগুনা সদর, আমতলী, তালতলী, বেতাগী, বামনা ও পাথরঘাটা- এ ছয় উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। দুঃখকষ্টে দিন পার করছেন পানিবন্দী নিম্নআয়ের মানুষ। ভোগান্তিতে রয়েছেন সাধারণ মানুষ।
বরগুনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেয়া তথ্যমতে, মঙ্গলবার সকাল ৯টা থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা আড়াইটায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ২১ দশমিক ৮ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। এর আগের দিন ৪০ দশমিক ৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে জেলায়।
টানা বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে আমতলী-পুরাকাটা ও বড়ইতলা-বাইনচোটকি ফেরির গ্যাংওয়ে। এতে পার হতে গিয়ে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন মানুষ। এ দিকে জোয়ারের পানিতে বরগুনা পৌর শহরের কলেজ রোড, ডিকেপি রোড, ফার্মেসি পট্টি, কসমেটিক্স পট্টি ও গার্মেন্ট পট্টির রাস্তা পানিতে তলিয়ে গেছে। প্লাবিত হয়েছে নিম্নাঞ্চল। বড়ইতলা-বাইনচোটকি রুটের কয়েকজন বাসচালক বলেন, জোয়ারের পানিতে ফেরির গ্যাংওয়ে তলিয়ে গেছে। ঝুঁকি নিয়ে ফেরি পারাপার চলতে থাকলে যেকোনো সময় ঘটতে পারে ভয়াবহ দুর্ঘটনা। এ বিষয়ে বরগুনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো: নূরুল ইসলাম বলেন, বৃষ্টি না কমা পর্যন্ত প্রতিটি জোয়ারে আরো নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
রাঙ্গাবালীতে প্লাবিত ২০ গ্রাম
রাঙ্গাবালী (পটুয়াখালী) সংবাদদাতা জানান, রাঙ্গাবালী উপজেলায় লঘুচাপের প্রভাবে সংলগ্ন বঙ্গোপসাগর বেশ উত্তাল রয়েছে। এ দিকে পূর্ণিমার জোয়ের প্রভাবে নদ-নদীর পানির উচ্চতা ২ থেকে ৪ ফুট বৃদ্ধি পেয়েছে। অস্বাভাবিক জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে নিম্নাঞ্চল। বৃহস্পতিবার দফায় দফায় বৃষ্টি ও ভাঙা বেড়িবাঁধ দিয়ে পানি ঢোকায় প্লাবিত হয়েছে উপজেলার ২০টি গ্রাম। বিভিন্ন স্থানে সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। পানিতে ভেসে গেছে পুকুর ও ঘেরের মাছ। তলিয়ে গেছে ফসলি জমি ও বোরো ধানের বীজতলা।
আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপের প্রভাবে উপকূলীয় এলাকায় যেকোনো সময় ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। রাঙ্গাবালী উপজেলায় ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সঙ্কেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। একই সাথে মাছ ধরা ট্রলারকে নিরাপদে থাকতে বলা হয়েছে।
রাঙ্গাবালী উপজেলার কাজির হাওয়ালা গ্রামের কৃষক জহিরুল ইসলাম বলেন, অমাবস্যা বা পূর্ণিমায় জোয়ারের চাপ একটু বেশি হলেই আমাদের গ্রাম তলিয়ে যায়। জমি আর চাষ উপযোগী থাকে না। কষ্ট করতে করতে এখন সহ্য হয়ে গেছে। প্রতি বছর এই মৌসুমে পানি ওঠানামা করে। চরমোন্তাজের ইউপি সদস্য রুনু খান বলেন, জোয়ারের পানি সামান্য বাড়লেই ভাঙা বেড়িবাঁধগুলো দিয়ে হু হু করে পানি ঢোকে। এ বিষয় জানতে চাইলে পটুয়াখালী পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো: কাইছার আলম বলেন, রাঙ্গাবালী উপজেলার চালিতাবুনিয়া, চরমোন্তাজ ও ছোটবাইসদীয়া ইউনিয়নের বেড়িবাঁধ ভাঙন রোধের বিষয় পর্যবেক্ষণ করে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিছু কিছু জায়গায় ভাঙা বেড়িবাঁধ মেরামতের কাজ অব্যাহত আছে।
পায়রা বন্দরে ৩ নম্বর সঙ্কেত
কুয়াকাটা (পটুয়াখালী) সংবাদদাতা জানান, বঙ্গোপসাগরে সুস্পষ্ট লঘুচাপটি বর্তমানে ভারতের ছত্তিশগড় ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছে। এর প্রভাবে পটুয়াখালীর কুয়াকাটাসংলগ্ন বঙ্গোপসাগর বেশ উত্তাল রয়েছে। গত সোমবার থেকে উপকূলীয় এলাকায় থেমে থেমে বৃষ্টিপাত হচ্ছে। এ দিকে পূর্ণিমার জোয়ের প্রভাবে নদ-নদীর পানির উচ্চতা ২ থেকে ৩ ফুট বৃদ্ধি পেয়েছে। অস্বাভাবিক জোয়ারের প্রভাবে ভাঙা বেড়িবাঁধ দিয়ে পানি ঢুকে তলিয়ে গেছে দক্ষিণাঞ্চলসহ অর্ধশতাধিক গ্রাম। বিভিন্ন স্থানে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে।
আমতলীতে চাষাবাদ বন্ধ
আমতলী (বরগুনা) সংবাদদাতা জানান, পূর্ণিমার পাশাপাশি তিন দিনের ভারী বর্ষণে আমতলী-তালতলী উপজেলার আউশ ধানের ক্ষেত ও আমনের বীজতলা তলিয়ে গেছে। পানিতে প্লাবিত হয়ে দুই উপজেলার ৫০ হাজার কৃষকের চাষাবাদ বন্ধ রয়েছে। দ্রুত পানি নিষ্কাশন না হলে আমনের বীজ পচে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানান কৃষকরা।
জানা গেছে, পূর্ণিমার প্রভাবে পায়রা নদীতে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ১৫ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়ে উপকূলীয় অঞ্চল আমতলী ও তালতলীর চর ও নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। চরাঞ্চলের বসবাসরত মানুষজন অতিকষ্টে দিনাতিপাত করছে। দুই উপজেলার ৫০ হাজার কৃষকের চাষাবাদ বন্ধ হয়ে গেছে। বৃহস্পতিবার এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বিভিন্ন গ্রামের আমনের বীজতলা পানির নিচে তলিয়ে রয়েছে। পশ্চিম গাবতলী আবাসনের ছত্তার হাওলাদার বলেন, ‘পানতে ঘর তলাইয়্যা গ্যাছে। গুড়াগারা লইয়্যা কষ্ট হরি।’ উত্তর তক্তাবুনিয়া গ্রামের শিবলী শরীফ বলেন, আউশ ধানের ক্ষেত ও আমনের বীজতলা পানির নিচে। কৃষকদের জমি চাষাবাদ বন্ধ হয়ে গেছে। এ দিকে আমতলী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সি এম রেজাউল করিম বলেন, ভারী বর্ষণে কৃষিজমি তলিয়ে যাওয়ায় আপাতত চাষাবাদ বন্ধ থাকলেও কৃষকদের অনেক উপকারে আসবে। পানি সরে গেলে আমনের বীজের ক্ষতি হবে না।
দক্ষিণাঞ্চলের সব নদীর পানি বিপদসীমার উপরে
ইউএনবি জানায়, বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপের প্রভাবে দক্ষিণাঞ্চলের সব নদ-নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। এতে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার পাশাপাশি বরিশাল নগরীতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যানুযায়ী, বিভাগের মধ্যে বরিশাল নগরী সংলগ্ন কীর্তনখোলা নদীর পানি বিপদসীমার ১২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া বরিশালের পাশের জেলা ঝালকাঠির বিষখালী নদীর পানি বিপদসীমার ১৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অপর দিকে ভোলা খেয়াঘাট সংলগ্ন তেঁতুলিয়া নদীর পানি বিপদসীমার ৩০ সেন্টিমিটার, ভোলার দৌলতখানের সুরমা ও মেঘনা নদীর পানি বিপদসীমার ৬৯ সেন্টিমিটার, তজুমদ্দিনের সুরমা ও মেঘনা নদীর পানি বিপদসীমার ৮৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
অন্য দিকে পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জের বুড়িশ্বর ও পায়রা নদীর পানি বিপদসীমার ২৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। বরগুনার বিষখালী নদীর পানি বিপদসীমার ৩৬ সেন্টিমিটার, পাথরঘাটার বিষখালী নদীর পানি বিপদসীমার ৬৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এ ছাড়া পিরোজপুরের বলেশ্বর নদীর পানি বিপদসীমার ২ সেন্টিমিটার ও উমেদপুরের কচা নদীর পানি বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করে পানি উন্নয়ন বোর্ড বরিশালের উপসহকারী প্রকৌশলী মো: মাসুম বলেন, দক্ষিণাঞ্চলের ২৩টি নদীর পানির উচ্চতা প্রতিনিয়ত পর্যবেক্ষণ করা হয়। এসব অঞ্চলের নদ-নদীর পানি বর্তমানে বিপদসীমার উপরে রয়েছে।
এ দিকে টানা বৃষ্টিপাত ও নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করায় দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ঘরবাড়িতে পানি ঢুকে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে কয়েক হাজার মানুষ। বরিশাল নগরীর বিভিন্ন সড়কে পানি উঠে গেছে, এ ছাড়া নগরীর নিম্নাঞ্চল পানির নিচে রয়েছে।
বরিশাল আবহাওয়া অধিদফতরের জ্যেষ্ঠ পর্যবেক্ষক আব্দুল কুদ্দুস বলেন, বুধবার বেলা ৩টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় ২৪ দশমিক ৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এ ছাড়া বাতাসের গতিবেগ ছিল ৮ থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল। তিনি বলেন, বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপের কারণে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আরো দুই-একদিন দিন বৃষ্টি থাকবে।
সম্পাদক ও প্রকাশক : মামুনুর রশীদ নোমানী ।
যোগাযোগ: আদালত পাড়া সদর রোড,বরিশাল। ইমেইল: [email protected] মোবাইল: 01713799669
কপিরাইট © সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত 2008-2023 BarisalKhabar24.com