ঘোষণার দ্বিতীয় দশক পূর্তিতে, ২০১১ সালে এগিয়ে আসে ইউনেসকো। দাবি জানানো হয়, জনগণের তথ্য জানা ও পাওয়ার অধিকার। এর সূত্র ধরেই ২০১৯ সালে জাতিসংঘ ২৮ সেপ্টেম্বরকে ঘোষণা করে তথ্য জানার সর্বজনীন অধিকারের আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে।
এ বছর ‘উইন্ডহোক ঘোষণা’র তৃতীয় দশকপূর্তিতে বলা হচ্ছে, জনকল্যাণের জন্য তথ্য। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য গণমাধ্যম ও জনগণের একটি যোগসূত্র গড়ে তুলতে বলা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে যে চ্যালেঞ্জগুলোকে সামনে আনা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে—সংবাদমাধ্যমের টিকে থাকার জন্য অর্থনৈতিক সামর্থ্য, ইন্টারনেট কোম্পানিগুলোর তথ্যপ্রবাহে আরও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং গণমাধ্যম সম্পর্কে জনশিক্ষার সম্প্রসারণ, যাতে সাধারণ মানুষ গণমাধ্যমের মূল্য বোঝে এবং জনকল্যাণে তথ্যের দাবিতে সাংবাদিকদের পাশে দাঁড়ায়।
কিন্তু এমন এক সময়ে এসব কথা বলা হচ্ছে, যখন জনগণের কাছে গণমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ।
২০১৭ সালে রয়টার্স ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব জার্নালিজম এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে ইউরোপজুড়ে সংবাদমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে এক জরিপ চালানো হয়। নিক নিউম্যান এবং রিচার্ড ফ্লেচারের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এই জরিপ চলে বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত বলে পরিচালিত আটটি দেশে।
এগুলো হচ্ছে—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, আয়ারল্যান্ড, স্পেন, জার্মানি, ডেনমার্ক, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স ও গ্রিস। আটটি দেশের হাজার হাজার মানুষের কাছ থেকে খোলা প্রশ্নের জবাব বিশ্লেষণ করে যে ফলাফল পাওয়া গেছে তার ভিত্তিতেই এই রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। এই রিপোর্টের শিরোনামটিই হচ্ছে ‘বায়াস, বুলশিট, লাই’। অভিধান বলছে, ‘বায়াস’ মানে হচ্ছে পক্ষপাত, একপেশে। ‘বুলশিট’ অর্থ বাজে কথা, আবোলতাবোল কথাবার্তা। আর ‘লাই’ মানে মিথ্যা, অসত্য।
জরিপের ফলাফল বলছে, সংবাদমাধ্যমের ওপর যাঁদের আস্থা নেই, তাঁদের ৬৭ শতাংশ মনে করেন অধিকাংশ সংবাদমাধ্যম একপেশে, নিজেদের অ্যাজেন্ডা নিয়ে সাংবাদিকতা করে। সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার চেয়ে ক্ষমতাশালী বা প্রভাবশালী মহলের [ শুধু ক্ষমতাসীন নয় ] রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থকেই রক্ষা করে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের পাঠক, দর্শক-শ্রোতাদের অভিযোগ, তাঁদের দেশে প্রধান সংবাদমাধ্যমগুলো পছন্দসই পক্ষের হয়ে কাজ করে। জরিপে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিরা মনে করেন, টেলিভিশনে যা দেখানো হয়, তা থেকে সত্যের কাছাকাছি কিছুটা ধারণা নেওয়া যায়, কিন্তু দ্রুত খবর প্রচার করতে গিয়ে তারা প্রকৃত তথ্যকে পাশ কাটিয়ে যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারাও বিশেষ অ্যাজেন্ডা নিয়ে কাজ করে। তবে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও ডেনমার্কে সংবাদমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে বেশি।
জরিপে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতার চিত্র বেশ করুণ। এদের বিশ্বাসযোগ্যতার পক্ষে মাত্র ২৪ ভাগের অবস্থান। জরিপে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিরা বলছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সত্যের চেয়ে কল্পনাকেই গুরুত্ব দেয় বেশি। অসত্য তথ্য, নিজস্ব অ্যাজেন্ডা, প্রবল নিজস্ব মতামতনির্ভর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তথ্যদূষণের জন্যও দায়ী। তবে মূলধারার সংবাদমাধ্যমের অতিমাত্রায় পক্ষপাত ও অ্যাজেন্ডা-নির্ভর সাংবাদিকতা বিপুলসংখ্যক মানুষকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নির্ভরশীল করে তুলেছে।
এই ধরনের একটি জরিপ এই মুহূর্তে বাংলাদেশে করা হলে ফলাফল কী হবে, তা ধারণা করা যায়। যদিও গণমাধ্যমের পশ্চিমা সংকট সব সময়ই আমাদের উপমহাদেশের সঙ্গে পা মিলিয়ে চলে না। যেমন এই দশকের মাঝামাঝি পশ্চিমা দেশগুলোতে সংবাদপত্রের ছাপানো সংস্করণ ঝুঁকির মধ্যে পড়ে, অনেক পত্রিকার ছাপানো সংস্করণের প্রচারসংখ্যা যখন কমে যেতে থাকে, তখন বিপরীত চিত্রটি ছিল এই উপমহাদেশে।
কিন্তু গণমাধ্যমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নবিসরাও জানবেন, সংখ্যার হিসাব গণমাধ্যমের গুরুত্ব মাপার কোনো মাপকাঠি নয়। যখন বলা হয়, এই সংবাদপত্রটি বা টিভি চ্যানেলটি ‘ভালো’, তার মানে হচ্ছে ওই সংবাদপত্র বা টিভি চ্যানেলটির প্রতি বেশিসংখ্যক মানুষ আস্থা রাখে। সাংবাদিকতার শক্তিই হচ্ছে তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতা।
সংবাদমাধ্যমগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতার সংকট সাংবাদিকতায় নতুন ও প্রধান চ্যালেঞ্জ। গণমাধ্যমের ভোক্তারা এখন আর গণমাধ্যমকে বিশ্বাস করছে না, আস্থা রাখতে পারছে না। এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী হয়তো অনেক কারণ। কিন্তু পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে নির্মোহভাবে তাকাতে হবে নিজেদের দিকেই। সাংবাদিকতার পেশাদারির অভ্যন্তরীণ শক্তিকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করা গেলে বাইরের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সহজ হয়।
যাঁরা গণমাধ্যমের প্রতি আস্থা হারাচ্ছেন, তাঁরা সরাসরি আঙুল তুলেছেন সাংবাদিক এবং সংবাদমাধ্যমের প্রতি। তাঁরা কখনো কখনো সংবাদমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে গুলিয়ে ফেলছেন। বড়দাগে সব সংবাদমাধ্যমই গণমাধ্যমের অংশ কিন্তু সব গণমাধ্যম সংবাদমাধ্যম নয়। গতি বা সংযোগের দিক থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অবশ্যই সনাতনী সংবাদমাধ্যমের চেয়ে অনেক এগিয়ে। কখনো কখনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সংবাদমাধ্যমের প্রাথমিক সূত্রও বটে। প্রযুক্তির আধুনিকতায় সমৃদ্ধ হলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখনো গণযোগাযোগের ‘ব্যক্তিগত মাধ্যম’, কোনো অর্থেই ’সংবাদমাধ্যম’ নয়।
প্রধান পার্থক্য, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আধেয় [ বিষয়বস্তু] নির্বাচন বা উপস্থাপনে সাংবাদিকতার কোনো ব্যাকরণ মানতে হয় না। কারণ সেখানে কোনো সম্পাদক নেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যাঁর নামে আইডি, তিনিই মালিক, তিনিই সম্পাদক, তিনিই বার্তা সম্পাদক, তিনিই রিপোর্টার, তিনিই সাব এডিটর। একটি প্রচলিত সংবাদমাধ্যমে বিষয় নির্বাচন থেকে শুরু করে, সাংবাদিকতাসুলভ অনুসন্ধান, সব প্রশ্নের জবাব নিশ্চিতকরণ শেষে নির্ধারিত কাঠামো অনুসরণ করে উপস্থাপন পর্যায়ে যেতে হয় বার্তা সম্পাদক বা সম্পাদকের চূড়ান্ত অনুমোদন নিয়ে।
কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে সাংবাদিকতার এতসব ব্যাকরণ অনুসরণ করতে হয় না বলে তাকে সংবাদমাধ্যমের স্বীকৃতি দেওয়া যায় না। কোনো মতপ্রকাশের স্বাধীনতা শর্তহীন চূড়ান্ত অধিকার নয়। বাংলাদেশের সংবিধানের যে অধ্যায়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে, সেখানেও স্বাধীনতার সীমারেখাটি স্পষ্ট করা হয়েছে। শুধু আইন নয়, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, নৈতিকতা, প্রাতিষ্ঠানিক, সামাজিক এমনকি পারিবারিক মূল্যবোধ দ্বারাও নিয়ন্ত্রিত। সামাজিক গণমাধ্যমগুলো অনেক সময় এসবের ধার ধারে না ।
গণমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতার সংকটের উৎসটিকে দুভাবে ভাগ করা যায়। একটি হচ্ছে রাষ্ট্র বা সরকারসৃষ্ট সংকট। যেমন রাষ্ট্র প্রণীত কোনো কালো আইন, সাংবাদিক হত্যার বিচার না হওয়া, গণমাধ্যম বিষয়টি বোঝেনই না, এমন মালিকানায় গণমাধ্যম তুলে দেওয়া, সরকার বা রাষ্ট্রের বাহিনীর হাতে অবাধ ক্ষমতা দেওয়া। অপরটি হচ্ছে রাষ্ট্র বা সরকারের বাইরের উৎস থেকে সৃষ্ট সংকট। যেমন সরকারের বাইরের প্রভাবশালী মহলের গণমাধ্যমবিদ্বেষী আচরণ, গণমাধ্যম পরিচালনায় বিশেষ মহলের হস্তক্ষেপ, গণমাধ্যমকর্মীদের বেতন-ভাতা না দেওয়া, নারী কর্মীদের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, বিজ্ঞাপনদাতা-করপোরেট গোষ্ঠীর প্রভাব, বিশেষ অ্যাজেন্ডা নির্ধারণে বিশেষ গোষ্ঠী বা মালিকের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ চাপ।
এই দুই সংকট মোকাবিলায় লড়াই একা একা করা যায় না, প্রয়োজন হয় জোটবদ্ধ শক্তির। প্রয়োজন হয় নাগরিক সমাজের সহায়তার, গড়ে তুলতে হয় সামাজিক আন্দোলনও। যেমন বাংলাদেশে তথ্য অধিকার আইনটি অর্জন করা গিয়েছিল সাংবাদিক ও নাগরিক সমাজের যৌথ উদ্যোগেই।
অন্যদিকে, সাংবাদিককে তাঁর পেশাগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নিজেকেই তৈরি করতে হবে যোগ্যতর করে। সাংবাদিকতা হচ্ছে একটি পেশা, যেখানে কুমিরভর্তি পুকুরে নিজেকে বাঁচিয়ে সাঁতার কাটার দক্ষতা অর্জন করাই একমাত্র বেঁচে থাকার উপায়। এই কুমির কখনো সরকার, কখনো রাজনৈতিক দল, কখনো ভূমিদস্যু, কখন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সেন্সর আরোপকারী কর্তৃপক্ষ, কখনো করপোরেট স্বার্থবাহী গোষ্ঠী, কখনো বিজ্ঞাপনদাতা, এমনকি কখনো মালিক নিজেই।
সাংবাদিকতা আগাগোড়াই বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষের পেশা। এ জন্যই এই পেশার দায়িত্বশীলতা আরোপিত হয় না। একজন সাংবাদিক তাঁর মেধা ও মননশীলতা দিয়েই তাঁর দায়িত্বশীলতা নির্ধারণ করেন। এর সঙ্গে তাঁর জবাবদিহি নিশ্চিত করার জন্য যুক্ত হয় সমাজ। কারণ একজন সাংবাদিক যখন তথ্য সংগ্রহ করেন বা কোনো মতামত দিতে চান, তার কোনোটাই তাঁর ব্যক্তিগত সংকীর্ণ স্বার্থ থেকে করেন না; করেন সমাজ ও মানুষের বৃহত্তর স্বার্থেই। একজন সাংবাদিক যখন একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির অপকর্ম নিয়ে খবর প্রচার বা প্রকাশ করেন, তখন প্রথম শর্তটিই হচ্ছে পর্যাপ্ত তথ্যপ্রমাণ হাতে থাকতে হবে।
দ্বিতীয় আবশ্যিক শর্তটি হচ্ছে, যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁকে তাঁর বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ দিতে হবে। এই দুটি প্রাথমিক শর্ত অনুসরণ করা হলে প্রচারিত খবরটি কোনো বিশিষ্টজনকে হেয় করার জন্য করা হয়েছে, এমনটি বলার সুযোগ থাকবে না। তখন এই রিপোর্টটিকে ‘বায়াস, বুলশিট বা লাই’ বলা যাবে না। চূড়ান্ত বিচারে কিন্তু খবরটি প্রকাশের বেলায়ও সাংবাদিক নিরপেক্ষ নন। কারণ, সাংবাদিকতার দায় হচ্ছে সেই সব ভোটারের প্রতি, যাঁরা এই জনপ্রতিনিধিকে নির্বাচিত করেছিলেন।
এই খবরের তথ্যই প্রমাণ করবে যে ভোটাররা ভুল মানুষকে নির্বাচিত করেছিলেন। সংবাদমাধ্যমের মৌলিক দায়িত্বের দ্বিতীয়টিই হচ্ছে মানুষকে শিক্ষিত ও সচেতন করে তোলা। ওই রিপোর্টটি প্রকাশ করে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলকেও সতর্ক করা হলো, যাতে ভবিষ্যতে তারা প্রার্থী বাছাইয়ের বেলায় সঠিক মানুষটিকে বেছে নিতে পারে। বড়দাগে রিপোর্টটি পরোক্ষভাবে আমাদের রাজনীতি থেকে অসৎ, দুর্নীতিবাজ অপরাজনীতিকদের দূর করার সামাজিক দায়িত্বও পালন করল।
সংবাদমাধ্যমের এই চ্যালেঞ্জগুলো নতুন নয়, কালের বিবর্তনে শুধু চেহারা বদল হয়েছে। সতেরো শতকের শেষ দিকে রাজনৈতিক হাতিয়ার থেকে সংবাদমাধ্যম হয়ে উঠল সমাজের ‘ওয়াচডগ’। এই বঙ্গে কাঙাল হরিনাথের সাংবাদিকতাকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা যায়। তবে কালক্রমে গণমাধ্যমে পুঁজি হাজির হলো নতুন, একই সঙ্গে সম্ভাবনা ও সংকট নিয়ে।
কারণ পুঁজি এবং পেশাদারিতেও সংকট দাঁড়াল একেবারে মুখোমুখি। আজ যখন সংবাদমাধ্যমকে পক্ষপাতিত্বের বা বিশেষ অ্যাজেন্ডা স্থাপনের অভিযোগে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে , খোঁজ নিলে দেখা যাবে এর মূলে রয়েছে মালিকানা। অল্প ক্ষেত্রে পেশাদার উঁচু পর্যায়ের সাংবাদিকেরা থাকলেও কিছু ব্যতিক্রম বাদে পুঁজি বিনিয়োগকারীর চরিত্রই নির্ধারণ করছে একেকটি সংবাদমাধ্যমের সম্পাদকীয় চরিত্র। সেখানে সম্পাদক নামে ঠুঁটো জগন্নাথটি না পারছেন পেশাদারি সাংবাদিকতার দায়িত্বটি পালন করতে; না পারছেন মালিকের চোখরাঙানির বাইরে যেতে। এই দোদুল্যমানতার কারণেই সংবাদমাধ্যম আস্থা হারাচ্ছে।
প্রশ্ন উঠেছে, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা মানে কার স্বাধীনতা। পুঁজির স্বাধীনতা, নাকি সাংবাদিকতার স্বাধীনতা? এ প্রশ্নের জবাব মেলে না। কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দল বা ধর্মবিশ্বাসীদের নিজস্ব মতবাদ নিয়ে কোনো প্রকাশনা বা সম্প্রচারমাধ্যম হতে পারবে না, এমন নয়। কিন্তু গোল বাধে যখন এই বিশেষ মতবাদীরা নিজেদেরও নিরপেক্ষ দাবি করতে থাকে।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ক্ষমতাশালীদের দাপট। এই ক্ষমতাশালী যে সব সময় সরকার, তা নয়। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে এদের চেহারা বদল হয়। এরা আনুষ্ঠানিক কোনো সেন্সরশিপ আরোপ করে না কিন্তু এদের হম্বিতম্বিতে সংবাদমাধ্যম গুটিয়ে যায় বা নিষ্ক্রিয় থাকে।
এরা সাংবাদিক হত্যা করে, সাংবাদিকদের নির্যাতন করে, আইনি বিপাকে ফেলে, হত্যার হুমকি দেয় কিন্তু এসবের কোনো বিচার হয় না। একেবারে নতুন কৌশল—ধামাধরা নিম্নমানের সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমকে নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে, অপসাংবাদিকতার মিছিল বাড়িয়ে নৈতিকতা বা পেশাগত মর্যাদায় উন্নত গণমাধ্যমকে অমর্যাদাকর জায়গায় ঠেলে দিয়ে তাদের জীবন দুর্বিষহ করে তোল।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সাংবাদিকদের নানা উচ্চাভিলাষের জন্য পেশা ও রাজনৈতিক বিশ্বাসের সংমিশ্রণ, বিশেষ ক্ষমতাশালী মহলের মুখপত্রে পরিণত হওয়া ইত্যাকার নানা বিষয়।
বিশ্ব মুক্ত সংবাদমাধ্যম দিবসে যখন টিকে থাকা, স্বচ্ছতা এবং মানুষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের তাগিদ দেওয়া হচ্ছে, তখন বিশ্বাসযোগ্যতার সংকট থেকে সংবাদমাধ্যমকে রক্ষা করার দায়িত্ব নিতে হবে পেশাদার সাংবাদিকদেরই। অপরাজনীতি যেমন রাজনীতিকে গ্রাস করে ফেলে, তেমনি অপসাংবাদিকতাও প্রকৃত পেশাদার সাংবাদিকতাকে গ্রাস করে ফেলতে উদ্যত আজ। ভালো সাংবাদিকতাই কেবল সাংবাদিকতাকে রক্ষা করতে পারে।
মনজুরুল আহসান বুলবুল সাংবাদিক।