যাত্রী, পার্কে ঘুরতে আসা ব্যক্তি, রোগীর স্বজন এবং পথচারীদের জন্য বরিশাল নগরীর বিভিন্ন স্থানে সিটি করপোরেশন থেকে নির্মাণ করা পাবলিক টয়লেটগুলোর বেশিরভাগই দীর্ঘদিন ধরে তালাবদ্ধ রয়েছে। আর যে কয়টি খোলা রয়েছে সেগুলোও থাকে অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্ন, ব্যবহার করতে হয় অনিচ্ছা নিয়ে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাবলিক টয়লেটগুলো আধুনিকায়নের দাবি নগরবাসীর।
৫৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে গঠিত বরিশাল সিটি করপোরেশনে লোকসংখ্যা প্রায় ৫ লাখ। নগরীর দুটি বাসস্ট্যান্ড, শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, নগরীর প্রান্তে চরকাউয়া খেয়াঘাট, ছোট লঞ্চঘাট এবং নগরীর বঙ্গবন্ধু উদ্যান (বেলসপার্ক), আমতলা মোড় এলাকার স্বাধীনতা পার্ক, মুক্তিযোদ্ধা পার্ক এলাকায় পাবলিক টয়লেট রয়েছে।
বরিশাল পৌরসভা থাকাকালীন নগরীর বান্দ রোডের ছোট লঞ্চঘাট এলাকায় প্রথম পাবলিক টয়লেট নির্মাণ করা হয়। সিটি করপোরেশনে উন্নীত হওয়ার পর টয়লেটের ইজারার পরিমাণ বেড়েছে কিন্তু ব্যবহারকারীদের সুবিধা বাড়েনি।
নগরীর স্বাধীনতা পার্ক এলাকার পাবলিক টয়লেটনগরীর স্বাধীনতা পার্ক এলাকার পাবলিক টয়লেট
টয়লেটের ইজারাদার মো. মন্টু বলেন, তিনি পর পর তিন বছর ইজারা পেয়েছেন। সর্বশেষ গত বছর ইজারা নিয়েছেন ২ লাখ ৬৫ হাজার টাকায়। এক বছর ঠিকমতো পরিচালনা করলে লাভ হয়। তবে দীর্ঘদিনের পুরনো হওয়ায় প্রতি বছর স্থাপনা সংস্কার এবং পাইপলাইনের কাজ করাতে গিয়ে তিনি লাভের অংশ হারিয়ে ফেলছেন।
সরেজমিন দেখা গেছে, ইজারাদার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখায় দুর্গন্ধ নেই। তবে বহু বছরের পুরনো হওয়ায় লোহার দরজা খসে পড়ছে। বিভিন্ন স্থানে প্লাস্টারের অবস্থা খুবই খারাপ।
মন্টু বলেন, এখন প্রয়োজন ভবনটি ভেঙে নতুনভাবে টয়লেট নির্মাণের। কারণ, আধুনিক যুগে এখনও সেই পুরনো আমলের প্যান। গোসলের ভালো ব্যবস্থা নেই। হাই-কমোড থেকে শুরু করে গোসলের জন্য ভালো ব্যবস্থা করা গেলে বেশি টাকা দিতেও আপত্তি করবে না পথচারীরা।
প্রায় ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১২ সালে দ্বিতীয় পরিষদের মেয়র তৎকালীন আওয়ামী লীগ সভাপতি সাবেক এমপি প্রয়াত শওকত হোসেন হিরন নগরীর কীর্তনখোলা নদীর পাড়ঘেঁষে বিআইডব্লিউটিএ’র জমিতে মুক্তিযোদ্ধা পার্ক নির্মাণ করেন। ভোর থেকে রাত পর্যন্ত মানুষের সমাগম হয় পার্কটিতে।
চরকাউয়া খেয়াখাটে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ঘেরা পাবলিক টয়লেটচরকাউয়া খেয়াখাটে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ঘেরা পাবলিক টয়লেটচরকাউয়া খেয়াখাটে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ঘেরা পাবলিক টয়লেট
পার্কটিতে ঘুরতে আসা ব্যক্তিদের জন্য মাঝামাঝি স্থানে পুরুষ ও মহিলাদের জন্য পাবলিক টয়লেট নির্মাণ করা হয়। হিরন মেয়র থাকাকালীন পার্কটিতে থাকা পাবলিক টয়লেট সবার জন্য উন্মুক্ত থাকলেও বর্তমান পরিষদের আমল থেকেই তা তালাবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। এর ফলে খুব ভোরে ব্যায়াম করতে আসা বয়স্ক থেকে শুরু করে যুবক ও তরুণদের মাঝে মধ্যে টয়লেটের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। তাছাড়া পার্কে ঘুরতে আসা ব্যক্তিরাও টয়লেট ব্যবহার করতে পারছেন না।
বঙ্গবন্ধু উদ্যানের পাবলিক টয়লেট খোলা থাকলেও অপরিষ্কার থাকায় তা ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এরপরও জরুরি প্রয়োজন হলে ওই অপরিষ্কারের মধ্যেই তাদের কাজ সারতে হচ্ছে বলে জানান একাধিক ব্যক্তি।
স্বাধীনতা পার্কের জন্য নির্মিত পাবলিক টয়লেটের অবস্থাও ভালো নয়। সেখানকার পাবলিক টয়লেট ভবনের ছাদের প্লাস্টার খসে পড়ছে। এছাড়া বাথরুমের অবস্থাও ভালো নয়। ঠিকমতো পরিষ্কার না করায় সারাক্ষণ ময়লা থাকে প্যানে। এখানেও সেই পুরনো আমলের কমোড। সামনের এক দোকানে টয়লেটের চাবি থাকে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া সেখানে যান না বলে জানালেন দোকানি মো. দেলোয়ার।
শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজের জরুরি বিভাগ সংলগ্ন এলাকার পাবলিক টয়লেটশের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজের জরুরি বিভাগ সংলগ্ন এলাকার পাবলিক টয়লেটশের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজের জরুরি বিভাগ সংলগ্ন এলাকার পাবলিক টয়লেট
চরকাউয়া খেয়াঘাটে স্থাপিত টয়লেট সহজে কেউ খুঁজে পাবে না। টয়লেটের চারপাশ ঘিরে রেখেছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। তাছাড়া টয়লেটের ভেতরও ব্যবসায়ীদের মালামাল রাখা। শুধু আড়াই ফুটের দরজাটা চোখে পড়ে। কীর্তনখোলা নদী পাড়ি দিয়ে প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষ প্রবেশ করে নগরীতে। আবার রাত হলে নগরী ছাড়েন। তাদের জন্য টয়লেটটি খুবই প্রয়োজনীয়।
সদর উপজেলার বাসিন্দা রিয়াজ হোসেন বলেন, পাবলিক টয়লেটটি নির্মিত হয়েছে খেয়া পারাপারের যাত্রীদের জন্য। কিন্তু কোনও যাত্রী আজ পর্যন্ত ওই টয়লেট ব্যবহার করেছে কিনা আমার জানা নেই। তাছাড়া ওই স্থানে টয়লেট রয়েছে তা তো বোঝাই যায় না।
শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ক্যান্টিন সংলগ্ন এলাকায় রোগীর স্বজনদের জন্য তৎকালীন মেয়র শওকত হোসেন হিরন একটি পাবলিক টয়লেট নির্মাণ করেন। নির্মাণের পর তা খোলা থাকলেও বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। ব্যবহার করতে পারছে না সংশ্লিষ্টরা।
নগরীর মুক্তিযোদ্ধা পার্কে তালাবদ্ধ পাবলিক টয়লেটনগরীর মুক্তিযোদ্ধা পার্কে তালাবদ্ধ পাবলিক টয়লেট
এছাড়া নগরীর কেন্দ্রীয় নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনাল ও রূপাতলীর অভ্যন্তরীণ বাস টার্মিনালে দুটি পাবলিক টয়লেট রয়েছে। তা ইজারার মাধ্যমে চলছে। টাকা দিয়ে টয়লেট ব্যবহার করলেও ওই দুটি পাবলিক টয়লেটের অবস্থা খুবই খারাপ। বিপদে না পড়লে সেখানে যেতে চান না কেউ। শুধু বাস সংশ্লিষ্ট শ্রমিক, চালক ও হেলপাররা এবং বাইরের কিছু লোকজন সেটি ব্যবহার করে থাকেন। অথচ কমোড থেকে শুরু করে গোসল করার জন্য আধুনিক শাওয়ার ব্যবস্থা করা গেলে এ দুটি থেকে বছরে ভালো টাকা আয় করতে পারতো সিটি করপোরেশন।
নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনাল এলাকায় ঢাকা থেকে আগত রাশেদসহ একাধিক ব্যক্তি বলেন, আমরা পৃথিবীর অনেক দেশের চেয়ে পিছিয়ে আছি। বহু আগে চীনে উন্নতমানের পাবলিক টয়লেট নির্মিত হয়েছে। সেখানে কার্ডের মাধ্যমে তা ব্যবহার করা যায়। ওইসব টয়লেটে গোসলে সাবান-শ্যাম্পু থেকে শুরু করে সবকিছু ব্যবহারের জন্য রাখা থাকে। দাঁত পরিষ্কারের পেস্টও থাকে। আর আমাদের দেশে এখনও সেই মান্ধাতা আমলের পাবলিক টয়লেট। এগুলো ব্যবহার দূরে থাক, ওর মধ্যে ঢুকতেই ইচ্ছে হয় না।
নগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পাবলিক টয়লেটের বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের গুরুত্ব দেয়া উচিত বলে মনে করেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। আর মানসম্মত টয়লেট ব্যবহার না করলে বিভিন্ন রোগে সংক্রমণের কথা জানান চিকিৎসকরা।
বরিশাল সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক শাহ সাজেদা বলেন, ‘বিশেষত নারীর সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতে পাবলিক টয়লেট অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমি আশা করব, সংশ্লিষ্ট বিভাগ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে দ্রুত এ সমস্যার সমাধান করবে।
বরিশাল পৌরসভা আমলে নির্মিত একতলা লঞ্চঘাট এলাকার পাবলিট টয়লেট বরিশাল পৌরসভা আমলে নির্মিত একতলা লঞ্চঘাট এলাকার পাবলিট টয়লেট
পরিবেশ ও সমাজকর্মী কাজী মিজানুর রহমান বলেন, উন্নতমানের পাবলিক টয়লেট খুবই দরকার—যেখানে একজন মানুষ গোসল থেকে শুরু করে কাপড় পরিবর্তন এবং টয়লেট ব্যবহার করতে পারবে। সবক্ষেত্রে লাভের হিসাব কষলে চলবে না। জনগণের জন্যও চিন্তা করতে হবে। এক্ষেত্রে শুধু সিটি করপোরেশন নয়—গণপূর্ত বিভাগ, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ, জেলা পরিষদ এবং জেলা প্রশাসকসহ সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
এ বিষয়ে নিউরো মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. তানজিমা তারান্নুম দিপু বলেন, ‘দীর্ঘ সময় প্রস্রাব আটকে রাখলে, নারীদের ইউরেনেটিক ইনফেকশন হওয়ার আশঙ্কা থাকে। শুধু নারী নয় শিশু এবং সব বয়সী মানুষের ক্ষেত্রে এ শঙ্কা থেকে যায়। তাই নগরে পাবলিক টয়লেট জরুরি।
২০২১ সালের জনশুমারি অনুযায়ী বরিশাল নগরীতে পাবলিক টয়লেট আছে মাত্র ৬টি।
এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য বরিশাল সিটি করপোরেশনের প্রশাসনিক কর্মকর্তা স্বপন কুমার এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ ফারুক আহমদের মোবাইল নম্বরে কল দেওয়া হলে তারা রিসিভ করেননি।
সম্পাদক ও প্রকাশক : মামুনুর রশীদ নোমানী ।
যোগাযোগ: আদালত পাড়া সদর রোড,বরিশাল। ইমেইল: [email protected] মোবাইল: 01713799669
কপিরাইট © সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত 2008-2023 BarisalKhabar24.com