বিবিসি বাংলা রেডিও সম্প্রচার বন্ধে হতাশা নেমে এসেছে পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার রূপপুর বিবিসি বাজারের মানুষের মাঝে।
মহান মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোতে রেডিওতে বিবিসির খবর শোনাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বাজারটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের আবেগময় স্মৃতি।
বিবিসি বাংলা রেডিও সম্প্রচার পুনরায় চালুর পাশপাশি স্মৃতি সংরক্ষণে উদ্যোগ গ্রহণের দাবি ওই এলাকাবাসীর।
ইতিহাস বলছে, মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোতে ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশী ইউনিয়নের মুক্তিকামী জনতা দেশের পরিস্থিতি জানতে ছুটে আসতেন রূপপুরের চা দোকানি কাশেম মোল্লার দোকানে। তিন ব্রান্ডের ফিলিপস রেডিওটিতে বিবিসি বাংলায় বাজতো মুক্তিযুদ্ধের খবরভ পাকিস্তানি শাসকদের কড়া নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে বিবিসির খবর শুনতে ভিড় জমাতেন আশেপাশের গ্রামের শত শত মানুষ। আর সে থেকেই মানুষের মুখে মুখে রূপপুরের এই বাজারের নাম হয়ে যায় বিবিসি বাজার। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পাশে প্রায় পৌনে এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বাজারটির বিস্তৃতি।
গত ১ জানুয়ারি থেকে বিবিসি বাংলার রেডিও সম্প্রচার বন্ধ হয়ে গেছে। এতে ভীষণ মন খারাপ বিবিসি বাজারের বাসিন্দাদের। বিবিসি বাজারের ঐতিহাসিক স্মৃতি ধরে রাখার উদ্যোগ না থাকায় তাদের শংকা, মুক্তিযুদ্ধের আবেগময় এ গল্প কি হারিয়ে যাবে কালের গর্ভে? বিবিসি রেডিও সম্প্রচার বন্ধ হয়ে গেলে বিবিসি বাজারের নামও হয়তো একদিন হারিয়ে যাবে।
ঈশ্বরদী উপজেলা আওয়ামী লীগ সহ-সভাপতি বীর-মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ রশিদুল্লাহ জানান, ২০১৫ সালে মারা গেছেন কাশেম মোল্লা। তার রেডিওতেই শোনা হতো যুদ্ধের খবরাখবর। রূপপুরসহ আশেপাশের গ্রামের মানুষকে মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব গাঁথা শোনানোর অপরাধে পাকিস্তানী সেনাদের নির্যাতনে মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়েও মানুষকে মুক্তিবার্তা শোনাতে পিছু হটেননি কাশেম মোল্লা। রূপপুরের মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে তাই বিবিসি বাজার আর কাশেম মোল্লার রেডিও পরম আবেগের নাম। ওই সময় সেখানে কাশেম মোল্লার মুদি দোকান ছিল। পাকবাহিনীর দেওয়া আগুনে সেই দোকান পুড়ে গেলে তিনি পাকশী ছেড়ে রূপপুর এলাকায় চলে আসেন। তুলনামূলক উঁচু একটি জায়গায় রাস্তার ধারে একটি চা দোকান দেন তিনি।
পাকশী ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি, বীর-মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুল ইসলাম হবিবুল জানান, মুক্তিযোদ্ধারা প্রস্তুতি ও সফলতার ঘটনা রেডিও পাকিস্তানে প্রচার করা হতো না। ফলে আমাদের এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা আর সাধারণ মানুষের কাছে ভরসার নাম হয়ে ওঠে কাশেম মোল্লার ওই ফিলিপস ব্র্যান্ডের থ্রি ব্যান্ডের রেডিও। মুক্তিযুদ্ধের পরে ধীরে ধীরে কাশেম মোল্লার দোকানের পাশে আরও দোকান বাড়তে থাকে। মানুষ আসার সময় বলত, বিবিসি শুনতে যাই, বিবিসির বাজারে যাই। এভাবে বলতে বলতে একটা সময় এই বাজারের নামই হয়ে যায় বিবিসি বাজার।
কাশেম মোল্লার ঐতিহাসিক রেডিও ও নানা স্বীকৃতি স্মারক এখনও আঁকড়ে আছে পরিবার। তাদের দাবি মুক্তিযুদ্ধে কাশেম মোল্লা ও রূপপুরবাসীর সাহসিকতার গল্প নতুন প্রজন্মকে জানাতে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ। একই সঙ্গে বিবিসি বাংলার রেডিও সম্প্রচার পুনরায় চালু ও স্মৃতি সংরক্ষণে স্থায়ী উদ্যোগ গ্রহণের দাবী রূপপুরের মানুষের।
কাশেম মোল্লার ছোট ভাই আবুল কালাম আজাদ বলেন, একদিন বিকেলে হানাদার বাহিনী গ্রামে চলে আসে। বড় ভাই কাশেম চিন্তা করলে যে, রেডিও যদি পাক আর্মিদের হাতে চলে যায়, তাহলে আমরা এই খবরগুলো এই অঞ্চলের মানুষকে শোনাতে পারব না। তখন রেডিওটাকে রক্ষা করার জন্য গোপনে জঙ্গলের মধ্যে ফেলে দেন। কাশেম মোল্লাও একজন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি জীবন বাজি রেখে বিবিসির সংবাদের মাধ্যমে নানা রকম তথ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে সামিল হয়েছেন। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাননি তিনি।
কাশেম মোল্লার ছেলে জাহিদুল ইসলাম বলেন, বাবার ঐতিহাসিক রেডিওটি আমরা যত্ন করে নিজেদের কাছে রেখেছি। এখন নতুন প্রজন্মের অনেকেই বিবিসি বাজারের ইতিহাস জানে না। যেহেতু বাংলা ভাষার জন্য লড়াইকে জাতিসংঘ স্বীকৃতি দিয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করেছে। তার প্রতি সম্মান জানিয়ে বিবিসি বাংলা রেডিও সম্প্রচার পুনরায় চালু করবে বলে আমরা আশা করি। একই সঙ্গে বিবিসি বাজারে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি সংগ্রহশালা গড়ে তোলার দাবি জানাই।
পাকশী ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি চেয়ারম্যান সাইফুজ জামান পিন্টু বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ডাক দিয়ে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি হয়। তারপরে সঠিক খবরটি প্রতিদিন শোনার স্বার্থে সন্ধ্যার পর কাশেমের দোকানে ভিড় জমতো। একবার বিবিসি কতৃপক্ষ জানতে পারে,বাংলাদেশ রূপপুরে একটি বাজার আছে, যার নাম বিবিসি বাজার। পরবর্তীতে প্রতিনিধিও আসেন। আমাদের প্রাণের একটি মাধ্যম হলো বিবিসি সংবাদ, আবেগের বিষয়, আবেগকে মূল্যায়ন করে সংবাদ মাধ্যমটি চালু করা দরকার।
জানা গেছে, পাকশী ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে একটি বাজেট পাস করা হয়েছে। বিবিসি বাজারে স্মৃতি সংগ্রহশালা নির্মিত করা হবে। স্মৃতিফলকে সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তি, যারা এলাকার উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছেন, স্মৃতিফলকে তাদের নাম রাখা হবে।
সম্পাদক ও প্রকাশক : মামুনুর রশীদ নোমানী ।
যোগাযোগ: আদালত পাড়া সদর রোড,বরিশাল। ইমেইল: [email protected] মোবাইল: 01713799669
কপিরাইট © সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত 2008-2023 BarisalKhabar24.com